কম্পাস: সভ্যতার বাহন

আরিব মাহমুদ

0
40
কম্পাস: সভ্যতার বাহন

আসসালামু আলাইকুম প্রিয় বন্ধুরা। কেমন আছো? ভালো আছো নিশ্চয়ই।
ডিসেম্বরের ছুটিতে তোমরা সবাই তো বেড়াতে যাবে তাই না? ধরো, তুমি তোমার খালামণির নতুন বাসায় বেড়াতে যাচ্ছো, যেটা তুমি চেনো না। বাসার কাছাকাছি যাওয়ার পর তোমাকে উনি ফোনে বললেন, সামনের মোড় থেকে এবার দক্ষিণ দিকে আসো। তখন তুমি কী করবে? হয় কাউকে জিজ্ঞেস করবে, নয়তো দিকনির্দেশসূচক কোনো চিহ্নের দিকে তাকাবে (কিংবা সূর্যের দিকে তাকাবে) তাই না?
কিন্তু ধরো, তুমি আটলান্টিক মহাসাগরের কোনো দ্বীপে, কিংবা সাহারা মরুভূমির কোনো মরুদ্যানে বেড়াতে যাচ্ছো। এমন সময় তোমার খালামণি কল দিয়ে বললেন, বাবা ‘একটু’ দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে এগিয়ে আয়। তখন কী করবে? সূর্যের দিকে তাকাবে, এই তো? কিন্তু ‘একটু’টা ঠিক কতটুকু, কীভাবে বুঝবে? ‘একটু’টা যদি ‘আরেকটু’ বেশি বা কম হয়ে যায়, তখন কী করবে? রাতের বেলা সূর্যই বা পাবে কোথায়?
বলছিলাম কম্পাসের কথা। তোমাকে ‘একটু’ এবং ‘আরেকটু’র বিড়ম্বনা থেকে বাঁচাতে পারে এ দারুণ জিনিসটি। শুধু বিড়ম্বনা থেকে বাঁচাতেই নয়, বরং যদি বলি পুরো মানবসভ্যতা দাঁড়িয়ে আছে যে কয়েকটি জিনিসের ওপর, কম্পাস তার মধ্যে একটি, তাহলে অবাক হবে? চলো তাহলে, শুরু করা যাক কম্পাসের গল্প।
প্রথমেই চলো, কম্পাসের প্রাথমিক পরিচিতিটা সেরে নেই। আমরা জানি, দিক মোট দশটি। এর মধ্যে কম্পাসে আটটি দিকের ব্যবহার রয়েছে। প্রধান চারটি দিককে কম্পাসের পরিভাষায় কার্ডিনাল পয়েন্ট বা কার্ডিনাল ডিরেকশন বলা হয়। দিকগুলো হলো উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম। কম্পাসে দিকগুলোকে N, S, E এবং W দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। প্রতিটি দিকের মাঝে পার্থক্য ঠিক ৯০ ডিগ্রি। প্রধান চারটি দিকের ঠিক মাঝ বরাবর আরও চারটি দিক রয়েছে। এগুলোকে অর্ডিনাল পয়েন্ট বা ইন্টারকার্ডিনাল পয়েন্ট বলা হয়। কার্ডিনাল পয়েন্ট থেকে ৪৫ ডিগ্রি কোণে এদের অবস্থান। দিকগুলো হলো- উত্তর-পশ্চিম, দক্ষিণ-পশ্চিম, দক্ষিণ-পূর্ব এবং উত্তর-পূর্ব। কম্পাসে দিকগুলোকে NW, SW, SE এবং NE দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। এছাড়াও কার্ডিনাল পয়েন্ট ও অর্ডিনাল পয়েন্টের ঠিক মাঝ বরাবর সেকেন্ডারি অর্ডিনাল পয়েন্ট নামে আরও আটটি পয়েন্ট রয়েছে। কার্ডিনাল পয়েন্ট কিংবা অর্ডিনাল পয়েন্টের সঙ্গে সেকেন্ডারি কার্ডিনাল পয়েন্টের পার্থক্য ২২.৫ ডিগ্রি। এরপর রয়েছে কম্পাস রোজ। কম্পাসের বেজমেন্টকে কম্পাস রোজ বা কম্পাস স্টার বলা হয়। এখানে দিকনির্দেশক ও ডিগ্রির মান লেখা থাকে। কম্পাসে একটি চৌম্বকীয় কাঁটা বা ম্যাগনেটিক নিডল থাকে, যা সবসময় ম্যাগনেটিক নর্থের দিকে (সত্যিকারের উত্তর দিক নয় কিন্তু, চৌম্বকীয় উত্তর দিক) ইঙ্গিত করে। ম্যাগনেটিক নিডলটি একটি পিণ্ট পয়েন্ট কিংবা কেন্দ্রবিন্দুর ওপর দাঁড়িয়ে থাকে।

