নাগকন্যা

মূল : রবার্ট নিসবেত বেইন; ভাষান্তর : সোনিয়া হুসাইন

0
42
নাগকন্যা

ছেলেটি ভদ্র, অমায়িক। গ্রামের এক নোবলম্যানের নওকর সে। মনিবের বাড়িতেই থাকে, তার ফাই-ফরমায়েশ খাটে। মনিবকেও বড় ভালোবাসে সে। কিন্তু তাকে নিয়ে বড় সমস্যায় আছেন মনিব। আলসেমি নেই ঠিকই, কিন্তু কাজকাম করতেই চায় না তার নওকর।

অন্য চাকর-বাকরদের সাথে মাঠে কাজে পাঠালে, কখন যে সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে চলে যাবে, কেউ টেরও পাবে না। অবশ্য যতক্ষণ সে কাজ করে, বেশ ভালো মতোই করে। কোনো ফাঁকি নেই। কিন্তু ফাঁক পেলেই ফুরুৎ। সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে সে চলে যাবে দূরে। কোনো বনে বাদাড়ে বা অন্য কোনোখানে। অল্প বয়স তো। মনের খেয়ালি ভাবটা এখনো কাটেনি তার।
নোবলম্যানের আরো অনেক চাকর-বাকর আছে। অনেক দাস-দাসি আছে। কিন্তু সবার চেয়ে এই সুঠামদেহী যুবক নওকরকেই তিনি বেশি ভালোবাসেন। নোবলম্যান তাকে কাজেকর্মে খুব একটা পাঠান না। যদিও বা কখনো সখনো পাঠান, অন্য চাকর-বাকরদের সাথেই পাঠান। মাঠের ভারী কোনো কাজ করতেও দেন না। অন্যদের সাথে মাঠে যায়, কাজ করে। কিন্তু কখন যে চোখের আড়াল হয়ে কোথাও চলে যাবে কেউ টেরও পাবে না। চলে যাবে সে বনে বাদাড়ে, নদীর কিনারে বা বিজন কোনো মরুতে।

একদিনের ঘটনা।
নওকরটি অন্যদের সাথে মাঠে গিয়েছে এবং যথারীতি সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেছে কোথাও। রীতিমতো হারিয়ে গেছে সে। এবার চলে গেছে সে গহীন এক অরণ্যে। অজানা, অচেনা বনের ভেতর দিয়ে হাঁটছে নওকর। উদাস মনে হাঁটছে। হাঁটছে আর ভাবছে, পৃথিবীতে সে বড় একা। মা নেই, বাবা নেই। ভাই-বোন কেউ নেই। সহায় সম্পত্তিও নেই তার। কী উদ্দেশ্যে পৃথিবীতে আসা? কী উদ্দেশ্যে বেঁচে থাকা?
পৃথিবীতে এতো মানুষ, এতো কাজ, এতো আয়োজন! কিন্তু তার কিছু নেই। না আছে নিজের কোনো কাজ, না আছে জীবনের কোনো লক্ষ্য। পৃথিবীতে মানুষের আসা-যাওয়াই কি শেষ? আর কোনো মানে নেই? কথাগুলো দার্শনিকের মতো হলেও এই বিজন বনে সে এমন কিছুই ভাবছে। ভাবছে আর হাঁটছে।
গহীন বনের ভেতর দিয়ে হাঁটছে সে। হঠাৎ বাতাসে অস্বাভাবিক হুঁস হুঁস শব্দ। ভয় পেয়ে চমকে ওঠে সে। সামনে তাকিয়ে দেখে প্রকাণ্ড এক সাপ। তার মাথা সমান উঁচু হয়ে ফণা তুলে পথ আগলে রয়েছে। মনে হচ্ছে, সাপটি তাকে গিলে খাবে। সামনে এগুনোর আর পথ নেই। নওকরটি ভয়ে অবশ হয়ে যায়। নির্বাক তাকিয়ে থাকে। নাক বরাবর লিকলিক করছে সাপের জিহবা। দৌড় দিবে? ভয়ে সেই শক্তিও নেই এখন তার। পা দুটো যেন পাথর হয়ে গেছে। মৃত্যু নিশ্চিত ভেবে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে সে। এমন সময় সে বুঝতে পারে, সাপটি বুঝি তাকে কিছু বলছে! কোথায় যাও ওহে নোবলম্যানের নওকর?
সাপ যে কথা বলতে পারে, এমনটি ভাবতেও পারেনি যুবকটি। সাপের প্রশ্নের উত্তর দেয়ার শক্তিও নেই তার। সে তো কাজে ফাঁকি দিয়ে এসেছে। উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরতে। কোথায় যাও- এ প্রশ্নের তো কোনো উত্তর নেই তার।

