সিংহের শক্তি পরীক্ষা

হাসান হাফিজ

0
20

সিংহের অনেক সাহস। তার গায়ে শক্তিও প্রচণ্ড। বড় বড় প্রাণীকে খুব সহজেই ঘায়েল করতে পারে সে। সবাই ভয় পায় তাকে। কিন্তু তার মধ্যেও কথা আছে। শিকার করতে গেলে তাকে যে কোনো বাঁধাই পেতে হয় না, তা নয়। আক্রান্ত হয় যে প্রাণী, সে তার সাধ্যমতো জীবন বাঁচানোর জন্যে লড়াই করে। সিংহকে সেও আক্রমণ করে। জান বাঁচানোর সেই তীব্র লড়াই দেখবার মতো ঘটনা। জীবন পণ করে লড়ে যায় শিকার। কিন্তু ফল কী হয়? অসহায় প্রাণীটিকে হার মেনে সিংহের পেটে চলে যেতে হয় শেষ পর্যন্ত। ওই ঝাপটাঝাপটিই সার। সিংহের কাছে পরাজয় স্বীকার না করে কোনো উপায় নেই। শিকার যে খুব সহজে কাবু করে ফেলতে পারে, এই কারণে সিংহের মনে ভারি অহঙ্কার। এতই গর্ব যে, মাটিতে মনে হয় পা পড়ে না। বনের কোনো প্রাণীকেই সে গ্রাহ্য করে না। তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে সব সময়।
এক দিন সিংহের অদ্ভুত একটা কথা মনে হলো। সে ভাবলো, আমার মতো প্রবল শক্তি তো এই দুনিয়ায় আর কারো নেই। কেউ আমার পাশে দাঁড়ানোর পর্যন্ত সাহস রাখে না। আমি যেহেতু এত বেশি শক্তিমান, অতএব এই বনের আমিই হলাম রাজা। বাকি সবাই আমার প্রজা। আমার হুকুমে তাদের চলতে হবে। আমি যা চাইবো, সেটাই হবে আইন। আমি যা যা বলবো, তা মানতে হবে সবাইকে। না হলে চরম শাস্তি। এই নিয়মের কোনো নড়চড় হতে দেওয়া চলবে না। ধীরে ধীরে আমার বশ্যতা মেনে নিতে হবে বনের সকলকে।
আরও ভাবছে সিংহ, আমার শক্তি সাহস এবং শিকার কুপোকাত করার কৌশল অন্য কারো জানা নেই। আমাকে পরাস্ত করতে পারে, এমন কোনো জীবজন্তু এই দুনিয়ায় এখনো পর্যন্ত জন্মায়নি। এক কাজ করলে কেমন হয়? শক্তি আমার কতটা আছে, তা পরীক্ষা করে দেখা দরকার। যাচাই করার পর আমার আত্মবিশ্বাস আরো বাড়বে। রাজত্বও মজবুত হবে। আচ্ছা বেশ, তাই করা যাক। বনের অন্যসব জীবজন্তু আমার শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে কতটুকু জানে, সেটাও এই সুযোগে পরীক্ষা করে দেখা যাবে। হাজার হোক, আমি হচ্ছি এই বনের রাজা। প্রজারা তাদের রাজাকে কতটা মান্যিগণ্যি করছে, তোয়াজ প্রশংসা করছে, সেটাও তো জানার দরকার আছে।
সেই দিনই সিংহ বেরিয়ে পড়লো অন্যরকম এই অভিযানে। আপন গুহা ছেড়ে নেমে পড়লো পথে। পুরো বন এবং আশেপাশের এলাকা আজ ঘুরেফিরে দেখবার ইচ্ছা তার। প্রজারা কোন হালে আছে, তাদের ভালোমন্দ বিষয়েও জানতে হবে। কে তাকে কতটা শ্রদ্ধা ভক্তি করে— এই সুযোগে সেটাও জেনে নেওয়া হবে। এক ঢিলে দুই পাখি মারা যাকে বলে।
ফুরফুরে মনে পথ চলছে সিংহ। ঝোপজঙ্গলের মধ্যিখান দিয়ে পথ। রাজা গম্ভীর মুখে দুলকি চালে এগিয়ে চলেছে। প্রবল বিক্রমে। পা ফেলছে দুম দুম করে। দাপটে কেঁপে উঠছে মাটি। শুরুতেই দেখা হলো হোঁৎকামুখো এক বানরের সঙ্গে। পাকা কলা খেতে খেতে দুষ্টু বানর সর্দার হুটোপাটি করছিল তার সঙ্গীদের নিয়ে। সিংহ আসছে দেখে তারা ঝটপট খেলাধুলা বন্ধ করে দেয়। কাঁচুমাচু করে দাঁড়িয়ে পড়ে সবাই। ওরা ভাবে, এই দানবের সঙ্গে কোনো বেয়াদবি করা ঠিক হবে না। সিংহ রেগে গেলে মহা সর্বনাশ। ঘাড় মটকে রক্ত চুষে খাবে। কেউ বাঁচাতে পারবে না তার কবল থেকে। সিংহ জিগ্যেস করে বানর সর্দারকে,
‘হুম, তা তোমরা সব কেমন আছো বলো। বনের হালচাল কী? একটা কথা আমায় তোমরা বলো তো দেখি, এই বনের রাজা আসলে কে?’
