
জরুরি আলোচনায় বসেছে ওরা তিন বন্ধু রাফি, মুন্না ও আলভি।
রাফির পড়া-কাম শোয়ার ঘরটা বেশ গোছানো। দক্ষিণ দিকে জানালার নিচে পড়ার টেবিল। টেবিলের বামে উত্তর-দক্ষিণ বিছানা পাতা। অন্যপাশে জামা-কাপড় রাখার একটা আলমারি।
তিন বন্ধু বিছানায় উঠে বসেছে। শীতটা এবার পড়তে দেরি হলেও এই মুহূর্তে বেশ জেঁকে বসেছে। গরম কাপড় তো ওদের গায়ে আছেই, কম্বলের ভেতরে পা ঢুকিয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে রিল্যাক্সে কথা বলছে।
আলোচনার বিষয় আর কিছুই নয় স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ। নতুন ক্লাস শুরু হবে সেই জানুয়ারিতে। জানুয়ারি আসতে এখনও অনেকদিন বাকি আছে। এই সময়টা পার করার একটা পরিকল্পনা প্রণয়নের উদ্দেশ্যেই এই আলোচনা সভার আয়োজন।
রাফির আম্মু সরিষার তেল, পিঁয়াজ ও কাঁচাঝাল কুচি দিয়ে এক গামলা মুড়ি মেখে দিয়ে গেছেন। কম্বলের উপরে রাখা হয়েছে মুড়ির গামলাটা। ওখান থেকে হাতে এক মুঠ করে মুড়ি নিয়ে মুখের ভেতর চালান করছে আর যে যার মতামত জানাচ্ছে। কিন্তু কোনোটাই সবার মনঃপুত হচ্ছে না।
রাফি বললো, ‘আরও ভালো করে ভাবো সবাই। আমরা বেশ মজা করে কাটাতে চাই এবারের ছুটিটা।’
আলভি বললো, মুখভর্তি মুড়িমাখা নিয়ে, ‘আমার দ্বারা ওসব ভাবাভাবির কাজ হবে না। তোমরাই ভাবো।’
মুন্না বললো, ‘একটু অল্প করে মুখে দাও পেটুক রাজা! গলায় আটকে যাবে তো!’
তিনবন্ধুর মধ্যে আলভিটা একটু খাবারপ্রিয়। আর রাফির মায়ের হাতের মুড়িমাখা ওর ফেভারিট খাবার তালিকার এক নম্বরে। কাজেই মুন্না যতোই বলুক, ওকে থামানো যাবে না। মুখের মধ্যে মুড়ি থাকা অবস্থায় আরও মুড়ি নিয়ে মুখে ঢুকিয়ে দিলো। তারপর ওই অবস্থাতেই কথা বলে উঠলো। কিন্তু পুরোটা বোঝা গেলো না।
আলভিকে অধিকাংশ সময় “পেটুক রাজা” বলে সম্বোধন করে মুন্না। প্রথম প্রথম রাগ করলেও এখন আর তেমন কিছু মনে করে না আলভি।
‘আমরা এক কাজ করতে পারি,’ বলে উঠলো মুন্না। ‘কোথাও বেড়াতে যেতে পারি।’
‘এক কাজ করি চলো,’ এবার বললো আলভি। ‘এই সময় তো সাইবেরিয়া থেকে অতিথি পাখিরা আমাদের দেশে আসছে, তাহলে আমরা চলো সাইবেরিয়ায় চলে যাই।’ আবারও মুঠোভর্তি মুড়ি মুখে পুরলো।
খোলা জানালা দিয়ে বিকেলের নরম রোদের ছটা এসে পড়ছিলো রুমের ভেতরে। তাতে প্রাণজুড়ানো সুন্দর একটা রেশ যেনো আছে। আলভি বলেছিলো জানালাটা বন্ধ করে দিতে। কিন্তু বাকি দুই বন্ধুর বিরোধের কারণে তা আর হয়নি। শক্তিটাও যেনো ওর বেশি। এ কারণে অন্য দু’জনের মাঝখানে বসেছে।
‘আমাদের তাহলে উইলভার রাইট আর অরভিল রাইট হতে হবে।’ আলভির কথার জবাবে বললো মুন্না। ‘ওই দুই ভাইয়ের মতো পিঠে পাখা লাগিয়ে উড়ে যেতে হবে সাইবেরিয়ায়।’