সাপটি আবার কথা বলে। এই নওকর, কথা বলছো না যে? কাজে ফাঁকি দেয়ার ফল এবার টের পাবে। গিলে খাবো তোমায়। নাও, মরণের প্রস্তুতি নাও।
কোনো কিছু না ভেবেই নওকরের মুখ থেকে উচ্চারিত হয়, ঠিক আছে, খেয়ে ফেলো আমায়।
নওকরের এমন হ্যাবলা ধরনের উত্তর আশা করেনি সাপটি। এমন আজদাহা একটি সাপ দেখে সে কি না ভয়ে চিৎকার দিবে, ওরে বাপরে বলে দিবে দৌড়, তা না করে বলছে ‘খেয়ে ফেলো আমায়’!
সাপটি মনে মনে বলে, আরে বোকা, আমি কি তোমাকে খেয়ে ফেলার জন্য পথ আগলে আছি? আমার উদ্দেশ্য যে ভিন্ন। কিন্তু মুখে বলে, কী? ভয় নেই তোমার? আমার লিকলিকে জিহবা দেখেও কি ভয় পাচ্ছো না?
: ভয় পেলেই কী? এই বিজন বনে তোমার হাত থেকে তো আর বাঁচার উপায় নেই। বরং চলে যাওয়াই ভালো।
সাপটি বলে, নাহ, খাবো না তোমায়, যদি তুমি আমার একটি কাজ করে দাও।
খাবো না তোমায়। এমন কথা শুনে প্রাণ ফিরে পায় নওকর। সে বলে, কী কাজ?
: কাজের কথা খুলে বলবো না। কাজটি নিজেই তোমার সামনে এসে যাবে। তুমি বরং বাড়ি ফিরে যাও। দেখবে তোমার মনিব প্রচণ্ড রকমের ক্ষেপে আছেন। তুমি তার কাছে গিয়ে সরি বলো। মন নরম হবে তার। সে তোমাকে আবার মাঠে কাজে পাঠাবে।
: কাজে আমার মন বসে না।
: এবার বসবে। মাঠে গিয়ে দেখবে অন্য শ্রমিকরা শস্য কেটে ঢেরি করে রেখেছে। তুমি শস্যগুলো ওয়াগনে তুলতে সাহায্য করো তাদের। তারপর নিজে গাড়ি চালিয়ে মনিবের বাড়ি নিয়ে যাও। মনিব তোমার কাজে খুশি হবেন। হঠাৎ কাজে তোমার এমন আগ্রহ দেখে পুরস্কৃত করতে চাইবেন। কিন্তু- – -।
: কিন্তু কী?
: তুমি পুরস্কার নিবে না।
: কী করবো তা হলে?
: তুমি একগোছা শস্যের আঁটি চেয়ে নিবে নোবলম্যানের কাছ থেকে। তুমি যে ওয়াগন গাড়িটি চালিয়ে শস্যগুলো বাড়ি নিয়ে এসেছো, সেখান থেকে একগোছা শস্য চাইবে তুমি। বলবে, আমাকে শুধু একগোছা শস্য দিন। সেটাই হবে আমার পুরস্কার।
নওকর বলে, তারপর?
সাপ বলে, শস্যের আঁটিখানি নিয়ে তুমি চলে যাবে মনিবের বাড়ির সামনের যে ফাঁকা জায়গাটুকু আছে, সেখানে। তোমার এহেন কাজে সবার মনে কৌতূহল জন্মাবে। মনিবও অবাক হবেন। তিনি তোমার পিছু নিবেন। অন্য চাকর-বাকরেরাও তোমার পিছু নিবে। তুমি বাড়ির ফাঁকা জায়গাটিতে যেয়ে ওই শস্যের আঁটিতে আগুন ধরিয়ে দিবে। আগুনের লেলিহান উঠবে ওপরে। সবাই অবাক হয়ে দেখবে।
: কী দেখবে?

