পুরানো কেদারা

সানজিদা আকতার আইরিন

0
73

জোনাব আলীর ছয় পুরুষের জমিদারির চিহ্ন বহন করা চেয়ারটি তার বসার ঘরের কোণে যতেœ সাজিয়ে রেখে দিয়েছিলেন। জমিদারি না থাকলেও ওই চেয়ার টি তাদের ঐতিহ্যের সাক্ষী। তার বাবা মোতাহের আলীর মুখে তার পিতামহ যোহর আলীর জমিদারির শেষ পুরুষের গল্প শুনেছিল। ব্রিটিশবিরোধী দলের সাথে যোগসুত্র থাকায় নানা ছলে বলে তাদের দীর্ঘ দিনের জমিদারি নিলামে উঠায় তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার। যোহর আলীর পিতামহ জমিদার মেহেতা আলী খুব বিলাসী ছিলেন। তার বৈঠক খানায় বসার আসনটি আসাম থেকে আনা কাঠের তৈরি। যা যোহর আলীর পূর্বপুরুষের জমিদারি চিহ্ন। যার ময়ূর পূচ্ছ নকশা দেখে বিলাসী জমিদারের রুচির পরিচয় মিলতো। মখমলের ঝকঝকে গদির নীলাভ রঙে দুধে আলতা বরণের রাসভারী জমিদার মেহেতাকে অসম্ভব জৌলুশপূর্ণ মনে হতো। তার সে সৌন্দর্যের ও রুচির বর্র্ণনা তখন মুখে মুখে ফিরত। তার পরবর্তী তিন পুরুষও ওই চেয়ারের কদর রেখেছে। জমিদারিপ্রথা শেষ হতেই ওই চেয়ারের প্রয়োজন ফুরায়। তবুও জোনাব আলীর কাছে তার কদর ছিল খুব। তাদের বাড়িতে যখনই কোনো মেহমান আসে সেই চেয়ার নিয়ে আলোচনা হয়। তাদের পুর্বপুরুষ কোন জমিদার এই চেয়ারে বসে কী করে সভা চালাতেন, কী কী বিচার করতেন এসব গল্পের পসরা খুলে বসতেন। যতেœ সাজানো চেয়ারটিই ছিল তার বড় অহঙ্কারের। এতে জোনাব আলীর জমিদারি হারানোর গøানি কিছুটা কমতো। মনে মনে কতবার নিজেকে জমিদার রূপে সাজিয়ে তিনি ওই চেয়ারে বসিয়েছেন তার ঠিক নেই। জোনাব আলীর মৃত্যুর পর তার ছেলে নাদের আলীও এ চেয়ারটিকে যতেœ রেখেছেন। কিন্তু অনেক বয়স হয়েছে বলে চেয়ারটির নক্সাগুলো খুলে খুলে যাচ্ছে। বহুবার এটি মেরামত করতে খরচ হয়েছে অনেক। ইদানীং মাথা থেকে ওটি মেরামতের ইচ্ছা বাদ দিয়েছেন তিনি। তাই সেটি আর বসার ঘরে জায়গা হয় না। এটি এখন শোবার ঘোরের কোণে ঠাঁই পেয়েছে। চাকরি থেকে অবসর নেয়া নাদের আলী অনেকবার চেয়ারটির পেছনে অনেক খরচ করে এখন আর শুধু শুধু পয়সা অপচয় করতে ভালো লাগে না। পুরানো একটা চেয়ারের জন্য মেরামতে আগের মতো অত খরচ করা তার জন্য একটা বিলাসিতা মাত্র। বর্তমানে ঐতিহ্যর চেয়ে পয়সার মূল্য অনেক বেশি। নাদের আলীর ছেলে পরম এখন এই পুরানো চেয়ারটি একেবারেই সহ্য করতে পারে না। তার মতে এই চেয়ারটি একটা বাড়তি ঝামেলা। ওটা ফেলে দিলেই ঘর পরিস্কার হয়। ওসব ঐতিহ্য টৈতিহ্য ধুয়ে পানি খেলে পেট ভরে না। অনেক কষ্ট করে চাকরি করে ফ্ল্যাট কিনেছেন। কত নিত্য নতুন ডিজাইনের জিনিসপত্র দিয়ে সাজানো ঘর। ওসব বাজে আসবাব ঘরে রাখার দরকার নেই। অবশেষে নাদের আলীর ইচ্ছার বিরুদ্ধেই ওই ভাঙা চেয়ারটির যায়গা হয় ঘরের কাজের মেয়ে ফুলির মার বাড়ি।
