এক স্মৃতিময় দিন

মোস্তফা আবরার রাইয়ান

0
174

পড়ার টেবিলে বসে ঝিমুচ্ছি। এমন সময় বাবা এলেন। বললেন, ঘুমটা বোধহয় একটু বেশিই পাচ্ছে তাই তো? আচ্ছা একটা গল্প বলি ঘুম কেটে যাবে। গল্পের কথা শুনে আগ্রহ নিয়ে আড়ামোড়া ভেঙে বসলাম। বাবা গল্প শুরু করলেনÑ
১৯৭১। মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়। চাচা তখন সিলেট ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরিতে চাকরি করতেন। সেই সূত্রে পরিবার নিয়ে সেখানেই
থাকতেন। পরিবার বলতে তাঁর দুটো ছোট মেয়ে আর চাচী। আমি বেড়াতে যাই তাঁর বাসায়। যুদ্ধের এক সকালে আমরা খাবার টেবিলে বসি। বসা মাত্রই শুনতে পাই পাকিস্তানি মিলিটারিরা চারদিক থেকে পুরো এলাকা ঘিরে ফেলেছে। খবর শুনে আমরা খাওয়ার কথাই ভুলে যাই। চাচী কিছু শুকনো চিড়ে মুড়ি নিয়ে নিলেন ব্যাগে। এরপর প্রাণের ভয়ে সবাই লুকিয়ে পড়ি ফ্যাক্টরির
আন্ডারগ্রাউন্ডে। সেখানে বেশ কয়েকটি অফিসারের পরিবারও আসে। যেহেতু মিল কারখানা বন্ধ বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস সংযোগ কিছুই নেই। সবার চোখে মুখে এক চাপা
ভীতির ছাপ। কেউ কোনো শব্দ করছে না। নিঃশব্দে অন্ধকারে বসে রইল। এভাবে সারাদিন কেটে গেল। কারো কোনো খাওয়া-দাওয়াও নেই। সেই শুকনো মুড়ি সবাই ভাগ করে চিবুচ্ছে। বিপদ বাঁধালো ছোট বাচ্চারা। তাদের কান্নায় অস্থির করে তুলল সবাইকে। একসময় সবাই সিদ্ধান্ত নিলো মরলে মরবে কিন্তু এভাবে আর কতক্ষণ। সন্ধ্যা নাগাদ সবাই বেরিয়ে পড়ে। একজনের পেছনে একজন করে আসছে। আমার কোলে ছোট্ট চাচাতো বোনটি। হঠাৎ গোলাগুলির আওয়াজ! প্রাণের ভয়ে আবার পেছনে ছুটি। দৌড়তে গিয়ে আমার কোলের বোনটিসহ রাস্তার পাশের শুকনো নালায় পড়ে যাই। অতি কষ্টে উঠে আবার দৌড়। গোলাগুলি কিছুটা থামলে আমরা কোয়ার্টারের দিকে রওনা হই। বাসায় এসে ক্লান্তিতে না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়ি সবাই। পরদিন সকালে যখন ঘুম থেকে উঠে দেখি সর্বনাশ! কোয়ার্টারের সামনে সকল অফিসার ও কর্মচারীদের সারি বেঁধে দাঁড় করিয়ে রেখেছে পাকিস্তানি মিলিটারিরা।

আমি তখন ছাত্র। পরীক্ষা মিস হওয়ার ভয়ে চাচী আমাকে লুকিয়ে রাখলেন। সারিতে যাদের দাঁড় করানো ছিল তাদের মধ্যে
একজন পাকিস্তানি লোক ছিলেন যার নাম ছিল আলী। তিনি ছাতক ফ্যাক্টরির ম্যানেজার। মিলিটারিদের তিনি বললেন তাঁকে ক্যাপ্টেনের কাছে নিয়ে যেতে। মিলিটারিরা প্রথমে একটু গড়িমসি করলেও শেষ পর্যন্ত তাঁর অনুরোধে নিয়ে গেল। যখন ক্যাপ্টেনের কাছে আলীকে নিয়ে গেল, তখন সে তার নিজের পরিচয় দিয়ে বলল, আমি একজন পাকিস্তানি এবং এই কোম্পানির ও ম্যানেজার। এ কথা শুনে ক্যাপ্টেন তাকেসহ বাকি সবাইকে ছেড়ে দিলো। সেবারের মত সকলে আল্লাহর অশেষ রহমতে প্রাণে বেঁচে যাই। তবে আমাদের কাছে দিনটি ছিল ভীষণ আতঙ্কের। আজো সে দিনটার কথা মনে উঠলে আমি কেমন যেন শিউরে উঠি।
দশম শ্রেণি, চকরিয়া আল-ইয়ামিন মডেল মাদ্রাসা কক্সবাজার।