: দেখবে, সেই আগুনের ফুলকি থেকে এক অপরূপা সুন্দরী হেঁটে হেঁটে বের হয়ে আসছে। আগুনের লেলিহান শিখা থেকে সে হেঁটে হেঁটে তোমার সামনে চলে আসবে। তাকেই বিয়ে করো তুমি। তোমার স্ত্রী বানিয়ে নাও। নিঃসঙ্গ পৃথিবীতে তোমার একজন সঙ্গী হবে। একজন কাছের মানুষ হবে, আপন মানুষ।

নওকর বাড়ি ফিরে এলো। তাকে দেখে তো নোবলম্যান রেগে আগুন। কিন্তু নওকর ‘সরি’ বলায় তার রাগ পানি হয়ে গেল। মনিব তাকে আবার মাঠে পাঠালেন কাজে। এবার আর আলসেমি করছে না নওকর। অন্যদের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে শস্য কাটছে। শস্যের আঁটিগুলো ওয়াগনে তুলতে সাহায্য করছে। তারপর, সেই ওয়াগন চালিয়ে মনিবের বাড়ি নিয়ে আসে সে।
মনিব এবার খুব খুশি। তার প্রিয় চাকরটি আজ এতো কাজ করেছে। শস্যভরা ওয়াগন চালিয়ে বাড়ি নিয়ে এসেছে?
এবার সন্তুষ্ট হয়ে মনিব তার প্রিয় নওকরকে পুরস্কৃত করতে চাইলেন।
কিন্তু না, সাপের কথা মতো নওকর কোনো পুরস্কার নিবে না। সে তার মনিবকে বলে, পুরস্কার নয়, আমাকে এক আঁটি শস্য দিন। এটাই হবে আমার শ্রেষ্ঠ পুরস্কার।
মনিব তখন বলে, শস্যের আঁটি নিয়ে তুমি কী করবে? তুমি তো আমার বাড়িতেই থাকছো, আমার বাড়িতেই খাচ্ছো। তোমার তো আর বাইরে রান্না করে খেতে হবে না। কেউ তো নেই তোমার!
নওকর কোনো কথা বলে না। তার একগোছা শস্যের আঁটিই চাই।
অবশেষে মনিব তার বাড়ির আঙিনায় স্তুপ করে রাখা হাজারো শস্যের আঁটি থেকে এক আঁটি শস্য এনে নওকরকে দেন। নওকর সেই শস্যের আঁটি নিয়ে বাড়ির সামনের পাশের খোলা জায়গায় চলে যায়। মনিবও কৌতূহল বশতঃ তার পিছু নেন। পিছু পিছু অন্য চাকর-বাকরেরাও সেখানে যায়। সবার চোখেই জিজ্ঞাসু দৃষ্টি। যুবকটি কী করবে এই শস্যআঁটি দিয়ে! কৌতূহল সবার মনেই।

