অনলাইন শিষ্টাচার

শাকের জামিল

0
57

আমাদের জগত এখন দুটো। একটা অনলাইন জগত আরেকটা অফলাইন জগত। আমাদের মেলামেশা, মতবিনিময়, দেখা সাক্ষাত, গল্পের আড্ডা, সভা সমাবেশ, স্কুল কোচিং এর ক্লাস-পরীক্ষা কিংবা বাজার-সদাই সবকিছুই এখন অফলাইনের পাশাপাশি অনলাইনে হচ্ছে। সামাজিক জীবনের একটা বড় অংশ দখল করে নিয়েছে অনলাইন যোগাযোগ বা অনলাইন সামাজিকতা। তবে অফলাইন বা বাস্তব জগতে আমরা যেভাবে সামাজিকতার ক্ষেত্রে বা আচার-ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও ‘ভেবে-চিন্তে’ আচরণ করি, অনলাইনে সেটা করি না। অনলাইনে আমার আচরণ আরেকজনের উপরে কেমন প্রভাব ফেলে সেটা নিয়ে আমরা ভাবারও সময় পাই না। কারণ অনলাইনের শত-সহস্র কনটেন্ট আর অ্যাকটিভিটি গ্লু এর মতো আটকে রাখে চোখকে; একটার পর আরেকটা একটিভিটি দিয়ে ব্যস্ত করে ফেলে মস্তিষ্ককে।
যেমন ধরো- তুমি একটা সাইকেল কিনেছো। ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করলে। সাথে সাথে অনেক বন্ধু রিঅ্যাক্ট দিলো। অনেকে লাইক দিলো, কেউ কেউ লাভ দিলো। এর মধ্যে আবার কয়েকজন হাহা রিঅ্যাক্ট দিলো। এখন তুমি তো সবাইকে আলাদা আলাদা জিজ্ঞেস করতে পারবে না, যে কে কোনটা কী ভেবে দিলো! (অবশ্য কোন রিঅ্যাক্ট দিয়ে কী অনুভূতি প্রকাশ হয়, এটাও অনেকে জানে না। আবার অনেক সময় ভুলেও রিঅ্যাক্ট পড়ে যায়।) তো, একটা নতুন সাইকেলের আনন্দের সংবাদে কয়েকটা হাহা রিঅ্যাক্ট তোমাকে কিছুটা হলেও আহত করতে পারে। যারা হাহা দিলো, তারা যদি তোমাকে সাইকেলসহ সরাসরি দেখতো, তাহলে হয়তো হেসে দিতো না। কিন্তু ওই যে, অনলাইনে হাহা দেয়াটা একটা অভ্যেস হয়ে গেছে, তারা না দিয়ে পারে না। হয়তোবা আরেক বন্ধুর নতুন টি-শার্ট বা চশমার ছবিতেও তুমি হাহা দিয়ে এসেছো। অন্যকে হেয় করার এমন এক প্রতিযোগিতা চলে অনলাইনে।

এবার চলো অনলাইনে কিছু শিষ্টাচার নিয়ে আলোচনা করা যাক-
১. পোস্ট করা :
– তথ্যমূলক কোনো কিছু হলে সেটা নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে নিশ্চিত হতে হবে। প্রয়োজনে তথ্যসূত্র উল্লেখ করে দিতে হবে। কোনো মিথ্যা তথ্য, গুজব বা অপতথ্য ছড়ানো যাবে না।
– কারো অপবাদ বা গীবত লেখা যাবে না। আমরা হরহামেশাই এ কাজটা করি। অনলাইনকে বিচারালয় বানিয়ে ফেলি। কারো বিরুদ্ধে লিখে দিলেই হয়, বাকিরা এসে নানান শাস্তির রায় দিতে থাকে।
– বিনোদনমূলক ছবি/ভিডিওর ক্ষেত্রে অশালীন কিছু পোস্ট দেয়া যাবে না।
– ব্যক্তিবিশেষকে হেয় করে ছবি-বিকৃতি বা মিম বানিয়ে পোস্ট করা যাবে না।
– ধর্মীয় বিষয়ে অতি আবেগী হয়ে কারো বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক পোস্ট দেয়া যাবে না। কোনো ধর্মকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে ঘৃণা উদ্রেককারী পোস্ট দেয়া যাবে না।
– এলাকাগত বিদ্বেষ কিংবা গোষ্ঠীগত বিদ্বেষ নিয়ে পোস্ট করা যাবে না। – কারো গোপন তথ্য, ছবি, মেসেজ কিংবা বক্তব্য পোস্ট করা যাবে না।
– দেশবিরোধী, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে এমন কোনো পোস্ট করা যাবে না।

