এক রাজার ছিল তিন কন্যা। চুনিতারা, স্বর্ণতারা এবং তাম্রতারা। এই তিন বোনের সৌন্দর্য এবং রাজার ধন-সম্পদের খ্যাতি বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। রাজকুমারীদের বিয়ে করার জন্য আগ্রহী প্রার্থীর আর অভাব নেই। সবকিছু রাজকন্যারা জানে। কিন্তু তারা খুবই সতর্ক। আসলে তারা তিনজনই মনে মনে চায় উত্তরের রাজ্যের রাজপুত্র জ্যাংচুকে বিয়ে করতে। জ্যাংচু ধনসম্পদে সেরা, সুদর্শন ও মহৎহৃদয়। ভদ্রতায়ও তার জুড়ি নেই।
রাজপুত্র জ্যাংচুরও ইচ্ছে তাদের তিন বোনের একজনকে বিয়ে করা। কিন্তু তিনজনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কোমলমনা এবং অমায়িক মেয়েটিকে সে চায়। সে একটি ভিক্ষুকের ছদ্মবেশ নিয়ে রাজকুমারীদের প্রাসাদ গেটে এসে দাঁড়াল। সে প্রাসাদে একটি কাজ চায়। তাকে দেখে রাজার দয়া হলো। সে তাকে রাখাল হিসেবে নিয়োগ দিলো। ওই রাজ্যের একটি নিয়ম ছিল। তা হলো প্রত্যেক রাজকুমারী পশুচারণ ও দুধ দোহানোর সময় পালাক্রমে রাখালকে সাহায্য করতে হতো। প্রথমদিন চুনিতারার পালা পড়ল। সে দুধ দোহাতে এলো। রাতে বৃষ্টি হওয়ায় এখন সবখানে কাদামাটি থিকথিক করছে। সে তখন রাখালকে বলল, তুমি হাঁটু গেড়ে উপুড় হও, যাতে আমি তোমার পিঠে বসে দুধ দোহাতে পারি। সব দুধ দোহানো শেষ হলে রাখালের শরীর কাদাময় হলেও রাজকুমারীর শরীরে কাদা লাগলই না। তারপর কিছু দুধ সৃষ্টিকর্তা এবং বিভিন্ন দেবতার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করল। এরপর চারদিকের রাজার উদ্দেশ্যে। সবশেষে গোপনে করল রাজপুত্র জ্যাংচুর উদ্দেশ্যে। সে বলল, আমার এই উৎসর্গ রাজপুত্র জ্যাংচুকে হয়তোবা সন্তুষ্ট করবে। সে যে দুধ ছিটিয়ে দিলো তা রাখালের মুখে গিয়ে পড়ল। রাখালরূপী রাজকুমার জ্যাংচু অবাক হয়ে বলল, রাজকুমারী, তুমি যে দুধ উৎসর্গ করলে তা তো আমার মুখে এসে পড়েছে। আমি এটা দিয়ে কী করব? আমি কি তা গিলে ফেলব না ফেলে দেবো? রাজকুমারী ঘৃণাভরে জবাব দিলো, ফেলে দাও। তখন রাখাল বলল, চুনিতারা, এই সুস্বাদু দুধ আমার তৃষ্ণা বাড়িয়ে দিয়েছে। আমাকে এক কাপ দুধ দাও না। রাজকুমারী বলল, একটি ভিক্ষুকের জন্য আমি দুধ নষ্ট করতে পারব না। এরমধ্যে দুপুরের খাবার সময় হয়ে গেল। একটি বড় পাথরের উপর বসে রাজকুমারী চুনিতারা ভাত-মাংস খেল। জ্যাংচু দূরে বসে রুটি আর মরিচভর্তা খেল।
