মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি (রহ.)

তামান্না তারান্নুম

0
152

এক শিকারি পাখি শিকারের জন্য জাল বিছালো। আর সে জালে আটকে গেল এক চড়–ই পাখি। শিকারি পাখিটাকে ধরে ফেললো। তারপর পাখিটা বললো, হে মানব, তুমি গরু, ছাগল, হাস, মুরগি, কত কিছুই খেয়ে থাকো। ওই সবের তুলনায় আমার কি কোনো মূল্য আছে? অতি সামান্য গোস্ত আমার শরীরে, যা দিয়ে তোমার পেটের এক কোনাও ভরবে না। তার চেয়ে বরং আমাকে ছেড়ে দাও আমি তোমাকে ৩টি মহামুল্যবান উপদেশ দেবো, যা তোমার জীবনে অনেক উপকারে আসবে। ১ম উপদেশ দেবো তোমার হাতের মুঠোয় থাকা অবস্থায়। ২য় উপদেশ দেবো তোমার ঘরের দেয়ালে বসে। আর ৩য় উপদেশ দেবো গাছের ডালে গিয়ে বসে। শিকারির মনে কৌতুহল জাগলো এবং সে পাখির কথায় রাজি হলো। পাখিটি শিকারীকে বললো আমার ১ম উপদেশ, “যে জিনিস সম্ভব নয়, তা কখনো বিশ^াস করবে না”। এ কথা শুনে শিকারী পাখিটাকে ছেড়ে দিল। পাখিটি সামনের দেওয়ালের উপর গিয়ে বসলো এবং বললো আমার ২য় উপদেশ, “যে জিনিস হাতছাড়া হয়ে যায় তার জন্য কখনো দুঃখ করবে না।” এরপর পাখিটা বললো “হে শিকারি তুমি আমাকে ছেড়ে অনেক বড় ভুল করেছ, কেননা আমার পেটে এক পোয়া ওজনের খুব দামী একটা পরশ পাথর আছে। যদি তুমি আমাকে জবেহ করতে সে পাথর তুমি বিক্রি করে অনেক বড় ধনী হয়ে যেতে।
শিকারি সে কথা শুনেই আফসোস করা শুরু করে দিল আর বলতে লাগল, এই পাখিটাকে ছেড়ে দিয়ে আমি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল করেছি, যদি এ পাখিটাকে না ছাড়তাম তাহলে আমার জীবনের সব অভাব দূর হয়ে যেত।
এবার পাখিটা গাছের শাখায় গিয়ে বসে বসে শিকারীকে উদ্দেশ্য করে বলল, হে বোকা লোক, আমি এখনই তোমাকে যে দুটি উপদেশ দিয়েছি তা তুমি বেমালুম ভুলে গেলে? আমি আধা পোয়া ওজনের পাখি আমার পেটে এক পোয়া ওজনের দামি পরশ পাথর কিভাবে বহন করবো? এটা কি কখনো সম্ভব?