২. রিঅ্যাক্ট করা :
– কারো পোস্টে রিঅ্যাক্ট করার আগে ভাবতে হবে তার সাথে তোমার সম্পর্ক কী বা কেমন। তোমাকে সে কতটা জানে বা কেমন হিসেবে জানে তার উপর নির্ভর করবে তোমার দেয়া রিঅ্যাক্ট এর অর্থ সে কীভাবে নিবে।
– কারো সাফল্য বা অর্জন কিংবা কারো কোনো প্রচেষ্টার পোস্টে কখনো হাহা রিঅ্যাক্ট দিবে না। হয়তো তোমার কোনো বন্ধু নতুন কবিতা লিখছে, পড়ে তোমার মনে হলো- কীসব ছাইপাশ লিখেছে! এইটা কি কবিতা হইলো! তবুও তুমি হাহা দিবে না। তাকে উৎসাহিত করতে লাইক দিবে।

৩. কমেন্ট করা :
– কমেন্ট করার ক্ষেত্রেও লক্ষ রাখবে কার পোস্টে কমেন্ট করছো, তার সাথে সম্পর্ক কেমন। কারো সাথে সম্পর্ক ঘনিষ্ট না হলে তার ব্যক্তিগত ছবিতে গিয়ে গণহারে কমেন্ট করবে না।
– কমেন্টে গালি-গালাজের একটি প্রবণতা আছে। এ থেকে বিরত থাকবে। তোমার কমেন্টের প্রত্যুত্তরেও কেউ গালি দিতে পারে। সেক্ষেত্রে সংযত থাকবে। কমেন্ট বক্সে অন্য কমেন্টকারীদের সাথে ঝগড়ায় জড়াবে না।
– পোস্টের সাথে কোনো সম্পর্ক নেই এমন কমেন্ট করবে না।
– পোস্টের কমেন্টে কুশলাদি জিজ্ঞেস করতে গিয়ে ব্যক্তিগত আলাপচারিতা শুরু করা থেকে বিরত থাকবে।
– কমেন্ট করার ক্ষেত্রে কাউকে হেয় করে, বিদ্রুপ করে, নিচু করে কমেন্ট করবে না। কাউকে হুমকি দিবে না। এগুলো সাইবার বুলিং এর মধ্যে পড়ে।
– কমেন্ট করার ক্ষেত্রে প্রো-অ্যাকটিভ হবে, রিঅ্যাকটিভ হবে না। যেমন- কারো কোনো ভুল তথ্যের পোস্টে রিঅ্যাকটিভ হয়ে তুমি কমেন্ট করতে পারো- ‘কী মিয়া! গাঁজা খেয়ে পোস্ট করেন নাকি!’ হতে পারে উনি ভুলবশত পোস্ট করেছেন কিংবা যাচাই করার সুযোগ পাননি। বরং তুমি প্রোঅ্যাকটিভ হয়ে কমেন্ট করতে পারো- ‘ভাই, তথ্যটা ভুল। সঠিক তথ্যটি হবে- এমন…’। কারো ভুল পোস্ট কিংবা অসংলগ্ন পোস্ট দেখলে প্রয়োজনে তাকে ম্যাসেজ দিয়ে জানাতে পারো।
– যে ধরনের কমেন্ট তুমি মেনে নিতে পারো না বা সহ্য করতে পারো না, নিজে সে ধরনের কমেন্ট করবে না।
– কমেন্টে ফিশিং লিংক বা স্প্যামিং করবে না।
– কাউকে ‘ধুয়ে দিয়ে আসি ’ এই নিয়তে কমেন্টের অত্যাচার করবে না।