বলছিলাম সত্যিকারের উত্তরদিক আর চৌম্বকীয় উত্তরদিকের কথা। কী, অবাক হচ্ছো? উত্তরদিক আবার দুইটা হয় নাকি? হ্যাঁ, আসলেই হয়। কীভাবে? চলো দেখি।
সত্যিকারের উত্তরদিক (True North) হচ্ছে উত্তর মেরু যেই দিকে অবস্থিত, ঠিক সেইদিকটাই। সত্যিকারের উত্তরদিককে ভৌগলিক উত্তরদিকও (Geographic North Pole) বলা হয়। পৃথিবী যে অক্ষকে কেন্দ্র করে ঘুরে, তার ঠিক উত্তরদিকটাই ট্রু নর্থ বা সত্যিকারের উত্তরদিক। তুমি পৃথিবীর যেখানেই যাও না কেন, সত্যিকারের উত্তরদিক সবসময় একটাই থাকবে। আর থাকবেই না কেন, এটার নামই তো সত্যিকার উত্তরদিক। সত্যি তো সবসময় একটাই, তাই না!
চৌম্বকীয় উত্তরদিক (Magnetic North) হচ্ছে পৃথিবীর চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের প্রভাবে চুম্বকের কাঁটা উত্তরে যেইদিকে অবস্থান করে।
পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে গিয়ে চৌম্বকীয় উত্তরদিক পরিবর্তন হয়। অবশ্য পরিবর্তন মানে দক্ষিণ দিককে উত্তরদিক বানিয়ে ফেলে, ব্যাপারটা মোটেও এরকম না। বরং সত্যিকারের উত্তরদিক আর চৌম্বকীয় উত্তরদিকের মধ্যে পার্থক্যটা সামান্যই।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কীসের আকর্ষণে চুম্বকের কাঁটা সবসময় উত্তরদিকে ঘুরে যায়? আমরা তো জানি, পৃথিবীর অভ্যন্তরে লোহার বিশাল ভাণ্ডার রয়েছে। এই লোহার অংশ চৌম্বকীয় ক্ষেত্র তৈরি করে। চৌম্বকীয় উত্তরমেরু হচ্ছে সেই স্থান, যেখানে এ চৌম্বকীয় আকর্ষণ সবচেয়ে বেশি। বর্তমানে চৌম্বকীয় উত্তরমেরু আর্কটিক মহাসাগরের কানাডিয়ান উপকূলে অবস্থিত।