দুপুরে প্রচণ্ড গরম শুরু হলে রাজকুমারী একটি গাছের ছায়ায় শুয়ে পড়ল। জ্যাংচু তাকে ভালো করে দেখল। রাজকুমারী নির্দয়। তবুও সে নিশ্চিত হতে চাইল তাদের দুজনের জীবন একসূত্রে বাঁধা হবে কি না। সে হাত থেকে চুনিখচিত একটি আংটি খুলে শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে বলল, রাজকুমারী চুনিতারা, এই চুনি আংটি তোমার উদ্দেশে উৎসর্গ করলাম। যদি ভবিষ্যতে আমাদের দুজনের জীবন এক হয়ে যায় তাহলে এই আংটি তোমার হাতে গিয়ে পড়বে। যদি না হয় তবে আমার আংটি আমার কাছে ফিরে আসবে। চুনি আংটি তার নিজের কোলে এসে পড়ল। রাজকুমারী জেগে উঠে বলল, তুমি বিড়বিড় করে কী বলছিলে? সে তৎক্ষণাৎ বলল, ভিক্ষুকেরও তো সুখ-দুঃখের গান থাকে। সন্ধ্যা হয়ে এলে জ্যাংচু গরুগুলো একত্রিত করে বাড়ির দিকে চলল। নদী পার হওয়ার সময় চুনিতারা জ্যাংচুর কাঁধে পা রাখল এবং ডানহাতে ধরল গরু তাড়ানোর লাঠি। একটি ভিক্ষুকের গায়ের সাথে স্পর্শ লাগাতে রাজকুমারীর ঘেন্না হলেও এছাড়া উপায় নেই। তাই শক্ত করে জ্যাংচুকে ধরে থাকতে হলো রাজকুমারীকে।
দ্বিতীয় দিন পড়ল দ্বিতীয় রাজকুমারী স্বর্ণতারার পালা। সেও ছিল ঠিক তার বড় বোনের মতো। জ্যাংচু বুঝে গেল চুনিতারা ও স্বর্ণতারা কারও সাথে তার জীবনের বন্ধন অদৃষ্টে নেই।
তৃতীয় দিন এলো তৃতীয় রাজকুমারী তাম্রতারার পালা। সেদিনও ছিল কাদামাটিময়। রাজকুমার জ্যাংচু হাঁটু গেড়ে বসে রাজকুমারীকে বলল, তার পিঠে বসার জন্য। কিন্তু রাজকুমারী এতে খুবই আঘাত পেল এবং তা প্রত্যাখ্যান করে বলল, এমন কাজ আমি করতে পারব না। দুধ উৎসর্গের সময় রাজপুত্রের প্রতি উৎসর্গীকৃত দুধ তার মুখে পড়লে সে জানতে চাইল, আমি কী করব এখন? রাজকুমার জ্যাংচুর প্রতি উৎসর্গ করা দুধ আমার মুখে পড়েছে। আমি কি এটা গিলে ফেলব না ফেলে দেবো? রাজকুমারী বললো, যদি তোমার মুখে পড়ে থাকে তাহলে এর নিশ্চয় কোনো ভালো কারণ আছে। তুমি তা গিলে ফেলো। এরপর জ্যাংচু এক কাপ দুধ খেতে চাইলে সে বলল, তোমার যত খুশি তত খাও। এখানে প্রচুর দুধ আছে।
দুপুরে খাওয়ার সময় সে জ্যাংচুকে একসাথে বসে খেতে খুবই অনুরোধ করল। খাওয়ার পর সে একটি গাছের ছায়ায় ঘুমিয়ে পড়ল। রাজকুমার জ্যাংচু তার পাশে বসে ভালো করে দেখল। তারপর তার হাত থেকে তামার আংটি খুলে শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে উচ্চারণ করল, রাজকুমারী তাম্রতারা এই তামার আংটি উৎসর্গ করলাম। যদি আমাদের ভবিষ্যৎ জীবন এক হয় তাহলে এই আংটি তোমার হাতে পড়বে আর যদি না হয় তাহলে আমার কাছে ফিরে আসবে। রাজকুমারী ঘুম থেকে জেগে উঠে অবাক হয়ে দেখে তার আঙুলে একটি আংটি পরানো। রাজকুমার জ্যাংচুকে জিজ্ঞেস করলে সে অস্বীকার করল। তখন সে মনে মনে ভাবল, সম্ভবত এটি কোনো ভালো লক্ষণ হতে পারে। তাই সে এটি রেখে দেবার সিদ্ধান্ত নিলো। রাজকুমারী তাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কি গান করছিলে? তখন সে বলল, ভিক্ষুক হলেও আমার সুখ-দুঃখের গান আছে না? এর চেয়ে বেশি কিছু সে বলল না।
সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার সময় জ্যাংচু পিঠে তুলে নিয়ে রাজকুমারীকে নদী পার করতে চাইল। কিন্তু সে জ্যাংচুর কাঁধে না উঠে বরং তার হাত ধরে নদী পার হলো। তৃতীয় দিন শেষে জ্যাংচু বুঝল কোন রাজকুমারীকে সে বিয়ে করতে চায়। কিন্তু রাজকুমারী আসলেই তার স্ত্রী হবে কি না তা জানার জন্য আরও পরীক্ষা করা দরকার।
এখন রাজা মনে করল রাজকুমারীদের এবার বিয়ে দিতে হবে। তাই রাজা সবাইকে আমন্ত্রণ জানাল যারা রাজকুমারীদের বিয়ে করতে চায়। সে ঘোষণা করল যে রাজকুমারীকে বিয়ে করতে চায় তাকে নিজের বীরত্ব প্রমাণ করতে হবে। চারদিক থেকে বিয়ের পাত্র এসে তাদের বিভিন্ন সাহসী ও বীরত্বপূর্ণ যোগ্যতা প্রদর্শন করল। প্রত্যেকে নিজ নিজ যোগ্যতার প্রমাণপত্র নিয়ে নির্দিষ্ট দিনে প্রাসাদে হাজির হলো। এদের একজন ধরে নিয়ে এলো একটি ড্রাগন। তখনও তার মুখ দিয়ে আগুন বের হচ্ছিল। একজন নিয়ে এলো একটি সামুদ্রিক সাপ। এটিকে সে পোষ মানিয়েছে। আরেকজন ধরে নিয়ে এলো পিশাচের রাজাকে গলায় মোটা চামড়ার বেল্ট বেঁধে।
অনুষ্ঠানের দিন রাজকন্যারা তাদের পছন্দের পাত্রকে একটি স্কার্ফ উপহার দেবে। এর আগের দিন রাজকুমার জ্যাংচু একটি নবজাত বাছুর নিয়ে রাজকুমারী তাম্রতারার বিছানার পাশে রেখে এলো। তখন সে রাজকুমারীকে জাগিয়ে বলল, তুমি এই বাছুরটি জন্ম দিয়েছ। এখন তুমি যদি আমাকে পছন্দ না করো তাহলে আমি সবাইকে তা বলে দেবো।
রাজকুমারীর একথা মেনে নেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। পরদিন সূর্যোদয়ের সময় প্রাসাদের ছাদে শুরু হলো স্বয়ম্বর অনুষ্ঠান। রাজকুমারী চুনিতারা প্রথম দৃঢ়পদে হেঁটে এসে পূর্বরাজ্যের রাজাকে স্কার্ফ সমর্পণ করলে সবাই খুশি হয়ে হাততালি দিলো। রাজকুমারী স্বর্ণতারা পশ্চিমের রাজাকে দিলো তার স্কার্ফ। বেচারী রাজকুমারী তাম্রতারা মাথা নিচু করে ভিড়ের দিকে এগিয়ে গিয়ে ভিক্ষুকবেশী জ্যাংচুকে স্কার্ফ উপহার দিলো। উপস্থিত সবাই বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে পড়ল। চারদিকে হায় হায় রব উঠল। রাজা খুবই রাগান্বিত হয়ে দুজনকেই রাজ্য থেকে বের করে দিলেন।
