কবি ফররুখ আহমদ। বড়দের যেমন স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, তেমনি স্বপ্ন দেখিয়েছেন ছোটদেরও। তিনি নির্মল মন নিয়ে ভালোবাসতেন শিশুদের। তাঁর মন শিশুদের জন্যে গভীর মায়ায় ছলকে উঠত। ফলে শিশুদের জন্য তাঁর হাত থেকে ঝরে পড়েছে মজাদার ছড়া, কবিতা, গান, গল্প ও নাটক।
শিশুসাহিত্য জগতে ফররুখ আহমদ আসেন পাখির বাসা নিয়ে। পাখিদের বিচিত্র জগত তাঁর শিশু সাহিত্যে ব্যাপক স্থান জুড়ে আছে। তিনি পঙ্খীরাজ ঘোড়ায় চড়ে যেমন কবিতার রাজ্যে ঘুরে বেড়াতেন- তেমনি ছড়াসাহিত্যেও ছোটদের সাথী করে নিতে ভুল করেননি। তাঁর পাখি বিষয়ক ছড়াগুলো পাখির জীবনের বিচিত্র প্রসঙ্গ শিশু-কিশোরদের ভাবিয়ে তুলেছে, আন্দোলিত করেছে। ফলে তিনি প্রকৃতির অপার রহস্য ‘পাখির বাসা’ নিয়ে হাজির হয়েছেন ছোট্ট শিশু-কিশোরদের কাছে। এতে রয়েছে সাত রঙা কবিতা। প্রতিটি কবিতার বর্ণনা গানে গানে রূপ লাভ করেছে।
যেমন-
“আয়গো তোরা ঝিমিয়ে পড়া দিনটাতে
পাখির বাসা খুঁজতে যাবো একসাথে।
কোন বাসাটা ঝিঙে মাচায়
ফিঙে থাকে কোন বাসাটায়
কোন বাসাতে দোয়েল ফেরে
সাঁঝ রাতে।”
কবির ‘পাঁচ মিশালী’তে ঝড়-বৃষ্টি ও ঋতু সম্পর্কীয় ছড়া বর্ণিত হয়েছে। রূপ কাহিনীতে রূপকথার রাজপুত্র-রাজকন্যা, কবির চোখে শাহজাদা-শাহেরজাদী। সিতারা ও শাহীন- ইতিহাসের বীরপুরুষ, নেতা, সাহসী নায়ক সম্পর্কে কবিতায় বর্ণিত হয়েছে।
‘চলার গান’ এ দেশ ও জাতির মান, সবুজ পতাকা, আদর্শ, সম্মুখে চলার গান ইত্যাদি রয়েছে। যেমন-
“শুনবো না আর পেছন টান
মানবো না আর বান তুফান।”
শিশু সাহিত্যে কবি ফররুখ আহমদের দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘হরফের ছড়া’। এই গ্রন্থের প্রতিটি শব্দ চয়ন করা হয়েছে শিশুর পরিচিত জগত থেকে। চিত্রধর্মী প্রতিটি ছড়ায় শিশুর চেনা জগত ও পারিপার্শ্বিকতা থেকে উপাদান সংগৃহীত হয়েছে। যেমন-
“ঝ-য়ের কাছে ঝিঙে
ঝিঙে লতা ফিঙে
ঝিঙে লতা জড়িয়ে গেলো
কালো গরুর শিঙে।”
শিশু সাহিত্যে কবির প্রকাশিত তৃতীয় গ্রন্থ ‘ছড়ার আসর’ ১ম খণ্ড। আমার মনে হয়েছে কবির সৃষ্টি শিশুসাহিত্যের মধ্যে তাঁর শ্রেষ্ঠ কীর্তি এই শিশু ছড়াগুলো। কবির ছন্দে গাঁথা অধিকাংশ রচনাই হয়েছে গান, মিষ্টি গীতি ভাবনার রূপায়ন। শব্দ চয়ন, ছন্দ লালিত্য, সঙ্গীতময়তা সকল দিক দিয়েই ফররুখ আহমদের শিশুদের জন্য রচিত ছড়া গতিময়, সমৃদ্ধ ও প্রাণচঞ্চল। তিনি ছড়াকে কল্পরাজ্যে হলদি কোটার দেশে নিয়ে যান।
