পিকো

হাসনাইন আহমদ

0
42


ঈদের আর মাত্র তিনদিন বাকি। শহরের চারিদিকে হুড়োহুড়ি লেগে গেছে। যে যার মতো গ্রামের বাড়ি ছুটে যাচ্ছে। জাহিন, জাইফা ওরাও যাবে। গত রাত থেকে কত প্রস্তুতি! জাহিনের প্যান্ট, শার্ট, গেঞ্জি খেলনা আরো কত্ত কী? জাইফারও কম নয়। সব মিলিয়ে মাঝারি সাইজের একটা গাট্টি হয়েছে। বাবা মায়ের পোশাকও গোছানো হয়ে গেছে। কিন্তু ছাদের গাছগুলো আর পিকোকে নিয়েই যত বিপত্তি। ভাইয়া গাছে পানি দেয়ার জন্য অনলাইন থেকে একটি ড্রিপ ইরিগেশন মেশিন কিনেছে। যেটি দিয়ে অ্যাপসের মাধ্যমে দূর থেকে কমান্ড করে গাছে পানি দেয়া ও বন্ধ করা যাবে। কিন্তু পিকোর বিষয়টিতে এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্তে আসা গেল না।

পিকো জাহিনদের আদরের পোষা বিড়াল। গত বছর ঈদে গ্রামের বাড়ি থেকে ওকে আনা হয়েছিল। খুব ছোট্ট ছিল। অনেক আদর যত্ন করে বড় করেছে। এ বাড়ির সবাই খুব আদর করে পিকোকে। জাহিনের ভাইয়া আরিব ঢাকাতেই একটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। সারাদিনের ক্লাস, এক্সাম, বাসায় ফেরত আসার জার্নির ক্লান্তি সব দূর হয়ে যায় বাসায় ফিরে পিকোর সাথে দুষ্টুমি করে। ঘরে পা ফেলতে না ফেলতেই পিকোকে খোঁজে। পিকো পিকো করে ডাকতেই দৌড়ে ভাইয়ার রুমে ঢোকে। একটা কাগজের বল ছুঁড়ে মারে আর পিকো দৌড়ে সেটি নিয়ে এসে সামনের দু’পায়ে ভাইয়াকে ফেরত দেয়। এভাবে আব্বু অফিস থেকে আসলেও কাছে গিয়ে মিউ মিউ.. করে ডাকে আর লেজ নাড়ে। বাবা হাতে থাকা পাউরুটির ব্যাগ থেকে ছোট দু-এক টুকরো পাউরুটি নিচে ফেলতেই চাকুম চুকুম করে আনন্দ করে খায়। আর জাহিনের সাথে কেমন সম্পর্ক? সেটা না হয় না-ই বললাম। এক কথায় জানে জিগার দোস্ত! বিকেল বেলা জাহিনের স্কুল থেকে ফেরার টাইম মাথায় সেট করা আছে পিকোর। পঞ্চম শ্রেণিতে ওঠার পর আধা ঘণ্টা বাড়িয়ে জাহিনের চারটায় ছুটি। আসতে আসতে পাঁচটা বাজে। পিকো দরজার কাছে গিয়ে পা দুটো সামনের দিকে ছড়িয়ে আরাম করে বসে থাকে জাহিনের অপেক্ষায়। সম্ভবত পাঁচটা বাজলে ড্রয়িং রুমের ঘড়ির ঢং ঢং পাঁচবার আওয়াজ শুনে পিকো সময় বুঝতে পারে।
গত এক বছরে পিকো বাসার সবাইকে ভীষণ আপন করে নিয়েছে। আজ ঈদ উদযাপনের জন্য গ্রামের বাড়ি যাওয়ার সময় পিকোকে কী করবে বুঝতে পারছে না। গত রাতে গ্রামে যাওয়ার নানা খুঁটিনাটি বিষয়ে কথা বলার জন্য ছোটখাটো একটা পারিবারিক মিটিং হয়েছে। জাহিন বাবাকে বললো, ‘বাবা পিকোকে আমাদের সাথে নিয়ে গেলে কেমন হয়?’
বাবা বললেন, ‘না রে বাবা, আমার মনে হয় তা ঠিক হবে না। কারণ আমাদের গ্রামে যেতে লঞ্চ, গাড়ি, রিকশা অনেক কিছুতে চড়তে হয়। তাছাড়া বেশ লং জার্নি। সেখানে পিকোকে নিলে খুব ঝামেলা হবে।’
‘তাহলে কী করা যায়? বেশি করে খাবার দিয়ে বাসায় রেখে গেলে কেমন হয়?’ বললো জাহিনের ছোট বোন জাইফা। ক্লাস টু তে পড়ুয়া পরিবারের সবচেয়ে ছোট সদস্য হলেও যেকোনো পারিবারিক বিষয়ে সেও মতামত দেয়।
আম্মু বললেন, ‘আমার মনে হয় পাশে তোর খালামনির বাসায় রেখে যাওয়া ভালো।’
অনেক মতামত আলোচনা শেষে জাহিনের আপসহীন আবদারে সিদ্ধান্ত হয় পিকোকে সাথে করেই নিয়ে যাওয়া হবে।

