শরবত দাদা

আজাদী আবাবিল সায়মা

0
35

বৃষ্টি এলেই ৮ বছর বয়সী ময়না অনেক খুশি হয়। বৃষ্টিতে ভিজতে খুব ভালো লাগে ওর। ঠান্ডা লেগে যাবার ভয় থাকলেও সুযোগ পেলেই বৃষ্টিতে গোসল করে। মাঝেমধ্যে দীর্ঘদিন বৃষ্টির অপেক্ষা করতে থাকে। দুপুরে বৃষ্টি না হয়ে যদি রাতে অথবা সকালে বৃষ্টি হয় তাহলে ময়নার মন খারাপ থাকে। ময়নার বাবা মা সাধারণত বৃষ্টিতে ভিজলে খুব রেগে যায়। বিভিন্ন অসুস্থতার ভয় দেখায়। যেদিন স্কুল ছুটির পরে বৃষ্টির মধ্যে বাড়িতে ফেরার উদ্দেশ্যে বের হতে পারে, সেদিন ময়না আর ওর বান্ধবী মীম খুব খুশি হয়। ছাতা থাকলেও কখনো পুরোপুরি না ভিজে বাসায় ফেরে না। মা’য়ের কাছে যুক্তি দিয়ে বলে
“বইয়ের ব্যাগ ভিজে যাচ্ছে বলে ছাতা পেছনের দিকে ব্যাগের উপরে রেখেছিলাম, এইজন্য মাথাটা ভিজে গেছে।”

আষাঢ় মাসেও বৃষ্টি না হয়ে উল্টো তীব্র গরম পড়ায় মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে বৃষ্টির জন্য আল্লাহর কাছে নামাজ পড়ে দোয়া করেছিলো। এরপর থেকে দীর্ঘদিন ধরে মাঝেমধ্যে বৃষ্টি হচ্ছে। ময়না আজ বান্ধবী মীমের সাথে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে স্কুল থেকে বাসায় ফিরেও মন খারাপ করে ঘরে ঢোকে। ময়নার আম্মা বুঝতে পারে কোনো কারণে ময়নার মন ভালো নেই। হয়তো স্কুলের কোনো পড়া পারেনি তাই শিক্ষকের ধমক খেয়েছে। অথবা স্কুল থেকে ফেরার পথে ওর বান্ধবী মীমের সাথে ঝগড়া হয়েছে। কিন্তু জিজ্ঞাসা করে উত্তর শুনে অবাক হয়ে যায় ময়নার আম্মা।
ময়না বলছে
“কয়েকমাস ধরে শরবত দাদাকে খুঁজে পাচ্ছি না। আজও শরবত দাদাকে পেলাম না।”
“শরবত দাদা কে?”
জানতে চায় ওর মা।
‘পরে বলবো তোমাকে, এখন আগে গোসল করে আসছি।’
কথাটি বলেই স্কুলের ব্যাগ রেখে ময়না গোসলের উদ্দেশ্যে চলে যায়।

