ঈদুল আজহা বা কুরবানির ঈদ

নাসির হেলাল

0
12

মুসলমানের আনন্দ উৎসব হলো ঈদ। অন্যান্য জাতির আনন্দ উৎসব থেকে মুসলমানদের ঈদ উৎসব সম্পূর্ণ আলাদা। বছরে দু’টি ঈদ পালিত হয়। এর একটি হলো ঈদুল ফিতর এবং অপরটি ঈদুল আজহা। ঈদুল ফিতরে রয়েছে নিয়ন্ত্রিত আনন্দ উল্লাসের ছড়াছড়ি, অপরদিকে ঈদুল আজহাতে রয়েছে ত্যাগ, তিতীক্ষা ও সংযমের শিক্ষা।

ঈদ কী : ঈদ এর শাব্দিক অর্থ আনন্দ। আরবি ‘আ-দা’ ‘ইয়াউদু’ থেকে ঈদ শব্দটি এসেছে। ফিরে আসা, প্রত্যাবর্তন করা-এর আভিধানিক অর্থ। আর এ থেকেই গ্রহণ করা হয়েছে ‘ঈদ’ শব্দটি। আর একটু ব্যাখ্যা করে বললে ‘ঈদ’ এর আভিধানিক অর্থ হলো: ক) সেই সকল দিন যাতে সমবেত হয়; খ) খুশি ও আনন্দ ফিরে আসার মওসুম; গ) সেই দিন যা প্রতি বছর আনন্দ ও খুশি বয়ে আনে।
আমাদের আলোচ্য বিষয় ঈদুল আজহা বা কুরবানির ঈদ। কুরবানি অর্থ আল্লাহর নৈকট্য লাভের উপায় বা পন্থা। জিলহজ মাসের ১০ তারিখ থেকে ১২ তারিখ সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত কুরবানি করার সময়। পবিত্র কুরআনে কুরবানির বিষয়ে আল্লাহ বলেছেন- ‘তোমার প্রতিপালকের জন্য নামাজ পড় এবং কুরবানি দাও’।

ঈদ উৎসবের শুরু: মদিনায় হিজরতের আগে ঈদ উৎসব পালন করা হয়েছে এমন কোনো বর্ণনা পাওয়া যায় না। কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে, ৬২৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম ঈদুল ফিতর উদযাপিত হয়। তবে অধিকাংশের মতে, দ্বিতীয় হিজরি সালে অর্থাৎ ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দে ঈদুল ফিতরের উৎসব প্রবর্তিত হয়।

ইবরাহীম (আ.)-এর কুরবানি: মুসলিম জাতির পিতা হলেন হজরত ইবরাহীম (আ.)। তাঁর আরেকটি সম্মানজনক উপাধি হলো ‘খলিলুল্লাহ’ বা আল্লাহর বন্ধু। বলা যায় জন্ম থেকেই ইবরাহীম (আ.) নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও কুরবানি দেয়ার মধ্য দিয়েই অগ্রসর হয়েছেন। শেষ জীবনে অর্থাৎ একান্ত বৃদ্ধ বয়সে এসে তিনি পুত্র সন্তান ইসমাঈলকে লাভ করেন। কিন্তু এ বৃদ্ধ বয়সের সন্তানকেও আল্লাহর হুকুমে স্ত্রী হাজেরাসহ মক্কার নির্জন প্রান্তরে রেখে আসেন। আবার এই সন্তান যখন একটু বড় হন, চলতে ফিরতে পারেন তখন ইবরাহীম (আ.) তাঁর সন্তানকে কুরবানি করার নির্দেশপ্রাপ্ত হন।

কবি কাজী নজরুল ইসলাম কুরবানির এ ইতিহাস তুলে ধরে লিখেছেন-
“খা’বে দেখেছিলেন ইব্রাহীম।
‘দাও কুরবানি মহামহিম’!
তোরা যে দেখিস দিবালোকে
কি যে দুর্গতি ইসলামের।
পরীক্ষা নেন খোদা তোদের
হাবিবের সাথে বাজি রেখে।”
(শহীদী ঈদ)
পশু হত্যা নয়, উৎসর্গের আনন্দ উৎসব হিসেবে কাজী নজরুল ইসলাম কুরবানিকে গ্রহণ করে মুসলিম জাতিকে জাগ্রত করার উদ্দেশ্যে লিখেছেন-
“ওরে হত্যা নয় আজ’ ‘সত্যাগ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন
দুর্বল ভীরু চুপ রহো, ওহো খাম’খা ক্ষুব্ধ মন।” (কোরবানি)।

হজরত ইবরাহীম (আ.) কুরবানি করতে গিয়েছিলেন পুত্র হজরত ইসমাঈল (আ.) কে। ইসমাঈল (আ.)-এর বয়স তখন মাত্র ১৩/১৪ বছর। অর্থাৎ একজন কিশোর মাত্র। অথচ সেই কিশোর ইসমাঈল পিতার প্রস্তাবে কোনো প্রশ্ন না তুলেই রাজি হয়েছিলেন। এটা কি স্বাভাবিকভাবে কল্পনাও করা যায়? কিন্তু ইসমাঈল (আ.) এর বেলায় সেটাই সম্ভব হয়েছে। কত সহজভাবেই না কিশোর ইসমাঈল ঘটনাটি নিয়েছিলেন- যখন ইবরাহীম (আ.) বললেন, ‘হে বৎস! আমি স্বপ্নে তোমাকে জবাই করতে দেখেছি। এখন বলো, তোমার কী অভিপ্রায়?’ পিতৃভক্ত বালক আরজ করলেন, ‘আব্বা, আপনি যে আদেশ পেয়েছেন, তা পালন করুন। আপনি আমাকে ইনশাআল্লাহ এ ব্যাপারে ধৈর্যশীল পাবেন।’

হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর কুরবানি: রাসুল (সা.) নিয়মিত কুরবানি করেছেন এবং সহচরদের কুরবানি করার জন্য উৎসাহিত করেছেন। এমনকি যারা কুরবানি করার ব্যাপারে গাফেল তাদের বিষয়ে কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানি করে না, সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে।’ (ইবনে মাজা)

কুরবানি হলো উৎসর্গের আনন্দ উৎসব। পশু কুরবানি এখানে মুখ্য নয় মুখ্য হলো মনের পশুত্বকে কুরবানি করা। আসলে আল্লাহর রাস্তায় সম্পদ কুরবানি করে তাকওয়া অর্জনই মূল লক্ষ্য। এরশাদ হচ্ছে, ‘আল্লাহর কাছে এর গোশত ও রক্ত পৌঁছায় না, বরং পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া।’ (সুরা হজ: ৩৭) আল্লাহ পাক আরও ঘোষণা করেছেন, ‘বলো, আমার নামাজ, আমার কুরবানি, আমার জীবন, আমার মরণ একমাত্র আল্লাহরই জন্য।’ (আল-আনআম: ১৬২)

কাজী নজরুল ইসলামের ‘বকরীদ’ কবিতার কয়েক লাইন উদ্ধৃত করে লেখা শেষ করছি-

“ইবরাহীমের কাহিনি শুনেছ? ইসমাঈলের ত্যাগ?
আল্লারে পাবে মনে কর কোরবানি দিয়ে গরুছাগ?
আল্লাহ নামে, ধর্মের নামে, মানব জাতির লাগি
পুত্রেরে কোরবানি দিতে পারে, আছে কেউ হেন ত্যাগী?
সেই মুসলিম যদি থাকে কেউ, তসলিম করি তারে,
ঈদগাহে গিয়া তারি সার্থক হয় ডাকা আল্লারে।” ০