২.
জাহিনদের গ্রামের বাড়ি ভোলা। যাতায়াতের একমাত্র সহজ মাধ্যম নৌপথ। ওদের লঞ্চ সাড়ে সাতটায়। বাবা অফিস থেকে বের হয়েই ফোনে সবাইকে দ্রুত রেডি হতে বলেন। সবাই যথাসময়ে রেডি হয়ে অপেক্ষা করে। বাবা এসেই দেখেন সবার প্রয়োজনীয় পোশাক আশাক ভরে গাট্টি বোঁচকা রেডি। ছয়দিন থাকার প্রস্তুতি। মোট সাতটি মূল ব্যাগ। খাবার ও অন্যান্য জিনিসের আরও তিনটি ছোট ছোট ব্যাগ হয়েছে। মায়ের পুরনো একটি পার্স ব্যাগ কেটে তৈরি করা ব্যাগে পিকোকে ঢুকিয়ে প্রস্তুত করা হয়েছে ভ্রমণের জন্য। পিকো বুঝে উঠতে পারছে না, আসলে কী হচ্ছে ওর সাথে? জীবনে কোনোদিন এমন অবস্থায় পড়েনি তো।
গাড়িতে করে ওরা সময়মতোই সদরঘাট এসে পৌঁছে। সদরঘাট টার্মিনাল গেইট দিয়ে ঢুকে ঠিকঠাক লঞ্চে উঠে যায়। টার্মিনাল থেকে হকার সরিয়ে দেয়ায় লঞ্চে উঠতে আগের মতো ঝক্কি ঝামেলা নেই। এমভি তেঁতুলিয়া জাহিনদের লঞ্চ। ওরা তিনতলায় আগেই বুক করে রাখা কেবিনে ওঠে। জাহিনের ভাইয়া আরিব বাবার সাথে হাত লাগায় কেবিনে ব্যাগগুলো গোছাতে। জাহিন জাইফাও ওদের নিজ নিজ ব্যাগ নিয়ে জায়গামতো রাখে। আম্মু খাবারের বক্সগুলো নিয়ে পরখ করে দেখছেন ঠিকঠাক আছে কি না। পিকোকে জার্নি ব্যাগ থেকে বের করে কেবিনে ছেড়ে দেয়া হয়। আস্তে করে খাটের নিচে ঢুকে চুপচাপ বসে পড়ে।
লঞ্চের ইঞ্জিন স্টার্ট দেয়া হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ছেড়ে যাবে। টার্মিনালে লঞ্চগুলো লাগালাগি করে ভিড়ানো হয়। পাশে থাকা লঞ্চগুলো টার্মিনাল ত্যাগের জন্য বের হওয়ার সময় বেশ জোরে জোরে ধাক্কা লাগে জাহিনদের লঞ্চে। বেশ কয়েকবার এমন হওয়ায় পিকো খুব ভয় পেয়ে যায়। মিয়াও মিয়াও.. করে জোরে জোরে আওয়াজ করে। টার্মিনাল থেকে লঞ্চ ছেড়ে গেলে পিকো চুপ হয়ে যায়।