পাশের ছবিটি লক্ষ করো। কী দেখতে পাচ্ছো? সত্যিকারের উত্তরদিক আর চৌম্বকীয় উত্তরদিক আসলে এক জায়গায় না। এ কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে চৌম্বকীয় উত্তরদিক ভিন্ন হয়। মজার বিষয় হচ্ছে, পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র কিন্তু প্রতিবছর একটু করে স্থান পরিবর্তন করে। এ কারণে প্রতিবছর চৌম্বকীয় উত্তরদিকও একটু করে পরিবর্তিত হয়। অবশ্য এ পরিবর্তন সুক্ষ্ম বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ছাড়া ধরা কঠিন।
কম্পাস প্রথমবারের মতো আবিষ্কৃত হয় চাইনিজদের দ্বারা, ২০৬ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে। সেসময় হান সভ্যতায় লোডস্টোন নামে একটি চৌম্বকীয় পাথর দ্বারা চাইনিজরা কম্পাস তৈরি করে। সেসময় তারা স্বর্গীয় প্রতীক হিসেবে দক্ষিণমুখী চামচ (South-Pointing Spoon) নামে একটি যন্ত্রাংশ ব্যবহার করতো, যা মূলত কম্পাসেরই আদিরূপ। পরবর্তীতে একাদশ শতাব্দীতে সং সভ্যতায় চাইনিজরা কম্পাসকে জাহাজে দিকনির্দেশক হিসেবে ব্যবহার করা শুরু করে। অর্থাৎ মাঝের হাজার বছর ধরে কম্পাস তার আসল কাজ- দিকনির্দেশনার কাজে ব্যবহারই হয়নি। শুধুমাত্র পবিত্রতার প্রতীক ও স্বর্গীয় চিহ্ন হিসেবেই রেখে দেয়া হয়েছিলো এ দারুণ আবিষ্কারটিকে। মজার না ব্যাপারটা?
তবে চাইনিজরা কম্পাসের আসল ব্যবহার শুরু করলেও তারা এটাকে উন্নত করতে পারেনি। তারা লোডস্টোন নামক পাথরকে পানিতে ভাসিয়ে তার দিকনির্দেশনা অনুসরণ করতো। বলাবাহুল্য, দিকনির্দেশনা সবসময় ঠিকমতো হতো না। পরবর্তীতে দ্বাদশ শতকে চাইনিজদের এ যন্ত্রটি মুসলিম বিজ্ঞানীদের চোখে পড়ে। মুসলিম বিজ্ঞানী এবং পরিব্রাজকেরা লোডস্টোনকে পিভট পয়েন্টের ওপর স্থাপন করে ব্যবহার করা শুরু করেন। ফলে কম্পাস আরও সুক্ষ্মভাবে দিক বুঝাতে সক্ষম হয় এবং আরও ব্যবহারকারীবান্ধব হয়ে ওঠে। এখনও কম্পাস মূলত এই মূল গঠনপ্রণালীতেই কাজ করে।
দ্বাদশ শতকের শেষদিকে কম্পাস ইউরোপে প্রবেশ করে। ইউরোপে কম্পাসের প্রবেশের মাধ্যমেই ইউরোপ নতুন এক যুগে প্রবেশ করে। আসছি সে বিষয়ে। পঞ্চদশ শতকে কম্পাসের আরও কিছু পরিবর্তন আসে। একটু আগে বলছিলাম পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে চৌম্বকীয় উত্তরদিক ভিন্ন হয়। পঞ্চদশ শতকের আগে কম্পাস এ সমস্যাটি সমাধান করতে পারতো না। ফলে নাবিকদের পড়তে হতো বিশাল ঝামেলায়। কিন্তু এ সময়ে এসে বিজ্ঞানীরা কম্পাসকে এমনভাবে ডিজাইন করেন, যেন স্থান পরিবর্তনের সাথে সাথে কম্পাসও চৌম্বকীয় উত্তরদিকের সাথে নিজেকে অ্যাডজাস্ট করে নিতে পারে। কম্পাসের ইতিহাসে এটি ছিলো আরেকটি বৈপ্লবিক সংযোজন। পরবর্তীতে উনবিংশ শতাব্দীতে তরলে-পূর্ণ কম্পাস আবিস্কৃত হয়, এবং হালআমলে এসে ডিজিটাল ও জিপিএস সিগন্যালসহ কম্পাস আবিস্কৃত হয়েছে।

বলছিলাম কম্পাসের মাধ্যমে ইউরোপের নতুন যুগে প্রবেশের কথা। যদি বলি, শুধু ইউরোপ নয়, বরং পুরো মানবসভ্যতাকেই কম্পাস পরিবর্তন করে ফেলেছে, তাহলে অবাক হবে? চলো, একটু ঘুরে আসি ইতিহাসের বাঁক থেকে।