‘তোমরা হেয়ালি করো না।’ ক্ষেপে গেলো রাফি। ‘তারচেয়ে শোনো আমি কী বলি।’
উৎসুক হয়ে উঠলো মুন্না ও আলভি। ও জানেই যে শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটা রাফির কাছ থেকেই আসবে। এ জন্য নিজেরা অতোটা মন দিয়ে ভাবছিলো না।
রাফি আবার বললো, ‘রাতুল আঙ্কেলের দোকান থেকে প্রায় প্রতিরাতেই নাকি চুরি হচ্ছে। বিশেষ করে পাউরুটি, কলা, বিস্কুট এইসব। আমি আজ যখন আঙ্কেলের দোকান থেকে মুড়ি আনতে গিয়েছিলাম, তিনি আমাকে বললেন কথাটা। আমার মনে হয়, আমরা চোরটাকে খুঁজে বের করতে পারি। তাতে রাতুল আঙ্কেলের খুব উপহার হবে।’ নিজের পরিকল্পনার কথাটা জানালো রাফি। বন্ধুদের মুখের দিকে তাকাতে লাগলো তাদের অভিমত জানার জন্য।
মুন্না একবারেই রাজি হয়ে গেলো। বললো, ‘এটা একটা ভালো প্রস্তাব। আমি রাজি।’ হাত তুললো।
আলভির মুখটা একটু শুকিয়ে গেলো। চোর ধরতে বুঝি ভয় পাচ্ছে। কিন্তু অন্য দুই বন্ধুকে রাজি দেখে ও আর না করতে পারলো না, সম্মতি জানালো।
রাফি এবার উচ্ছ¡সিত হয়ে বললো, ‘তাহলে আমরা আজ রাতেই কাজ শুরু করবো।’
ঠিক এই সময় রুমে প্রবেশ করলো রাফির ছোটো বোন রাইসা। বললো, ‘আমাকে তোমাদের সাথে নিতে হবে।’ বোঝা যাচ্ছে, আড়াল থেকে ওদের সব কথা শুনেছে সে।
ওরা অনেক বোঝালো রাইসাকে। শীতের ভয় দেখানো হলো। কিন্তু কিছুতেই কোনো কাজ হলো না। ওকে যদি না নেয়া হয়, তাহলে আম্মুকে সব বলে দেবে।
আম্মু জানলে ওদেরকে যেতে দেবেন না চোর ধরতে। তাই রাইসাকে সঙ্গে নেয়ারই সিদ্ধান্ত নিলো ওরা।
মসজিদে জামায়াতে এশার নামাজ আদায় করলো ছেলেরা। খেয়েদেয়ে প্রস্তুত হয়ে নিলো।
সাড়ে আটটার দিকে রাইসাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। আম্মুকে বলে গেলো বাইরে বেড়াতে যাচ্ছে। দ্রুতই চলে আসবে।
রাইসা লাল-কালো সুন্দর একটা কার্ডিগান পরেছে। মাথায় একটা উলের টুপি কান পর্যন্ত নামানো। পায়ে গোড়ালির ওপর পর্যন্ত ঢাকা পিংক কালারের একটা নরম কেডস। একেবারে ডলের মতো লাগছে।
রাফি, মুন্না আর আলভি যে যার মতো গরম কাপড় পরেছে। তিনজন তিনটে টর্চলাইট নিয়েছে। ওদের টর্চলাইটগুলো দেখে রাইসাও নিজের কার্টিগানের পকেট থেকে গোলাপি কালারের একটা টর্চ বের করলো। গতবছর ছোটমামা কিনে দিয়েছিলেন।
রাতুল আঙ্কেলের দোকানটা কাঠের তৈরি। সামনে ঝাঁপ দেয়া। আংটা দিয়ে উপরে উঠিয়ে খোলা হয়। পাশে ছোটো একটা দরজা আছে। ওটাকে দরজা না বলে জানালা বলাই ভালো। ওটা খুলেই দোকানের ভেতরে ঢুকতে হয়।
দোকানটা রাস্তার উত্তর পাশে। ডান পাশ দিয়ে হাউজিংয়ের ড্রেন চলে গেছে। বামে খোলা জায়গা। বিকালে ছেলেমেয়েরা খেলা করে। দোকানটা থেকে কিছুটা পূর্বে রাস্তার দক্ষিণে একটা বাগান আছে। বাগানের আরও দক্ষিণে বাড়িঘর। রাস্তাটা ইটের সলিঙের। পশ্চিম দিকে সোজা ঢাকা-রোডের সাথে মিশেছে।