রাতের খাবার লাগবে কি না জানতে চায় কেবিন বয়।
আব্বু বলেন, ‘নাহ আমাদের খাবার আনা আছে। ডাল হবে?’
কেবিন বয় উত্তর দেয়, ‘হ্যাঁ হবে। ভুনা ডাল।’
আব্বু এক বাটি ভুনা ডাল দিতে বললেন।
আম্মু বললেন, ‘ডাল অর্ডার করে ভালো করেছো। লঞ্চের ভুনা ডাল খুবই মজা হয়। গত বছর লঞ্চে যাওয়ার সময় খাওয়া ডালের স্বাদ এখনও মনে আছে।’
কিছুক্ষণের মধ্যে কেবিন বয় একটা ডাইনিং টেবিল, ভুনা ডাল, লবণ ও একটি বাটিতে লেবু পেঁয়াজ কাঁচামরিচ দিয়ে যায়। সবার জন্য দেয়া প্লেট ভালো করে ধুয়ে নেয়া হয়। আম্মু বাসা থেকে আনা মুরগি কারি, ডিম ভুনা, চিংড়ি ভুনা, সাদা ভাতের বক্স বের করেন। সবাই বেশ মজা করে খায়। ওদের পোষা বিড়াল পিকোকেও খাবার খেতে দেয়।
আম্মু জানতে চান, ‘খাবার কেমন হয়েছে?’
জাইফা বলে, ‘খুব মজা। পিকনিকের মতো লেগেছে।’
সবাই হো হো করে হেসে ওঠে।
খাওয়াদাওয়া শেষে কিছুক্ষণের মধ্যেই শোয়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করলো সবাই।
তোমাদের বলে রাখি, ঈদের মৌসুমে অন্যান্য যানবাহনের মতো লঞ্চেও কিন্তু প্রচুর যাত্রীদের চাপ হয়। কেবিন ও ডেক কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে কেবিনের সামনে ও আশেপাশের খালি জায়গাও ভরে যায়। বিছানা পেতে যাত্রীরা শুয়ে পড়ে। ফাঁকে কোনোমতে পা ফেলে জাহিন ওয়াশরুমে যায়। যাওয়ার সময় কেবিনের দরজাটি বন্ধ করতে ভুলে গেছে। এ সুযোগে পিকো আস্তে করে দরজার পর্দার ফাঁক গলিয়ে বেরিয়ে যায়। কাঁথা মুড়ি দিয়ে কেবিনের সামনে এলোমেলো শুয়ে থাকা যাত্রীদের একজনের গায়ের ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে লাগলো পিকো। লোকটি আচমকা লাফ দিয়ে উঠে ঝটকা দিয়ে পিকোকে ছুঁড়ে ফেলে। হালকা আঁধারে আসলে পিকো বুঝতে পারেনি এখানে মানুষ শুয়েছিল। কাঁথা মুড়ি দিয়ে থাকা লোকটিও বুঝতে পারেনি এটি একটি বিড়াল ছিল। পিকোর নখের আঁচড় লেগে ভয়ে আঁতকে ওঠে লোকটি। লাফিয়ে উঠে পড়িমড়ি করে প্রাণপণে এক ঝটকা মারে। পিকো ছিটকে রেলিংয়ের ওপর গিয়ে পড়ে। একটুর জন্য রক্ষা। আরেকটু হলেই নদীর অথৈ পানিতে টুব্বুস করে পড়ে তলিয়ে যেত চোখের পলকেই। ওখানে শুয়ে থাকা যাত্রীদের মধ্যে তোলপাড় শুরু হয়ে গেল। লঞ্চের মধ্যে বিড়াল এলো কোত্থেকে..?
জাহিনের আব্বুর একটু তন্দ্রা এসেছিল। হট্টগোলের আওয়াজে লাফ দিয়ে উঠে কেবিনের বাইরে বেরিয়ে সব জানতে পারে। হন্তদন্ত হয়ে পিকোকে খোঁজে। বেড়ালটা গেল কই? এসময় ওয়াশরুম থেকে জাহিনও চলে আসে। বাবার কাছে ঘটনা শুনে দুজনে মিলে আশেপাশে পিকোকে খুঁজতে লাগলো। অনেক খোঁজাখুঁজির পর পিকোকে পাওয়া গেল। একটি বস্তার ফাঁকে লুকিয়ে ছিল। জাহিন কোলে করে পিকোকে কেবিনে নিয়ে আসে। জাইফা, আরিব ভাইয়া, আম্মু সবাই পিকোকে আদর করে শুইয়ে দেয়। সবাই ঘুমিয়ে যায়।