এদিকে বাড়ির সামনের খোলা জায়গায় গিয়ে সাপের কথা মতো শস্যের গোছায় আগুন ধরিয়ে দেয় নওকর। দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে আগুনের লেলিহান শিখা।
এর কিছুক্ষণ পর। আগুন যখন লিকলিক করে আকাশমুখে উঠে যায়, তখনই ঘটে ঘটনাটি। সবাই অবাক বিস্ময়ে দেখে ওপর থেকে কুণ্ডুলি পাকিয়ে আগুনের একটি শিখা নেমে আসে নিচে। তারপর দেখে ওটা যেন আগুনের শিখা নয়, এক অপরূপা সুন্দরী সেই আগুন থেকে হেঁটে হেঁটে বাইরে বেরিয়ে আসছে। এরপর হেঁটে হেঁটে সে ওই নওকরের সামনে এসে দাঁড়ায়। বলে, আমিই সেই নাগকন্যা। আমাকে তোমার স্ত্রী বানিয়ে নাও।

এর পরের ঘটনা। মহা ধুমধামে বিয়ের আয়োজন করে নওকরের মনিব। মনিব বললেন, এ বিয়ে হবে মহা ধুমধামে। ব্যান্ডপার্টি আনা হলো। শত শত লোকের খাবারের আয়োজন করা হলো।
বিয়ে হয়ে গেল নওকরের সাথে আগুনের শিখা থেকে বেরিয়ে আসা নাগকন্যার। নোবলম্যানের আগ্রহে তার বাড়ির পাশেই নওকরকে এক টুকরো জমি দেয়া হলো। সেখানে ঘর বেঁধে থাকবে তারা।
জমির টুকরো পেয়ে নাগকন্যার আনন্দ আর ধরে না। ঘর বাঁধার সমস্ত কাজ যেন সে একাই করে ফেলছে। নওকরকে কোনো কাজে হাতই লাগাতে দিচ্ছে না। ঘরের দেয়াল গাঁথা, রান্নার চুলো বানানো, ঘরের আসবাবপত্র, খাট-পালঙ্ক, সবই এই নাগকন্যাই করে যাচ্ছে। নাগকন্যার হেন কাজের উৎসাহে বড় ভালো লাগে নওকরের। যাক তাহলে, সংসারী এক মেয়েকে পাওয়া গেলো। এ মেয়ে সংসারের জন্য উপযুক্তই বটে। এমন তড়িৎকর্মা সুনিপুণা বউ এ তল্লাটে নেই। নওকর ভাবছে, সত্যিই সে বড় ভাগ্যবান। পৃৃথিবী বড়ই সুন্দর।

বেশিক্ষণ লাগেনি ঘর বানাতে, আসবাবপত্র জোগাড় করে নিতে। উৎসাহ নিয়ে মনের আনন্দে কাজ করলে অতি দ্রুতই সব কাজ শেষ করা যায়। ঘর বাঁধা হলো। চুলা বানানো হলো। আসবাবপত্র, থালা-বাসন সাজানো হলো ঘরে। সব কাজ নাগকন্যা একাই করলো। নওকর বুঝে উঠতে পারছে না, এটা কী করে সম্ভব! এমন কোনো কাজ নেই, যা এই নাগকন্যা পারে না। কোথায় কী আছে, কোথায় কী করতে হবে, এই মেয়েটির সব জানা! নওকর শুধু কাজের তদারকি করছে, দেখছে আর অবাক হচ্ছে। যেদিকেই তাকায়, সবকিছু সুন্দর পরিপাটি।
নওকর ভাবে, পৃথিবীতে কেউ ছিল না তার। আজ তার সব আছে। বিশ্বস্ত স্ত্রী আছে। নোবলম্যানের মতো সাহায্যকারী আছে। পাড়া প্রতিবেশীর ভালোবাসা আছে। এমন বিশ্বস্ত, এমন সুন্দর পরিপাটি, এমন সুনিপুণা বউ থাকলে তার আর কী-ই বা প্রয়োজন? এই মেয়েটির সাথেই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেয়া যাবে।