রাফিরা রাস্তার দক্ষিণের বাগানের মধ্যে বড়ো গাছের আড়ালে ঝোপ মতো একটা জায়গায় লুকিয়ে রইলো। দৃষ্টি সবার রাতুল আঙ্কেলের দোকানের দিকে।
বাগানটা অন্ধকার। অন্যদিকে দোকানের সামনেটা আলোকিত। তাই অন্ধকার থেকে দোকান এবং তার আশপাশটা একেবারেই পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।
রাত বাড়ছে। শীতের রাতÑ সে কারণে যেনো সময় যাচ্ছেই না। অস্থির হয়ে উঠছে ছেলেমেয়েরা। মশা খুব বিরক্ত করছে। তবে সারা শরীর এবং পা ঢাকা থাকায় খুব একটা কামড়াতে পারছে না। খোলা হাতে দু’একটা বসছে এবং কামড় দিচ্ছে। কিন্তু বিরক্তিকর হচ্ছে কানের কাছে মশাদের ‘ভনভনানি’ গানটা। বেসুরো ওই গানে মাঝে মাঝে মনোযোগ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
‘আগেই আসা হয়ে গেছে আমাদের।’ ফিসফিস করে বললো রাফি। ‘আরও পরে আসা উচিত ছিলো।’
‘এখন কী করবে তাহলে?’ জিজ্ঞাসা মুন্নার। ‘চলে যাবে? আরেকটু রাত নামলে আসবে?’
পাশেই একটা পেঁচা ডেকে উঠলো কর্কশ কণ্ঠে। চমকে উঠলো আলভি। রাফির প্রায় গায়ের উপরে উঠে পড়লো ভয়ে। রাফি চাপা ধমক দিয়ে বললো, ‘এই ভীতুর ডিম, ওটা একটা পেঁচার ডাক!’
রাইসা একটুও ভয় পেলো না। বললো, ‘পেঁচার ডাক শুনতে কর্কশ হলেও ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ওরা আমাদের কিছুই করতে পারবে না।’
রাফি ডিজিটাল রিস্ট ওয়াচের আলো জ্বেলে দেখলো, রাত তখন দশটা বাজে।
সময় যেনো থমকে আছে। অন্যদিকে শীত তার কনকনে থাবা নিয়ে হামলে পড়ছে ওদের দেহের ওপর। গায়ে গা লাগিয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। সবার চোখ রাতুল আঙ্কেলের দোকানের দিকে।
তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ ব্যথা করে উঠছে। একটু পর এলাকাটা নির্জন হয়ে গেলো। রাস্তা দিয়ে লোকজনের চলাচল কমে গেলো। আশপাশের বাড়িঘরগুলোও অন্ধকারে ঢেকে যাচ্ছে। অর্থাৎ, ঘুমিয়ে পড়ছে সবাই। ঘুমিয়ে পড়েছে আলভিও। দেহের পুরো ভর এসে পড়েছে রাফির ওপর।
ফিসফিস করে বন্ধুকে ডাকলো রাফি, কানের প্রায় ভেতরে মুখ নিয়ে। দু’বার ডাকতেই ধড়মড় করে জেগে গেলো। ‘চোর চোর!’ বলে লাফিয়ে উঠলো। মুখ চেপে ধরে তাকে সামলালো রাফি। ভাগ্যিস, রাস্তায় লোকজনের চলাচল নেই! তা নাহলে ওদের উপস্থিতি জানাজানি হয়ে যতো।
একটু পর রাতুল আঙ্কেল ঝাঁপ ফেলে দোকান বন্ধ করলেন। তারপর দোকানের ভেতরে ঢোকার ছোট্ট দরজাটা তালা দিয়ে আটকালেন। হাতের টর্চ জ্বালতে জ্বালতে বাড়ির পথ ধরলেন।
সজাগ হয়ে উঠলো ছেলেমেয়েরা। দোকানের ওদিকটা এখন পুরোপুরি অন্ধকার।