বেশ ভোরেই লঞ্চ পৌঁছে যায়। লঞ্চ থেকে নেমে গ্রামের বাড়ি যেতে বিশ মিনিটের মতো লাগে। যদিও রাস্তাঘাট পাকা। পায়ে টানা রিকশার বদলে নানা রকমের অটো রিকশার চলাচল। তবে এখনও বেশ গ্রামীণ আবহ আছে। রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে জাহিনরা ডানে বামে অনেক কিছু দেখছে। জাহিনের কাছে জার্নি ব্যাগে বসে বসে পিকোটাও ড্যাব ড্যাব করে সব দেখছে। ধানক্ষেত, গরু মহিষ, রাজহাঁস আরো কত কী! জাহিন জাইফা যেতে যেতে ভাবছে গ্রামে যে কয়দিন থাকবে, বেশ ভালোই কাটবে দিনগুলো। মনে মনে অনেক প্ল্যান। ওদের কাজিন ফারজাদ, রিশাদ, জেরিনদের সাথে অনেক মজা হবে। ভোরে বাগানে কাঠবাদাম সংগ্রহ করা, এক্কাদোক্কা, ব্যাডমিন্টন, ক্রিকেট খেলা, পুকুরে গোছল করা ইত্যাদি অনেক পরিকল্পনা।
গ্রামের বাড়ি পৌঁছে ওদের বেশ ভালোই কেটে যায় দিনগুলো। পিকো এখানে এসে খুব আনন্দে কাটায়। ওর চলাচল, আচরণ দেখলেই তা বোঝা যায়। এত খুশির কারণ হলো পিকো এখানে এসে আরো দুটি বিড়ালকে পেয়েছে। জাহিন ছোট চাচির কাছ থেকে জানতে পারে সে দুটি বিড়ালের মধ্যে হলুদটি ওর মা আর সাদার মধ্যে হালকা কমলা রঙেরটি ওর ভাই। বাচ্চা অবস্থায় পিকোকে এখান থেকেই ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। পিকো সারাদিন ওর ফিরে পাওয়া মা ও ভাইয়ের সাথে থাকে খায় ও খেলা করে। রাত হলেই মাচায় গিয়ে শুয়ে পড়ে। ভাইয়ের সাথে ছোটখাটো খুনসুটিও লেগে যায়। সেদিন ঘরের পেছনের সুপারি বাগানে একটা প্রজাপতির সাথে ওর বেশ সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। দু পা ছুঁড়ে অনেক দুষ্টুমি করেছে তার সাথে।
দেখতে দেখতে ছয়দিন কেটে গেল। বাবার অফিসের ছুটি শেষ। ওদের বেড়ানোর নির্দিষ্ট সময়ও শেষ। এবার রওনা দেয়ার পালা। সবাই যার যার ব্যাগ গুছিয়ে ফেলেছে। রওনা দিতে হবে। ইশ আর কয়টা দিন যদি থেকে যাওয়া যেত! দিনগুলো খুব দ্রুতই শেষ হয়ে গেল যেন। নিচে গাড়ি অপেক্ষা করছে। পিকোকেও ওর জন্য নির্দিষ্ট ব্যাগে রেডি করে নেয়া হয়েছে। ঘরের পোষা বিড়াল দুটি দরজার পাশে বসে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে পিকোর দিকে। পিকোও তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। ওরা যে পিকোর মা ও ভাই। বুঝতে বাকি নেই কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা আবার বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। পিকোর সাথে আর সহসা দেখা হবে না। হয়তো কখনোই না। পিকোর চোখ পিটপিট করতে থাকে। ঘনঘন চোখ খুলছে আর বুজছে। দেখে বোঝাই যাচ্ছে খুব মন খারাপ। জাহিন পিকোকে তুলে নেয়। এখই রওনা হতে হবে। গাড়িতে উঠে বসে সবাই। পিকোর মা ও ভাই দরজার কাছে দাঁড়িয়ে অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছে আর লেজ নাড়ছে। কিছু একটা বোঝানো চেষ্টা করছে। গাড়ি চলতে লাগলো। জাহিন দেখলো পিকোর দু চোখ দিয়ে টলটল করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। বোঝাই যাচ্ছে পিকোর খুব মন খারাপ। কী করবে বুঝতে পারে না জাহিন। গাড়ি দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে সামনের দিকে। আর পিছনের দিকে দৌড়ে পালাচ্ছে গাছ, বাড়ি ঘর, দোকানপাট, খড়ের গাদা।