রাতে নিরিবিলি ময়নার কাছে ওর আম্মা জানতে চায়
“শরবত দাদা কে?’
ময়না বলতে শুরু করে পুরো ঘটনা।
ক’দিন আগে প্রচণ্ড গরমে স্কুল থেকে ফেরার পথে আমার পানি তৃষ্ণা পায়। ব্যাগের মধ্যে থাকা বোতল বের করে দেখি পানি শেষ। মীমের বোতলের পানিও শেষ হয়ে গেছে। স্কুলের কাছাকাছি ফুটপাতে একজন বয়স্ক লোক লেবুর শরবত বিক্রি করেন। স্কুলের ফিল্টার থেকে পরিষ্কার ও জীবাণু মুক্ত পানি দিয়ে শরবত বানায় বলে ছাত্রছাত্রীরা উনার কাছ থেকে শরবত কিনে খায়। আমি আর মীম উনাকে গিয়ে বলি
“দাদা আমাদেরকে একটু পানি খাওয়াবেন?”
লোকটা গ্লাস ভালো করে ধুয়ে তাতে কাঠের তৈরি চাপকল দিয়ে লেবুর রস বের করতে থাকে।
আমরা শরবত খাবো না, তাই উনাকে বলি
“আমাদেরকে পানি দেবেন, আমরা শরবত খাবো না।”
তবুও উনি লেবুতে পানি মিশিয়ে শরবত বানিয়ে দুই গ্লাসে ভাগ করে দুইজনকে দিলেন। মীম গ্লাস হাতে নিতে নিতে বললো
“দাদা, আমাদের কাছে কোনো টাকা নেই। আমরা কীভাবে শরবতের দাম দেবো?”
আমি গ্লাস হাতে না নিয়েই বলি
“আমার কাছেও টাকা নেই। আপনি আমাকে শুধু পানিই দেন।”
উনি মুচকি হাসি দিয়ে বললেন
“তোমাদের টাকা দিতে হবে না।”
কথাটি শুনে খুব খুশি হয়ে আমি আর মীম শরবত খেয়ে নিই। এরপর থেকে মাঝেমধ্যে উনার কাছ থেকে শরবত কিনে খাই। কখনো কখনো টাকা না থাকলেই বলি “শরবত দাদা, আমাদেরকে পানি খাওয়াবেন?
দাদা তবুও আমাদেরকে শরবত বানিয়ে দেন। একবারতো হাতে বোতল ভর্তি পানি রেখেও আমি পানি খেতে চাই। সেসময় শরবত দিতে দিতে দাদা বলেছিলেন
“পানি তো তোমাদের কাছেই ছিলো। তাহলে তোমরা শরবত খেতেই এসেছো, তাই না?

এরপর থেকে প্রতিদিন স্কুলে যাওয়া এবং আসার সময়ে দাদাকে সালাম দিই। শরবত দাদাও আমাদের সালামের উত্তর দেন। হাসিমুখে খোঁজ খবর নেন। উনার আমার মতো একজন নাতী আছে, গ্রামের বাড়িতে থাকে। এইজন্য দাদা আমাদের খুব ভালো বলেন। দাদাকে দেখলে আমাদেরও খুব ভালো লাগে। আমাদের গ্রামের বাড়িতে থাকা দাদা দাদুর কথা মনে পড়ে। কিন্তু আজ অনেকদিন হয়েছে শরবত দাদা ভ্যানে করে শরবত নিয়ে বসছে না। শরবত দাদার দোকানের জায়গায় অন্য একজন কাঁঠাল বিক্রি করছেন। সব ঘটনা শুনে ময়নার আম্মা বলেন
“যখন অনেক গরম পড়ে তখন শরবত বেশি বিক্রি হয়, কিন্তু বৃষ্টি হচ্ছে বলে আবহাওয়া ঠান্ডা। এইজন্য কেউ আর লেবুর শরবত খায় না। তোমাদের শরবত দাদা হয়তো এইজন্য আপাতত দোকান বন্ধ রেখেছেন। আবারও যখন গরম পড়বে তখন উনি আবারও শরবত বিক্রি করতে আসবেন। তখন তোমরা তাকে দেখতে পাবে।”

খুশি হয় না ময়না। মন খারাপ করেই বলে
“শরবত যদি বিক্রি না হয়, দাদা কাঁঠাল বিক্রি করতে পারতো। কিন্তু উনার জায়গাটাতো অন্য একজন দোকানদার দখল করে নিয়েছে।”
ময়নার আম্মা আবারও সান্ত্বনা দিয়ে বলেন
“দখল নয়, কিছুদিন পরে কাঁঠালের মৌসুম শেষ হবে। তখন উনিও আর বসবেন না। জায়গাটা ফাঁকা থাকবে।
ময়না এবার কিছুটা রেগে গিয়ে বলতে থাকে
‘কোনো জায়গাই কখনো খালি থাকে না। স্কুলে যেতে দেরি হলে আমি সামনের বেঞ্চে বসতে পারি না। একদম পেছনে গিয়ে বসতে হয়। যেই সুযোগ পায় সেই বসে যায়। আমার মনে হয় দাদাকে ওখান থেকে উঠিয়ে দিয়েছে।’
আরও কিছু কথা বলতে বলতে ময়না অন্যঘরে চলে যায়। মা’য়ের ভাবনায় চলে আসে সত্যিই তো। মানুষ এখন সুযোগ পেলেই সবকিছু দখল করে নেয়। ০