বানর সর্দার বড্ড চালাক। মুহূর্তেই সে বুঝে নেয় সিংহের মতলব। অনুগত প্রজার মতো কুর্নিশ করে বিনয়ে গদগদ হয়ে বলে,
‘মহারাজ, আপনি। অন্য আর কারো তেমন যোগ্যতা নেই। রাজা হওয়া কি সবার পক্ষে মানায়? নিশ্চয়ই না। আপনার মতো শক্তি ও সাহস, তেজ এই বনের আর কারোই নেই। এই জঙ্গলের সব প্রাণীর দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হলেন গিয়ে আপনি। জয় হোক আপনার।’
সিংহ মনে মনে আনন্দে আটখানা। দাঁত বের করে হাসে। মনটা তার জুড়িয়ে যায় বানর সর্দারের এমনধারা মধুর বচন শুনে। হ্যাঁ, তার প্রশ্নের উপযুক্ত উত্তরই বটে। এমন উত্তরই তো আশা করা গিয়েছিল। সিংহ মনে মনে আরও বেশি গর্বিত বোধ করে। বুকটা তার শান্তিতে ভরে যায়। নাহ, সন্দেহের কোনো কারণ নেই। তার প্রভুত্ব, কর্তৃত্ব সব ঠিকঠাকই আছে। কারো কাছে কোনো প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়নি এ পর্যন্ত। বানর সর্দার তো অকপটেই রাজবন্দনা করলো। বানরদলকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বিদায় নেয় সিংহ।
যেতে যেতে যেতে দেখা হয়ে যায় হায়েনার সঙ্গে। এই প্রাণীটি বড়ো ধূর্ত। হিংস্রও বটে। সিংহ তাকেও একই প্রশ্ন করে। হায়েনা মোটেও বোকা নয়। কোন কথার কী অর্থ, সেটা তার ভালোই জানা। সিংহের প্রতি শ্রদ্ধা ভক্তিতে গলে গলে যায় যেন। মাথা নিচু করে মহারাজকে অভিবাদন জানায় সসম্ভ্রমে। বনের সম্রাটের কুশল কামনা করে বলে,
‘হ্যাঁ, প্রভু। আপনিই হচ্ছেন আমাদের এই বনের মহারাজা। আপনার রাজত্বে আমরা খুব সুখে শান্তিতে মহা আরামে বসবাস করে আসছি। কারো কোনো অসুবিধা নেই। অভিযোগ নেই। আপনাকে রাজা হিসেবে পেয়ে আমরা ধন্য।’
সিংহ আরও শান্তি পায় মনে। যা সে ভেবেছিল, তা ঠিকই আছে। কোনো সমস্যা হয়নি। তবে কি না, আরও যাচাই করে দেখতে হবে। শুধু বানর আর হায়েনার মত দিয়ে বনের সকলের চিন্তাভাবনা জানা যাবে না। আরো কয়েকজনকে জিগ্যেস করে দেখতে হবে।
পথ চলতে চলতে এসব কথাই ভাবছিল সিংহ। দুলকি চালে হাঁটতে হাঁটতে দেখা হয় হাতির সঙ্গে। বিশাল বপু এই হাতির। বিরাট একখানা কলাগাছ উপড়ে নিয়ে শাহী ভোজে ব্যস্ত ছিল হাতি। গায়ে গতরে সে বিশাল। শরীরের ওজনও তার অনেক। হাতিকে ভয় পায় বনের সবাই। সিংহ মনে মনে বলে, দেখি তো এই ব্যাটা কী বলে! জেনেই দেখি না কেন- রাজা মহারাজা সম্পর্কে তার চিন্তা ভাবনাটা আসলেই কেমন! ওর আনুগত্য যদি পাই, তাহলে আর কোনো খটকা থাকবে না মনে। ও যদি আমাকে মহারাজা হিসেবে মেনে নেয়, তাহলে অভিযান আজকের মতো শেষ করা যায়। অন্য দুই প্রজার মনোভাব তো এরই মধ্যে জানা গেছে।
সিংহ ঝটপট শুধায় হাতিকে,
‘ওহে হাতি, একটা প্রশ্ন ছিল তোমার কাছে। বলো তো দেখি, এই বনের মহারাজা আসলেই কে?’