রাজকুমার জ্যাংচু ও রাজকুমারী তাম্রতারা অনেকদিন হেঁটে বহু উপত্যকা বহু পর্বত পার হয়ে একদিন এসে পৌঁছাল এক বিশাল মাঠে। তারা বিরাট গবাদি পশুর একটি পাল দেখতে পেল। রাজকুমারী বলল, এত বিশাল গরুর পাল কার হতে পারে? এগুলো আমাদের হলে খুব ভালো হতো। জ্যাংচু বলল, সম্ভবত তাই হতো।
তখন সে এই গরুর মালিকের ঘরে কিছু খাবার চাইতে যেতে চাইল। সে ফিরে এলো গরম সুস্বাদু খাবার নিয়ে। এসেই বলল এরা খুবই ভালো মানুষ।
পরবর্তী কয়েকটি দিন তারা কাটাল বার্লি, গম, সরিষার ক্ষেত এবং ঘোড়া, ভেড়া ও ছাগলের বিশাল পালের মাঝে। প্রতিদিনই জ্যাংচু তার স্ত্রীর জন্য সহৃদয় পশুপালকদের কাছ থেকে সুস্বাদু ও ভালো ভালো খাবার এনেছে। আসলে এইসব পশুগুলোর মালিক সে নিজে। প্রতিবার সে খাবার আনতে গেলে তারা তাদের প্রিয় রাজকুমারকে সবচেয়ে ভালো খাবারটিই দিয়েছে। একদিন তারা এসে পৌঁছাল এক বিশাল প্রাসাদের কাছে। কলকল রবে বয়ে চলা রুপোলি পাহাড়ি নদীর পাড়ের এই প্রাসাদ যেন পুরো উপত্যকা আলোকিত করে রেখেছে। চোখ ঝলসানো সুন্দর এই প্রাসাদ। রাজকুমারী তাম্রতারা ভাবল, এই প্রাসাদ আমার বাবার প্রাসাদের চেয়েও অভিজাত এবং এই স্থানটি খুবই সুন্দর। রাজকুমার জ্যাংচু প্রাসাদের ভেতর খাবার চাইতে ঢুকলে তাম্রতারা গেটের বাইরে অপেক্ষায় রইল। গেটের বাইরে অপেক্ষা করার সময় সে একজন লোকের সাথে কথা বলল। লোকটি প্রাসাদের ঝাড়ুদার। সে ঝাড়ুদারকে এই প্রাসাদের মালিকের নাম জিজ্ঞেস করলে ঝাড়ুদার অবাক হয়ে বলল, তুমি জানো না? এটা রাজকুমার জ্যাংচুর প্রাসাদ। তখন রাজকুমারী তাম্রতারা জিজ্ঞেস করল, রাজকুমার জ্যাংচু কি প্রাসাদে আছে? ঝাড়ুদার আরও অধিক বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি তাকে দেখোনি? সে এই মাত্র ভিক্ষুকের বেশে প্রাসাদে প্রবেশ করেছে।
রাজকুমারী তাম্রতারা কিছু বলার আগেই রাজকুমার জ্যাংচু এসে তাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে প্রাসাদের ভেতর নিয়ে গেল। তখন সে রাজকুমারীকে সবকিছু বলল। বলল তারা রাজা-রানী হিসেবে সারাজীবন থাকতে পারবে কি না তাই সে পরীক্ষা করে দেখেছে। সে আরও বলল, আমি চেয়েছিলাম একজন সহৃদয় এবং মার্জিত রানী। তুমি ঠিক তাই।
এরপর কয়েকদিন চলল মহাধুমধাম। এ খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। রাজকুমারী চুনিতারা ও স্বর্ণতারা তাদের শুভেচ্ছা জানাতে এলো। তাদের বাবা তার খারাপ ব্যবহারের জন্য দুঃখ প্রকাশ করতে এলো। রাজকুমার জ্যাংচু ও রাজকুমারী তাম্রতারা রাজাকে শুধু ক্ষমা করেছে তা-ই নয় উপহার দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছে। ০