আটলান্টিকের বাণিজ্যিক ত্রিভূজ

তোমরা ক্রিস্টোফার কলম্বাসের নাম সবাই শুনে থাকবে নিশ্চয়ই। হ্যাঁ, ইউরোপিয়ানদের মধ্যে তিনিই প্রথম আমেরিকা গিয়েছিলেন (আমরা জানি কলম্বাস আমেরিকা আবিস্কার করেছিলেন। কিন্তু কলম্বাসের বহু আগে থেকেই আমেরিকায় আদিবাসীরা বাস করতেন। ইউরোপীয়রা যেরকম মানুষ, সেই আদিবাসীরাও তেমনি মানুষই ছিলেন। সুতরাং নতুনভাবে আবিস্কারের কিছু নেই আসলে। আমরা সাধারণত ইউরোপীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ইতিহাস পড়ে থাকি বলে মনে হয় সবকিছুই ইউরোপীয়ানদের হাত ধরে হয়েছে। আদতে বিষয়গুলো মোটেও এরকম নয়)। তার সমূদ্রযাত্রার আগে ইউরোপের মানুষজন জানতোই না যে আমেরিকা নামে বিশাল ভূখণ্ড রয়েছে সমূদ্রের ওপারে, যা ইউরোপের থেকে বহুগুনে বড়। কলম্বাসের আমেরিকা গমণের মাধ্যমে ইউরোপ এক নতুন যুগে প্রবেশ করে। ইউরোপীয় নাবিকেরা ইউরোপের বিভিন্ন বন্দর থেকে জাহাজ নিয়ে বেরিয়ে পড়তো, এরপর আফ্রিকায় গিয়ে নিরীহ মানুষদের বন্দী করে আমেরিকায় গিয়ে সেখানে আগেই চলে যাওয়া ইউরোপীয়দের কাছে দাস হিসেবে বিক্রি করতো। এরপর আমেরিকা থেকে উৎপাদিত শস্য এবং মূল্যবান সামগ্রী নিয়ে আবার ইউরোপে ফিরে আসতো।
ভাস্কো-দা-গামার নাম আশা করি তোমরা শুনে থাকবে। তিনিই প্রথম আফ্রিকার পশ্চিমদিক দিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার উত্তমাশা অন্তরীপ (Cape of Good Hope) ঘুরে ভারতবর্ষে আসার রাস্তা আবিস্কার করেন। তার এ আবিস্কার ছিলো ইউরোপের কাছে স্বর্ণগুহার চাবি হাতে পাওয়ার মতো। এ নৌপথ আবিস্কারের মাধ্যমেই ইউরোপীয়রা ভারতবর্ষের সাথে বাণিজ্য শুরু করে। তবে তারা তো বাণিজ্যেই থেমে ছিলো না, শুরু হয় ক্ষমতার লড়াই। ভারতবর্ষসহ ভারত মহাসাগরের বিভিন্ন দ্বীপ-উপদ্বীপে উপনিবেশ স্থাপন করে ইউরোপীয়রা। একদিকে গরীব হতে থাকে এ দেশগুলো, অন্যদিকে সম্পদ পাচারের মাধ্যমে ফুলে-ফেঁপে উঠে ইউরোপের অর্থনীতি। আজকের আধুনিক ইউরোপের ভিত্তি তো মূলত প্রাচ্যকে লুটেপুটে খাওয়া আর আফ্রিকানদের ধরে নিয়ে গিয়ে দাস হিসেবে বিক্রি করার মতো দারুণ (!) লাভজনক ব্যবসার মাধ্যমেই শক্তিশালী হয়েছে।
ছিলাম কম্পাসে। বলো তো, যদি কম্পাস আবিস্কার না হতো, কিংবা ইউরোপের হাতে না পৌঁছাতো, তাহলে কী হতো? ইউরোপ হয়তো আজও থেকে যেতো অন্ধকারে। কিন্তু আফ্রিকা আর ভারতবর্ষ থাকতো অনেক বেশি সমৃদ্ধ। ০