নিঃস্বার্থ ভালোবাসা

শফিক শাহরিয়ার

0
180

মাদের ছোট্ট একটি গ্রাম। গ্রামের নাম কনইল। সরদার পাড়ায় আমাদের বাড়ি। আমরা দু’ভাই। সোহেল ও জুয়েল। দুই ভাইয়ের মধ্যে আমিই কনিষ্ঠ। মা বাবার ইচ্ছে ছিল এক ছেলেকে স্কুলে এবং আরেক ছেলেকে মাদরাসায় পড়াবেন। সৃষ্টিকর্তা সেটা পূর্ণ করেছেন। বড় ভাই ভীমপুর হাইস্কুলের ছাত্র। আমি জাফরাবাদ দাখিল মাদরাসার ছাত্র ছিলাম। তখন উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল না। বাড়ি থেকে মাদরাসায় হেঁটে যেতে বিশ-পঁচিশ মিনিট লাগত। মাদরাসার অনেক স্যারই আমার প্রিয়। তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় ছিলেন ইবরাহীম স্যার।

স্যার যেমন সহজ-সরল, তেমনি রাগী। বেয়াদবি করলে বা পড়া মুখস্থ না হলে স্যারের বেতের ঘা অদ্যাবধি মনে আছে। স্যারের সঙ্গে কথা বলতে ছাত্রছাত্রীরা বড্ড ভয় পেত। আমাদের গ্রামের দর্জিপাড়ায় স্যারের বাড়ি। সেই সুবাদে ছোটবেলা থেকেই অনেক দিনের চেনাজানা। স্যারকে অন্যদের মতো আমি ভয় পেতাম না। উচ্চতায় ক্লাসের সবচেয়ে ছোট ছিলাম। ইবরাহীম স্যার ছাত্রছাত্রীদের খুব ভালোবাসতেন। কেন জানি আমাকে একটু বেশি ভালোবাসতেন। তখন হয়তো বুঝেও না বোঝার ভান করেছি। এভাবেই সেখানে পাঁচটি বছর কেটেছে। দাখিল পরীক্ষায় কাক্সিক্ষত সাফল্য পেয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিলাম।

এরপর উল্ল­াসপুর আলিম মাদরাসা থেকে আলিম পাস করলাম। মাদরাসার হোস্টেলে থাকতাম। তখন হাতে হাতে ফোন ছিল না। তারপর ফার্স্ট অ্যাডমিশনে নওগাঁ সরকারি কলেজে অনার্সে ভর্তি হলাম। সেকেন্ড অ্যাডমিশনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেলাম। সেখান থেকেই পড়াশোনার পাট চুকিয়ে চাকরির জন্য মহাসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। যাই হোক, মা-বাবার সঙ্গে দেখা হলেই স্যার আমার খোঁজখবর নিতেন। ধারাপাতের নামতার মতোই স্যার আমার সব কথা মনে রেখেছেন। স্যারের সঙ্গে তেমন যোগাযোগ করতাম না বলে তিনি অভিমানও করতেন।

গ্রামে গেলেই স্যার আমাকে তাঁর বাড়িতে ডাকতেন। যতœসহকারে আপ্যায়ন করাতেন। একদিন বললেন, এখন সবার হাতে হাতে ফোন। চাইলেই কারো সঙ্গে কথা বলা যায়। তুমি কি আমাকে মিস করো? মিস করলে আমার ফোনে একবার মিস তো দিতে পারো! স্যারকে বললাম, চাকরির টেনশনে থাকি। পড়াশোনার পাশাপাশি কয়েকটা টিউশনি করি। সত্যিই আপনাকে খুব মিস করি। সময়ের অভাবে কথা বলা হয় না।
তিনি বললেন, আমি চাকরি করি, সংসার দেখভাল করি। আরো অনেক কাজ থাকে। আমাকে সবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হয়।