আর আমি তোমাকে ২য় উপদেশ দিয়েছি, যা হাতছাড়া হয়ে যায় তার জন্য আফসোস করো না। কিন্তু আমার ২য় উপদেশও তোমার কোনো উপকার করতে পারেনি। তুমি একটা বোকা, আর তুমি আমার ৩য় উপদেশ পাওয়ার উপযুক্ত নও। এই কথা বলে পাখিটা উড়ে চলে গেল, আর শিকারী পাখির কথাগুলি ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে গেল।
বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই ইরানের বিখ্যাত কবি মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমির লেখা এই গল্পটি শুনে থাকবে। জালাল উদ্দিন রুমি ছিলেন একজন কবি, লেখক, পর্যটক ও দার্শনিক। তিনি তার জীবনের এক বিশাল অংশ পার করেছেন বিভিন্ন দেশ ও নানা স্থান ভ্রমণ করে। মাওলানা রুমি সবসময় দুর্লভ বস্তুর পেছনে ছুটেছেন। তিনি তার সুদীর্ঘ এই ভ্রমণ জীবনের দর্শনলব্ধ জ্ঞান, গল্পের মাধ্যমে অত্যন্ত সুন্দর ও সহজ ভাষায় ফুটিয়ে তুলেছেন। গল্পগুলোর চরিত্র কাল্পনিক। তবে এ গল্পগুলোর মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে নৈতিকতা, আধ্যাত্মিকতা এবং বাস্তবধর্মী শিক্ষা। প্রায় আটশত বছর আগেকার এ গল্পগুলোতে আজও লেগে আছে আধুনিকতার ছোঁয়া। মাওলানার এ গল্পগুলো একত্রিত হয়েছে মসনবী নামক গল্পগ্রন্থে।
মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি। যিনি জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ রুমি, জালাল উদ্দিন বলখী, মাওলানা রুমি, মৌলভি রুমি এবং শুধু রুমি নামেও পরিচিত ছিলেন। তিনি একাধারে ছিলেন কবি, আইনজ্ঞ, ইসলামি ব্যক্তিত্ব, ধর্মতাত্তি¡ক এবং সূফী। মাওলানা রুমির প্রভাব দেশের সীমানা এবং জাতিগত পরিমÐল ছাড়িয়ে বিশ্বদরবারে ছড়িয়ে পড়েছে। ফার্সি, তাজিক, তুর্কি, গ্রিক, পশতুন, মধ্য এশিয়া এবং দক্ষিণ এশিয়ার মুসলমানরা বিগত সাত শতক ধরে বেশ ভালভাবেই তার আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকারকে যথাযথভাবে সমাদৃত করে আসছে। মহান এই কবির কবিতা সারাবিশ্বে ব্যাপকভাবে সাড়া পড়েছিলো। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং তাঁর বই সর্বাধিক বিক্রিত ছিলো। মাওলানা রুমির সৃষ্টি অনেক সাহিত্যকর্মের মধ্যে ফি-মা-ফি, মজলিশে সভা, মাকাতিব, মাতনাওয়ে মানাউয়ি এবং দেওয়ান-এ-কবির উল্লেখযোগ্য। মাওলানার মাতনাওয়ে মানাউয়ি এবং দেওয়ান-এ-কবির কাব্যকে দুটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়, চতুষ্পদী শ্লোক ধর্মউপদেশ এবং গজল। গদ্যসমূহকে ভাগ করা হয় প্রবন্ধ, এবং পত্রসাহিত্যে। তাঁর এ সাহিত্যকর্ম ফার্সি ছাড়াও বাংলা, আরবি, তুর্কি, গ্রিক এবং ইরানী সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে।