সিংহ তার কথা শেষও করতে পারেনি- তেড়ে আসে হাতি। শুঁড় দিয়ে চ্যাংদোলা করে শূন্যে ছুঁড়ে দেয় সিংহকে। ব্যাটা নচ্ছার! নাশতাটাও আরামে খাওয়া যাচ্ছে না এর উৎপাতে। যত্তসব উটকো ঝামেলা। হাতি সিংহকে সজোরে ছুঁড়ে মারে অদূরে একটা কাঁটাঝোপের ওপর। একটু পর এসে শুঁড় দিয়ে আবারও তুলে দিল প্রচণ্ড এক আছাড়।
সিংহ হতভম্ব। এ কী হলো! এমন অভাবিত, বিশ্রী একটা কাণ্ড ঘটে যাবে, সে কল্পনাও করেনি। এ যে বিনা মেঘে বজ্রপাত। এমন ভয়াবহ, নির্মম পরিণতির জন্যে সে মোটেও তৈরি ছিল না। হাতির লাঞ্ছনায় আর মারধোরে মেজাজটাই গেল খিঁচড়ে। রাজা হওয়ার সাধ জন্মের মতো মিটে গেল সিংহের। দ্বিতীয় আছাড় খেয়ে বড্ড নাকাল হতে হলো। পেটের নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে যাওয়ার জোগাড়। বাপ রে! এ কার পাল্লায় এসে পড়লাম? এখন দেখা যাচ্ছে জান নিয়েই টানাটানি।
বহু কষ্টে নিজেকে মুক্ত করতে সক্ষম হলো সিংহ। হাতিটা যেন প্রকাণ্ড এক যমদূত। ওর শুঁড়ের ভয়ঙ্কর ঝাপটা, গোদা পায়ের এ্যায়সা লাথি জীবনেও ভোলার মতো না। আর একটু হলে ভর্তা হয়ে যেতে হতো। প্রাণ নিয়ে আর ফিরতে হতো না আজ। হাতির জিদ যে এত বেশি, জানা ছিল না। ব্যাটার গায়ের শক্তিও দানবের মতো। হঠাৎ সে এমন চটে উঠলো কেন? কী এমন ঘটেছে? হাজার ভেবেও সিংহ এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পায় না।

নিজেকে মুক্ত করে সিংহ বেশ খানিকটা দূরে গিয়ে দাঁড়ায়। গা ঝাড়া দিয়ে ধুলোবালি সরায়। মুখ ভেঙিয়ে হাতিকে বলে তারপর, না না, এই কাজ করা তোমার ঠিক হয়নি। আমার সঙ্গে এমন খারাপ ব্যবহার করা মোটেও উচিত হয়নি তোমার। বলা নেই, কওয়া নেই, আচমকা এমন হিংস্র হয়ে উঠলে কেন তুমি? আমি যে প্রশ্নটা তোমাকে করেছিলাম, বোঝা যাচ্ছে তার উত্তর তোমার জানা নেই। সেটা আমাকে বললেই তো চলতো। শুধু শুধু আমাকে অমন রগড়ানোর কোনো দরকারই ছিল না।
এই কথা বলে সিংহ জোরে হাঁটা দেয়।
বনের মহারাজা হওয়ার শখ তার মিটে গেছে। চিরদিনের মতো। ০