দিনগুলো বড় সুখেই কাটতে লাগলো নওকরের। এতো সুখ, এতো শান্তি, এতো প্রাপ্তি। নওকর ভাবছে। কী শুভক্ষণেই না বনপথে সেদিন হাঁটতে বেরিয়েছিলাম। কী শুভক্ষণেই না নাগকন্যা আগলে ধরেছিল পথ। এখন ঘরে সুখ, বাইরে সুখ, অন্তরে সুখ। আকাশে বাতাসে যেন সুখের মাদল বাজে।
কালক্রমে দু’বছর পার হলো। এই নওকর এখন গ্রামের সমৃদ্ধশালী কৃষক। গ্রামের বাইরে তাদের তিনখণ্ড ফসলি জমি। সেসব জমিতে ‘যব’ চাষ করা হয়েছে। মাঠের কাজেও নাগকন্যার জুড়ি নেই। জমিতে যব চাষের সব কাজই সে একাই করেছে। শস্যক্ষেতের আল বেয়ে হাঁটছে আর কথাগুলো ভাবছে নওকর। এমন সময় প্রতিবেশি এক কিষানির সাথে দেখা হলো তার।
কিষানি বলে, কী ব্যাপার হে নওকর, তোমার ক্ষেতের যব যে পেকে নুুয়ে পড়ছে। ঘরে তুলছো না যে?
: হ্যাঁ, তুলবো।
: আমাকে কাজে রাখবে? এতো শস্য তুমি তো একা কেটে নিতে পারবে না। তোমার বউটিও বেশ কাজের। সেও পারবে না। এতো যব, কারো পক্ষে একা তোলা সম্ভব না। এই যে দেখো, তোমার এই ক্ষেতের যবগুলো পেকে মাটিতে ঝরে যাচ্ছে। কবে ঘরে তুলবে হে?
কিষানির কথা শুনে নওকর ভাবছে, সত্যিই তো। যব যে আসলেই বেশি পেকে গেছে। মাটিতে ঝরে পড়তে শুরু করেছে। নাগকন্যা কি এসব দেখেনি? কবে যব কাটবে সে? রাগে গজরাতে গজরাতে তার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো, সাপ চিরকাল সাপই থাকে। “ওয়ান্স এ সার্পেন্ট, অলওয়েজ এ সার্পেন্ট”। মুখ থেকে ফস করে বের হয়ে গেল কথাটি। মুখে আরো বলে, ওই সার্পেন্ট বুঝি এবার আমার শস্য কাটবে না। এই কিষানির আগ্রহ আছে বেশ। শেষে কি না এই কিষানিকেই রাখতে হয় শস্য কাটার জন্য।

ভীষণ রাগ হলো নওকরের। নাগকন্যার প্রতি রাগে ফুঁসছে সে এখন। মুখে বিড়বিড় করতে করতে নওকর দ্রুত বাড়ি ফিরে আসে। যব পেকে মাটিতে ঝরছে। অথচ কেটে ঘরে তোলার নাম নেই। বাড়িতে এসেই নওকর খুঁজতে থাকে নাগকন্যাকে। কিন্তু কই? তার নাগবউ কই?
সারা বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজে বেড়ালো। নেই, কোথাও নাগকন্যার দেখা নেই। অবশেষে শোবার ঘরে চলে এলো সে। সেখানেও নেই! রাগে মাথা যেন ঠিক নেই তার। ঘরের জিনিসপত্র, আসবাব, বিছানা, বালিশ সব উলট-পালট করতে লাগলো রাগে।