ফুলির মার এক কামড়ার ঘরে একটা তক্তা বিছানো খাট এর পাশে চেয়ারটির আপাতত ঠাঁই হয়। খাটের বাইরে একটু বসার জায়গা হয়েছে এটা অনেকবড় ব্যাপার। ফুলির বাবা রিকশা চালক চানমিয়া পান খেতে খেতে আঙুলের চুন মোছার একটা ঠিক ঠাক যায়গা এতদিনে খুঁজে পেল। একদিন যে চেয়ারে বসে জমিদার বিচারে বসতেন আজতার গায়ে ঝোলে ফুলির বাপের রিকশা টানার ঘামে ভেজা ছেড়া গামছা। যে চেয়ারে একদিন সুগন্ধি মাখাচাদর গায়ে জমিদার বসতেন এখন সময় শেষে বস্তির যে কেউ বসে। তাতে কারো কিছু বলার নেই। চেয়ারের এক পা অনেকটা ভেঙে গেছে তাই বাঁশের টুকরা দিয়ে ভাঙা পা জোড়া লাগানো হয়েছে। এর বসার গদি তো কবেই ফুটোফাটা হয়েছে। তার ওপরে ছেড়া কাঁথার ভাঁজে ভাঁজে এখন ছারপোকার আবাস। মিনিট দু-এক বসার পর তাদের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় খুব সহজে। মাটির ঘরের এঁদোগন্ধ মাখা স্যাঁতসেঁতে গুমোট ঘরে চেয়ারটির অবস্থা খুব করুণ। ফুলির বাবা এখন আর রিকশা চালায় না বস্তির বাইরে একটা পানের দোকান দিয়ে তার সংসার চলে। রাস্তার পাশের দোকানের বিক্রি ভালো। একটা ছাতা লাঠির মাথায় বেঁধে তার নিচে ভাংগা চেয়ারটি বসিয়ে সামনে একটা প্লাস্টিকের মোড়ার ওপর প্লাস্টিকের ঝুড়িতে পান সাজিয়ে আজকাল তার ভালোই রোজগার হয়। চেয়ারটির হাতলগুলো খুব নরবড়ে হয়ে যাওয়ায় সুতলি দিয়ে ঠ্যাঙের সাথে শক্ত করে বেঁধে দেয়া হয়েছে। এর বসার কাঁথাটি ও চেয়ারের সাথে সুতা দিয়ে বাঁধা।
করিম গাজি এপাড়ার একজন স্বনামধন্য বড় ব্যবসায়ী। তার গাড়ি, বাড়ি সবই আছে। অ্যান্টিক জিনিসের প্রতি তার ভীষণ আকর্ষণ। তার ঘরে নানান পুরানো জিনিসে ঠাসা। কোথাও কয়েক বছরের পুরানো জিনিস দেখলেই তার খোঁজে নেমে পড়েন তিনি। হাঠাৎ দোকানে পান খেতে গিয়ে চেয়ারটি তার নজরে আসে।
এই ভাঙাচুরা চেয়ারটির দাম দু’হাজার পেয়ে মহানন্দে চেয়ারটির দাবি ছেড়ে দিলো ফুলির বাবা চান মিয়া। আবার চেয়ারটির নতুন দখল দার করিম গাজি দামি মিস্ত্রি লাগিয়ে অনেক পয়সা খরচ করে চেয়ারটিকে পুরানো চেহারায় ফিরিয়ে এনেছে। সেই জৌলুশ ঝরে পড়ে তার সর্বাঙ্গে। করিম গাজি চেয়ারের তথ্য সংগ্রহে নেমে পড়েন। ফুলির মায়ের সুত্র ধরে প্রথমে পরমের কাছে যায়। ব্যাস্ত পরম এ ব্যাপারে তেমন আগ্রহ না দেখিয়ে নিজের সময় বাঁচিয়ে নেয়। কিন্তু করিম গাজির বার বার বিরক্তিতে তার বাবা নাদের আলীর সাথে করিম গাজির সাক্ষাত করিয়ে দেন। নাদের আলী অবাক হয়ে যান। তার পুর্বপুরুষের চিহ্ন সামান্য একটা চেয়ারের ইতিহাস জানতে চান এই লোকটা? অথচ তারা তো এই চেয়ারটি ফেলেই দিয়েছেন। চোখের পানি লুকিয়ে বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে করিম গাজির কী জানার আছে সেটা জানতে চান?