৪. শেয়ার করা :
– কোনো পোস্ট কপি করে শেয়ার করলে অবশ্যই মূল পোস্টদাতার নাম উল্লেখ করে দিতে হবে। এক্ষেত্রে পোস্টের শেষে নাম না দিয়ে শুরুতে কপি’র সাইন এবং ব্যক্তির ফেসবুক নাম উল্লেখ করে দিলে ভালো। কারণ অনেক ক্ষেত্রেই পোস্টের একদম শেষে পোস্টদাতার নাম থাকলে সেটি পাঠকের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়।
– পোস্ট শেয়ার করার ক্ষেত্রে যার কাছ থেকে নেয়া হচ্ছে সে বিশ্বস্ত কিনা সেটা খেয়াল করতে হবে। মনে রাখতে হবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়, এমন পোস্ট শেয়ার করাও অপরাধ।

৫. ম্যাসেজিং :
– ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ কিংবা অন্য ম্যাসেজিং অ্যাপে ম্যাসেজ করার ক্ষেত্রে অপরিচিত হলে সালাম দিয়ে তোমার পরিচয় লিখে তারপর তোমার জিজ্ঞাসা লিখতে পারো। হুট করেই জিজ্ঞাসা করে বসবে না। আবার শুধু সালাম পাঠিয়ে জবাবের অপেক্ষায় বসে থাকবে না; যে আগে জবাব দিক তারপর পরের প্রসঙ্গে ম্যাসেজ দিবো। তোমার জরুরি জিজ্ঞাসা থাকলে এক ম্যাসেজেই লিখে দাও। উনি প্রয়োজন বুঝে রিপ্লাই করবে। Ñনিকটজন না হলে হুট করে ভিডিও কল করবে না। প্রয়োজন হলে টেক্সট ম্যাসেজ বা অডিও কল করে ভিডিও কলের অনুমতি নিবে। কারণ সবসময় ভিডিও কলে কথা বলার মত অবস্থায় সবাই থাকে না।
– যার-তার কাছে তোমার ভালো লাগা রিলস, ভিডিও, মিম পাঠাবে না।
– ক্লোজড গ্রুপ বা প্রাইভেট গ্রুপের ম্যাসেজ গ্রুপের বাইরে কাউকে শেয়ার করবে না।
– ব্যক্তিগত যোগাযোগ এর স্ক্রিনশট ফাঁস করবে না। কারো কাছে অশ্লীল ছবি পাঠাবে না, চাইবে না।

সার্বিকভাবে একটা কথা মাথায় রাখবে- ‘জানতে হবে, কোথায় তোমায় থামতে হবে’। অনলাইনে সময় দেয়ার ক্ষেত্রে কত সময় দিচ্ছো সেটা লক্ষ রাখবে। অযথা সময় নষ্ট করবে না। তোমার অনলাইন কর্মকাণ্ড আরেকজনের জীবনে কতটা প্রভাব ফেলতে পারে সেটা খেয়াল রাখতে হবে। শুধু সাইবার বুলিং এর কারণে অনেক ছেলে মেয়ে হতাশ হয়ে পড়ে, ঝরে পড়ে। কেউ কেউ আত্মহত্যা পর্যন্ত করে ফেলে। তাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তোমার অ্যাকটিভিটি হতে হবে বিবেচনাবোধ সম্পন্ন, মার্জিত, রুচিশীল এবং কল্যাণকর।