এক সময় বিছানার ওপরে রাখা বালিশটা ছুড়ে ফেলে দিলো দূরে। আর তখনই ফোঁস করে ওঠে সাপ! বালিশের নিচে চোখ পড়ে নওকরের। কুণ্ডলি পাকিয়ে শুয়ে আছে সাপটি! ভয়ে চিৎকার দিতে যাবে, তখন সাপটি নিজেই কথা বলে। ভয় পেও না, প্রিয় নওকর। আমিই তোমার সেই নাগবধূ
একথা শুনে নওকরের মনে পড়ে গেলো সব। কী ভুলটাই না সে করে ফেলেছে! নিজের প্রতি রাগে দুঃখে চিৎকার দিয়ে বললো, না এটা হতে পারে না। তুমি সাপ নও। তুমি আমার নাগবউ।
সাপটি বলে, ধৈর্য ধরো নওকর। যা হারিয়ে গেছে, তা আর ফিরে পাওয়া যাাবে না।
নওকর এবার কান্নায় ভেঙে পড়ে। আহা, কী ভুলটাই না করে ফেলেছি আমি। এখন উপায়! কীভাবে এই নাগকন্যাকে মানুষরূপে ফিরে পাবো? একদিন এই নাগকন্যা তাকে বলেছিল, সাবধান, আমাকে কখনো সাপ ‘সার্পেন্ট’ বলবে না। “বিওয়ার, ডোন্ট এভার কল মি এ সার্পেন্ট”। আমি তোমাকে এমন কোনো কষ্ট দেবো না যে রাগের মাথায় আমাকে ‘সাপ’ বলতে হবে তোমার। যদি কখনো বলেই ফেলো, তোমার এই নাগবউকে হারাবে তুমি।
পেছনের সব কথা মনে পড়ে গেল নওকরের। এখন উপায়? মুখের কথা তো আর ফিরিয়ে আনা যায় না। “হোয়াট ওয়াজ সেইড কান্ট বি আনসেইড”।
তার পেছনের কথা ও স্মৃতিগুলো মনে পড়তে থাকে। আহা, কতোই না ভালো স্ত্রী ছিল সে। কীভাবে সে তাকে আগলিয়ে রেখেছিল এতোদিন। বাড়ির বাইরে গেলে তার জন্য পথ চেয়ে বসে থাকতো। কতো ভালো ভালো খাবার রান্না করে রাখতো। কোনো কাজই তাকে করতে দিতো না। বাড়ির ও ক্ষেতের সমস্ত কাজই সে একাই করতো। কাউকে হাত লাগাতে দিতো না সে।
নওকর ভগ্ন হৃদয়ে চিৎকার করে বলছে, আহা, তবুও নিজের মুখটাকে সামলাতে পারলাম না। জিহ্বার দোষে আজ সব হারাতে হলো আমার। হয়তো সারা জীবন আমাকে একাই কাটাতে হবে। দুর্ভাগ্য যেন আমি নিজেই ডেকে নিয়ে এলাম।
এমন ভাবনায় নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না নওকর। সাপটির সামনে কেঁদে ফেললো সে।
নওকরের এমন কান্না দেখে সাপটি বলে, আর কেঁদো না প্রিয় নওকর। যা হওয়ার, তা তো হবেই। “হোয়াট ইজ টু বি, মাস্ট বি”। দুঃখ করে কী লাভ? ভুল মানুষেরই হয়। আমি চলে যাচ্ছি আগের জায়গায়, বনে। যেখানে তুমি আমাকে প্রথম দেখেছিলে। বিদায় বন্ধু!
এ কথা বলে নাগকন্যা কুণ্ডলি পাকানো থেকে বের হয়। তারপর বুকে ভর দিয়ে চলে যেতে থাকে বনের দিকে। নওকর তাকে আর ফিরাতে পারে না। সে কাঁদছে, আর সাপের পিছু পিছু হাঁটছে। কী করবে সে আর? কীভাবে ফিরাবে নাগকন্যাকে। আর যে কোনো উপায়ই নেই।
তারা যখন বনের মধ্যে সেই আগের স্থানে পৌঁছায়, সাপটি থামে। নিজেকে আবার কুণ্ডলি পাকিয়ে মাথা ওপরে তোলে। এবার ফণা তোলে না সে। শুধু মাথাটা ওপরে তুলে ধরে। তারপর বলে, তুমি তো আমাকে ‘সাপ’ বলেছিলে। কারণ, যবগুলো কেটে আনতে দেরি করেছিলাম। এবার বাড়ি ফিরে যাও। দেখো গিয়ে তোমার সব শস্য আমি এতোক্ষণে কেটে এনেছি। তোমার ঘরের শস্যভণ্ডারে গিয়ে দেখো, মাঠের সব যব কেটে এনে গোলায় তুলে রেখেছি। এটা তো আমারই কাজ ছিল, হে প্রিয় নওকর। তবু কেন তুমি অধৈর্য হয়ে পড়েছিলে?