মাওলানা রুমির সাহিত্যকর্মের ধরণ ছিলো ভিন্ন প্রকৃতির। তিনি ছিলেন স্বভাব কবি। তিনি অনায়াসে যেকোনো সময় গজল রচনা করতে পারতেন। তাঁর ছাত্রগণ তা সংরক্ষণ করতেন। রুমি তার জীবনে একজন বিশ্বস্ত বন্ধুর খোঁজ পান, যিনি তার লেখালেখিতে সাহায্য করতেন। তিনি ছিলেন সালাউদ্দিন-ই জারকুব, পেশায় যিনি ছিলেন একজন স্বর্ণকার। সালাউদ্দিন এর মৃত্যুর পর মাওলানা রুমির কেরাণী এবং প্রিয় ছাত্র হুসাম-এ চালাবি মাওলানার সঙ্গীর ভ‚মিকা পালন করেন। একদিন তারা কুনিয়ার বাইরে একটি আঙুরক্ষেতে ঘোরাঘুরি করছিলেন। তখন হুসাম মাওলানা রুমিকে একটা ধারণা বললেন, “যদি আপনি একটি বই লেখেন যেমন সানাই এর ‘এলাহিনামা’ বা আত্তার এর ‘মাতিক উত-তাইর’ বইয়ের মত, যেটি অনেকের সঙ্গ দেবে। তারা আপনার এই বই পড়ে মজা পাবে এবং সঙ্গীত রচনাও শিখতে পারবে।” তিনি মুচকি হাসলেন এবং এক টুকরো কাগজ বের করে তাঁর ‘মসনবী’ গ্রন্থের প্রথম আঠারো লাইন লিখে শেষ করলেন।
হুসাম মাওলানা রুমিকে মিনতি করতে লাগলেন আরো লেখার জন্য। মাওলানা তার পরের বারটি বছর আনাতোলিয়ায় তার বিখ্যাত ‘মসনবী’ বই এর ছয়টি খÐের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। ১২৭৩ সালের ডিসেম্বর এ মাওলানা যখন অসুস্থবোধ করতে লাগলেন তখন তিনি অত্যন্ত সুন্দর একটি গান রচনা করেন, যেটির মাধ্যমে তিনি সর্বমহলে আধ্যাত্মিকতার জন্য খ্যাতি লাভ করেন।
“কিভাবে জানব কোন ধরণের রাজা আমার মধ্যে আছে আমার সহচর হিসাবে? আমার উজ্জ্বল মুখে দৃষ্টি দিও না আমার থেমে যাওয়া পা-গুলোর জন্য।”
৩০ সেপ্টেম্বর ১২০৭ সালে আফগানিস্থানের বলখে জন্ম নেওয়া এই মহামানব ১৭ ডিসেম্বর ১২৭৩ সালে কুনিয়াতে মারা যান। মাওলানাকে তাঁর পিতার কবরের কাছে সমাহিত করা হয় যেটি “ইয়াসিল তুর্ব” বা মাওলানা মিউজিয়াম নামে পরিচিত। তাঁর সমাধিফলকে লেখা আছে তার শেষ ইচ্ছাটি, “যখন আমি মৃত, পৃথিবীতে আমার সমাধি না খুঁজে আমাকে মানুষের হৃদয়ে খুঁজে নাও।” সত্যিই তিনি আজও অমর হয়ে আছেন তাঁর সৃষ্টিকর্মে। স্মরণীয় হয়ে আছেন মানুষের হৃদয়ে।
মাওলানার জীবনের সেরা উক্তি, “গতকাল আমি বুদ্ধিমান ছিলাম তাই পৃথিবীটাকে বদলে দিতে চেয়েছিলাম। আজ আমি জ্ঞানী, তাই নিজেকে বদলে ফেলতে চাই।” হ্যাঁ, তিনি জ্ঞানী এবং বুদ্ধিমান ছিলেন। তাইতো জীবিত অবস্থায় ¯্রষ্টার গুণগান করে জীবন সাজিয়েছেন। আর মৃত্যুর পর স্মরণীয় হয়ে আছেন গোটা বিশ্বে। ইউনেস্কো ২০০৭ সালকে ঘোষণা দেয় ‘আন্তর্জাতিক রুমি বর্ষ’ এবং ‘শান্তিতে মানুষের মন গঠনের’ লক্ষ্যে ইউনেস্কো কার্যনির্বাহী সমিতির সভা ডাকেন। সভায় আফগানিস্তান, ইরান এবং তুরস্ক থেকে এই শান্তি মিশনের স্থায়ী প্রতিনিধি প্রস্তাব করা হয় এবং অনুমোদন দেয়া হয়। ইউনেস্কো এর মধ্যে ৬ সেপ্টেম্বর ২০০৭ এ ‘রুমি স্মৃতিরক্ষা উৎসব’ পালন করে এবং মাওলানা রুমির চিন্তা, গবেষণা, ও তাঁর আদর্শ প্রচারের জন্য ‘মাওলানা রুমি স্বর্ণপদক’ ঘোষণা করে।