সেখানে পশু-পাখি আর মেহেদি পাতায় হাত রাঙান। সেখানে আছে সাঁঝের পরি, সোনারকাঠি-রূপোরকাঠি, জন্তু-জানোয়ার। এসব নিয়ে শিশুদের যে চিরচেনা জগত, সেখান থেকেই কবি তাঁর ছড়ার পাত্র-পাত্রী নির্বাচন করেছেন। যেমন-
“মাঘ মাসে আবছায়া কুয়াশার পাখা
ঢেকে ফেলে আসমান কালিজুলি মাখা
ঝোলা খুলে হিম হাওয়া ছায়ে ক্ষণে ক্ষণে
রাত্তিরে কাঁপে বাঘ সুন্দরবনে।”
কবি ফররুখ আহমদের চতুর্থগ্রন্থ ‘নতুন লেখা’। এই গ্রন্থের কবিতাগুলো পাঁচটি ভাগে বিভক্ত। নতুন লেখা, রংতামাশা, সবুজনিশান, কিসসা শোনার সন্ধ্যা, রাসূলে খোদা। কবি এই গ্রন্থে প্রকৃতির বিচিত্র ভাবের সমারোহ ছন্দে, গানে, কল্পনায়, বাস্তবে যেমন প্রকাশ করেছেন, তেমনি দেশ-জাতি, সমাজ, ধর্ম ও নীতির ব্যাখ্যাও করেছেন। এতে তিনি ছোটদের মনোরাজ্যে তাঁর এক পূণ্যময় ছবি পরিস্ফুট করতে চেয়েছেন। অন্যায়, অবিচার, দুর্নীতিকে প্রশ্রয় না দিয়ে কবি সত্যের সন্ধান করেছেন। ফলে আল্লাহ ও রাসুল, মহাপুরুষদের মহৎ ভাবনা উৎসারিত হয়েছে তাঁর ছড়ার অনেক পংক্তিতে। তাছাড়া হাসি ও কৌতুকময়তা ফররুখ আহমদের শিশু সাহিত্যের এক প্রবলতম লক্ষণ।
শিশু-কিশোরদের জন্য লেখা কবির পাখির বাসা, হরফের ছড়া, চিড়িয়াখানা, ফুলের ছড়া, সাঁঝ সকালের কিসসা, ছড়ার আসর, পোকা মাকড়, পাগলাইঞ্জিন, দাদুর কিস্সা, পাখির ছড়া, আলোক লতা, খুশীর ছড়া, নতুন লেখা, রংমশাল, নয়া জামাত আমাদের শিশসাহিত্যকে নতুন জগতের রাজপথের সন্ধান দিয়েছে। তিনি শিশু সাহিত্যেও নয়া দিগন্তের দ্বার উন্মোচন করেছেন। শিশুদের তিনি নিয়ে যান স্বপ্নের রাজ্যে।
মধুমতি নদীর তীরে ছোট্ট একটি গ্রাম। নাম তার মাঝআইল। এইগ্রামেই ১৯১৮ সালের ১০ জুন কবি ফররুখ আহমদের জন্ম। বাবার নাম খান সাহেব সৈয়দ হাতেম আলী। আর মা বেগম রওশন আক্তার । এখন আর তিনি আমাদের মাঝে নেই। ১৯৭৪ সালের ১৯ অক্টোবর তিনি চিরদিনের জন্য আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন পর জগতে।
এই সৌভাগ্যবান কবি তাঁর জীবনের মজার মজার অভিজ্ঞতা ফুলের ডালায় সাজিয়ে ছড়িয়ে রেখে গেছেন আমাদের জন্য। যা আজ সারাদেশজুড়ে সবার হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে। যার গল্প ছড়িয়ে পড়েছে সবখানে, সব দিকে। ০