নওকর বলে, এখন উপায়? কীভাবে তোমাকে ফিরে পাবো?
সাপ বলে, সেই মধুর দিনগুলো আর ফিরে আসবে না আমাদের। কিন্তু আমি তোমাকে নিয়ে ভাবছি। এখন থেকে কে তোমার কাজগুলো করে দেবে? কে বুনবে তোমার শস্য, কে তুলবে ঘরে। যাহোক, তুমি বাড়ি ফিরে যাও, প্রিয় নওকর।
সাপের কথাগুলো শুনে নওকরের মন ব্যথায় ভারী হয়ে যায়। সে বলে, তোমাকে এই বিজন বনে রেখে আমি কীভাবে বাড়ি যাই, কীভাবে তোমার নিজ হাতে তৈরি ঘরে আমি একা বাস করি? আমি পারবো না, ওহে প্রিয় নাগকন্যা। আজ থেকে এই বনেই থেকে যাবো আমি। থেকে যাবো তোমার কাছে, তোমার পাশে।
: সেটা আর সম্ভব নয় নওকর। এখন আমি তো আর মানুষ নই। কোনো দিনও আর মনুষ্যরূপে ফিরে যেতে পারবো না আমি। সে সুযোগ একবারই এসেছিলো আমার। ভাগ্যদোষে আবার স্বজাতিকূলেই ফিরে এলাম। তুমি আর এইখানে থেকো না প্রিয়। সাপের জাতকে বিশ্বাস নেই। যে কোনো সময় তোমাকে ছোবল মেরে বসতে পারি আমি। তুমি বরং ফিরে যাও। তোমার কথা স্মরণে রেখে বাকি জীবনটা আমি সাপ হয়েই কাটিয়ে দেবো। সাপেরা অনেক দিন বাঁচে।
নওকর আর কী করবে। সে ফিরে যাবার জন্য মনস্থির করে। এমন সময় নাগকন্যা বলে, শোনো হে প্রিয়তম নওকর। যাবার বেলায় আমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দাও। তবে সাবধান, তোমার হাতে যেন ছোবল দিয়ে না বসি! সাপের জাতি আপন পর বোঝে না। “আ স্নেক ডাজেন্ট ইভেন নো ইটস বিলাভড”।
এ কথা শুনে নওকরের মন কিছুটা শান্ত হয়। শেষবেলায় হয়তো তার প্রিয় স্ত্রীকে আরেকবার আদর দিয়ে যেতে পারবে। সে ধীরে ধীরে সাপটির আরো কাছে চলে আসে। তারপর হাতখানি তার নামিয়ে আনে সাপের মাথার ওপর। আলতো করে ছুঁয়ে দেয় সে। বরফের মতো ঠান্ডা অনুভূত হয় মাথাটি তার।
নওকরের হাতের ছোঁয়া পেয়ে সাপটি নিজেকে আর সামলে রাখতে পারে না। ছোবল মারার সুতীব্র প্রেরণা জাগে গায়ে। তাই, মাটিতে পড়ে থাকা গাছের একটি ডালে শরীরটাকে সুতীব্র শক্তিতে পেঁচিয়ে ধরে। নিজেকে ক্ষত বিক্ষত করে সে। নওকর সাপের মাথা থেকে হাত সরিয়ে নেয়ার পর সাপ জিজ্ঞেস করে, প্রিয় নওকর, আমার মাথায় হাত রেখে তুমি নিজের ভেতরে কী অনুভব করছিলে?