ল্যাবরেটরি পরীক্ষার পর চেয়ারটির বয়স পাওয়া যায় দুইশত বাইশ বছর। করিম গাজির সংগ্রহের মধ্যে এটাই সবচেয়ে বেশি পুরনো জিনিস। তার বহু দিনের ইচ্ছা এসব পুরনো জিনিসপত্র দিয়ে একটা নিলাম অনুষ্ঠানের আয়োজন করবেন। অনেক রাষ্ট্রীয় নিয়মকানুনের মাধ্যমে তার সংগ্রহগুলো নিলামের ব্যবস্থা করা হয়। অনেক দেশি-বিদেশি মেহমান সেখানে থাকবেন। থাকবেন ঢাকার জেলা প্রসাশকও। অতন্ত্র পুলিশ পাহারায় আয়োজনটি করা হয়। মোট আয়োজনে ৩২১টি পণ্য নিলাম করা হবে। যার মধ্যে ওই চেয়ার একটা বিশেষ আকর্ষণ।
নিলামের ফিচার দেখে একজন ব্রিটিশ নাগরিক জন এলান যিনি বাংলাদেশ দূতাবাসে চাকরি করেন, তিনিও উপস্থিত ছিলেন। তারও আগ্রহ ওই চেয়ার নিয়ে। এলানের কোনো এক পুর্বপুরুষ ওই চেয়ারে বসা এক জমিদারের সাথে তোলা ছবি ঘরে বাঁধিয়ে রেখেছেন। যিনি তৎকালীন ব্রিটিশ পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিলেন যার নিয়োগ ছিল ভারতে। নিলাম শেষে জন এলান বাংলাদেশী নয় কোটি পঁচাত্তর লাখ টাকায় চেয়ার কিনে নেন। রাষ্ট্রের সকল নিয়মকানুন পালন করে তিনি চেয়ার টি তার দেশে নিয়ে যাবেন।
চেয়ারটির মূল্য ও এর ঐতিহ্য নিয়ে সকল পত্রিকা ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রতিবেদন করা হয়। সারা দেশে আলোচনার ঝড় ওঠে। বিশেষ করে কোনো ব্রিটিশ নাগরিক এটি কিনেছে বলে। এই আলোচনার আঁচ লাগে নাদের আলীর গায়ে। টিভি, পত্রপত্রিকার খবর আর চেয়ারের ছবি দেখে নাদের আলীর বৃদ্ধ চোখে জেগে ওঠে হারানোর বেদনা। যা ছিল তার বাবা জোনাব আলীর চোখে। জোনাব আলী কাতর ছিলেন জমিদারি হারানোর ব্যাথায়, আর নাদের আলী আজ কাতর হয়েছেন ফেলে দেয়া চেয়ারের ব্যাথায়। অশ্রæসিক্ত নয়নে বার বার টিভির চ্যানেল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খবরটি দেখেন। পরের দিন কয়েকটি পত্রিকার কাটিং রেখে দেন বিছানার নিচে। ছেলে পরমের প্রতি রাগটা প্রকাশ হয় দু’বেলা অন্য ত্যাগের মাধ্যমে।
পরম আজ বুঝতে পারলো ঐতিহ্য ব্যাপারটা কী। লজ্জায় অনুতাপে কুঁকড়ে গেছে সে। যে ঐতিহ্যকে পায়ে দলে তার নিজের নামের আলী অংশটুকু বাদ দিয়ে সে পরম আলী থেকে পরম সাহেব হয়েছেন তার চেয়ে পরম আলী নামটা অনেক বেশি মূল্যবান।
সারা জীবনের অর্জন সুন্দর ফ্ল্যাট আর উচ্চ মানের চাকরির মর্জাদার চেয়েও ওই ভাঙা চেয়ারের মর্জাদা অনেক বেশি আজ হাড়ে হাড়ে পরম বুঝল পরম। পিতামহ জোনাব আলী আর পিতা নাদের আলীর ম তো অনুতাপ করা ছাড়া তার এখন আর কিছুই করার নেই। বাবার সামনে মুখ দেখানোর উপায়টুকুও তার রইল না। এতদিনের আধুনিকতার মিথ্যে দেমাগ দুমড়ে মুচড়ে গুঁড়িয়ে গেল তার সেকালের ঐতিহ্যের কাছে। সময় থাকতে যার মর্যাদা বুঝতে পারেনি সে।