স্যারের বড় মেয়ের জামাই রাজশাহী শহরে থাকেন। সেখানে বেড়াতে এলেই আমার কাছে আসেন। জামাইয়ের বাসায় নিয়ে যান। গত কুরবানি ঈদের ছুটিতে বাড়ি গিয়ে স্যারের সঙ্গে দেখা করিনি। অন্তত দু’দিনে একবার ফোনেও কথা বলা হয়নি। আসলে সেটা আমারই ব্যর্থতা ছিল। স্যার আমার ওপর প্রচ- রাগ করেছেন। একদিন তিনি হঠাৎ আমাকে ফোন দিলেন। বললেন, এবার ছুটিতে জামাইয়ের বাসায় যাব। তোমার সঙ্গে দেখা করব। বললাম, খুউব ভালো হবে। আসেন স্যার, জলদি আসেন। একটা কথা বলতে গিয়ে আমার গলা শুকিয়ে গেল। স্যার বললেন, নির্ভয়ে বলো। আমি তোমাকে ছেলের মতোই দেখি। বললাম, আমার বাড়ি থেকে কিছু জিনিসপত্র পাঠাবে। আপনাকে নিয়ে আসতে কেমনে বলি? তিনি বললেন, আমি তো তোমার ওখানেই যাচ্ছি। তুমি টেনশন করো না বাবা। কোনো অসুবিধে হবে না। আমিই নিয়ে যাব। বড়ভাইয়ের স্যারের বাড়িতে জিনিসপত্র পৌঁছে দেবার কথা ছিল। পরদিন খুব সকালে স্যার নিজেই হেঁটে আমাদের বাড়িতে গেলেন। জিনিসগুলো নিজ হাতে বহন করে শহরে এসে আমাকে দিলেন। স্যারকে আন্তরিক ভালোবাসা ও অজ¯্র কৃতজ্ঞতা জানালাম। তিনি বললেন, শহরে কয়েকটা দিন আছি। দুজন মিলে ঘোরাঘুরি করব। তুমি থাকলে আমার অনেক অনেক ভালো লাগবে।

শহরে আমি একটি সাবলেটে ভাড়া থাকি।
একদিন সকালে স্যার আমার বাসায় এলেন। নাশতার পর্ব শেষে উনি আমাকে জামাইয়ের বাসায় নিয়ে যেতে চাইলেন। বললেন, একদম খালি হাতে যাওয়া ঠিক হবে না। জামাই বলবে তুমিই কিনেছ। স্যার দোকান থেকে আপেল ও মিষ্টি কিনলেন। আমাকে বিল পরিশোধের কোনো সুযোগ দিলেন না। প্যাকেট দুটো আমার হাতে নিলাম। ভরদুপুরে সেখানে পৌঁছালাম। দুলাভাই বললেন, এগুলো নিয়ে আসার কোনো দরকার ছিল না। তুমি এখন ছাত্র। এক টাকার অনেক মূল্য। চাকরি পেলে ভিন্নকথা। আমি থাকলে খরচ করতেই দিতাম না। দুলাভাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীতে কাজ করেন। অবৈধ ইনকামে বড় হতে চান না। বৈধ ইনকামে জীবন কাটাতে চান। তার দুই মেয়ে। প্রখর মেধাবী। নাশতার পর্ব শেষে বিশ্রাম নিলাম। বাসার সবাই মিলে জমজমাট আড্ডা দিলাম। জোহরের নামাজ আদায় করে খেতে বসলাম। আপা মেয়েদেরকে
খাওয়ালেন। আর দুলাভাই নিজ হাতে আমাদেরকে আপ্যায়ন করালেন। এরপর উনি খেতে বসলেন।
তারপর আমি ও স্যার একটি রুমে গিয়ে বিশ্রাম নিলাম। স্যার বললেন, আজ কিছু কথা বলি বাবা মন দিয়ে শোনো। আমার একটাই ছেলে। সে রংপুর মেডিকেল কলেজে পড়ে। বোনের বাসায় আসার তেমন সুযোগ পায় না। বছরে দু-একবার আসতে পারে। তুমি আমার ছাত্র। আমার ছেলের মতো। তোমার কোনো বোন নেই। যখন মন খারাপ হবে বড় বোনের বাসায় বেড়াতে এসো! নাতনিদের দেখে যেও। আমাকে ভালো মন্দ খবর জানাবে। তোমার জন্য প্রাণভরে দোয়া করি। একদিন তুমি চাকরি পাবে। সংসার হবে। খুব ব্যস্ত থাকবে। স্যারের কথা মনে রেখো। মা বাবাকে কখনো ভুলে যেও না। স্যারের কথায় দু’চোখ ছলছল করে উঠল। বুঝলাম, স্যার আমাকে কত্ত ভালোবাসেন! তাঁর সংস্পর্শে না এলে হয়তো আজো এই নিঃস্বার্থ ভালোবাসার মর্ম বুঝতাম না।