নওকর বলে, আমার মনে হচ্ছিল সমস্ত পৃথিবীতে কী কী ঘটে চলেছে আমি তার সব কিছুই জেনে ফেলেছি। সাপটি তখন বলে, হ্যাঁ তুমি ঠিকই জেনেছো। আবার তোমার আদরের হাতখানি আমার মাথায় ছুঁইয়ে দাও। নওকর দ্বিতীয়বার ওপর থেকে হাতখানি নামিয়ে আনে সাপের মাথার ওপর। ছুঁইয়ে দেয় আবার তার প্রিয় নাগকন্যাকে। তারপর হাত সরাতেই সাপটি বলে, এবার তোমার কী অনুভূতি হলো?
নওকর বলে, এবার আমার কাছে মনে হলো, পৃথিবীর সমস্ত মানবজাতির ভাষা আমি শিখে ফেলেছি।
নাগকন্যা বলে, হ্যাঁ, তুমি ঠিকই অনুভব করেছো। পৃৃথিবীর সমস্ত ভাষা তুমি শিখে ফেলেছো।
এবার তুমি তৃতীয়বার আমার মাথায় হাতখানি বুলিয়ে দাও হে প্রিয়তম। তবে সাবধান। আমি কিন্তু অতি কষ্টে নিজেকে সামলিয়ে রাখছি। কখন না জানি ছোবল মেরে বসি। সাবধান হও, ভুলে যেও না আমি কিন্তু এখন এক কালনাগিনী। তোমার স্ত্রী নই। সাবধানে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দাও। সতর্ক থেকো, ভুলেও যেন তোমার হাতে ছোবল মেরে না বসি।
সাপের কথায় সে আরো সতর্ক হয়। আরো সচেতন হয়। বাস্তবে ফিরে আসে সে। এতোক্ষণ যেন সে একটা মোহের মধ্যে ছিল। কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল সে। সে কি বেঁচে আছে, নাকি মরে গেছে, সেই বোধটুকুও যেন ছিল না তার। সাপের সাবধান বাণী শুনে সে আবার স্বস্নেহে তার আবেগঘন হাতখানি তৃতীয় বারের মতো সাপের মাথায় বুলিয়ে দেয়।
সাপ এবার জিজ্ঞেস করে, এবার তুমি কী অনুভব করলে?
নওকর বলে, আমার কাছে মনে হলো পৃথিবীর অভ্যন্তরের সমস্ত সম্পদ ও গুপ্তধনের সন্ধান যেন আমি জেনে গেছি।
নাগকন্যা বলে, হ্যাঁ, তোমার প্রতি আমার ভালোবাসার দায় মেটাতে নিজের শরীরটাকে বার বার ক্ষত-বিক্ষত করলাম। আমার সব জ্ঞানের ভাণ্ডার তোমায় দিয়ে দিলাম। এবার তুমি সোজা চলে যাও রাশিয়ার সম্রাট জারের কাছে। তার এক সুন্দরী কন্যা আছে। তাকে বিয়ের প্রস্তাব দাও।

প্রস্তাব পেয়ে সম্রাট জার তোমার জ্ঞানের পরীক্ষা নেবেন। আশা করি, আজ যা জেনেছো, তাতে তুমি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে যাবে। কারণ, তোমার চেয়ে জ্ঞানী বর্তমান পৃথিবীতে আর কাউকে সে খুঁজে পাবে না। সম্রাটের মেয়েকে বিয়ে করো, সুখী হও। তবে, বিদায় বেলায় আমার একটা অনুরোধ, যতকাল বেঁচে থাকবে, আমাকে মনে রেখো প্রিয়তম। যতদিন বেঁচে থাকি এই সাপের জীবন নিয়েই বেঁচে থাকতে হবে আমাকে। সাপের জীবন বড় দীর্ঘ হে প্রিয়তম।
একথা বলে সাপটি কুণ্ডলি পাকানো শরীরটাকে সোজা করে চলে যেতে লাগলো অন্ধকার ঝোপের ভেতর।