তাকিয়ে আছে ওরা। কিন্তু না, কেউ আসছে না খাবার চুরি করতে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে অধৈর্য হয়ে উঠছে। আজ বোধহয় চোরটা আসবে না ভেবে আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছে, ঠিক এই সময় একটা কালো মূর্তিকে ধীরে ধীরে দোকানের পাশে এসে দাঁড়াতে দেখা গেলো। ঠোঁটে আঙুল চেপে সবাইকে চুপ থাকতে বললো রাফি।
কালো ছায়ার মতো মূর্তিটা দোকানের ছোট্ট দরোজাটার ওপর ঝুঁকে পড়লো। এদিক-ওদিক তাকালো আবার। কেউ কোথাও নেই নিশ্চিত হয়ে কী যেনো করতে লাগলো। রাফি বুঝলো, চোরটা তালা খুলছে। পঞ্চ ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে গেলো ওর।
রাইসা বললো ফিসফিস করে, ‘ওই ভূতটা দোকানের দরজা খুলছে! চলো রাফি ভাইয়া, চোরটাকে এবার হাতেনাতে ধরে ফেলি।’
রাফি বোনকে বাধা দিলো। বললো, ‘এখনই না। আগে চুরি করুক। তারপর তার পিছু নেবো আমরা। দেখবো, লোকটা কেনো চুরি করে? কোথায় নিয়ে যায় খাবারগুলো। প্রকৃত রহস্যটা আমাদের জানতে হবে।’
‘তুমি ঠিক বলেছো রাফি।’ সঙ্গে সঙ্গে ওর পক্ষ নিলো মুন্না। ‘আমরা দেখবো চোরটা ওই খাবার নিয়ে কী করে?’
আলভির কণ্ঠটা ভয়ার্ত শোনালো। বললো, ‘আমার তো মনে হচ্ছে ওটা একটা ভূত! তার পিছু নিলে আমাদের যদি তার ডেরায় নিয়ে যায়? তাহলে তো আমাদের ঘাড় মটকে খেয়ে ফেলবে!’
‘তুমি অতো ভীতু কেনো আলভি ভাইয়া?’ বললো রাইসা। ‘আমি তোমাকে শিওর দিয়ে বলছি, ওটা কোনো ভ‚ত নয়, মানুষ!’
কথা আর এগোলো না, কারণ, কালো ছায়ামূর্তিটা তখন ছোট্ট দরজাটা দিয়ে দোকানের ভেতরে ঢুকে গেছে। তারপর যখন সে বের হয়ে এলো, তার দু’হাত ভর্তি দেখা গেলো। হাতের জিনিসগুলো মাটিতে রেখে আবারও তালাটা আটকে দিলো। তারপর জিনিসগুলো আবারও দু’হাত ভর্তি করে নিয়ে যে পথ দিয়ে এসেছিলো, সেদিকে হাঁটা ধরলো।
‘এসো আমার সাথে।’ বলে বাগান থেকে বেরিয়ে এলো রাফি।
নীরবে লোকটার পিছু নিলো চারজনের দলটা নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে।
কালো ছায়ামূর্তিটা কোনো দিকে তাকাচ্ছে না। হনহন করে হেঁটে চলেছে। ভাবতেই পারেনি যে তাকে কেউ ফলো করতে পারে। প্রায় প্রতিদিনই তো সে এ কাজ করে। তাই কনফিডেন্সটা একটু বেশিই।
জায়গাটা একটা পুরনো ইটভাটা। অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। ভেতরটা কেমন ভ‚তুড়ে হয়ে থাকে। দিনের বেলাতেও ভেতরে মানুষ যায় না খুব একটা। অন্যরা শান্ত থাকলেও আলভি প্রায় রাফির বাহুটা খামচে ধরে হাঁটছে। কয়েকবার বারণ করা সত্তে¡ও কাজ হলো না বলে রাফিও এখন আর কিছু বলছে না।
উঁচুনিচু এবড়ো-থেবড়ো মাটি। কোথাও কোথাও পুরনো ইট বেরিয়ে রয়েছে। চারপাশে ছোট-বড় গাছপালা আর ঝোপঝাড়। কানের পাশ দিয়ে রাতজাগা পাখি আর বাদুড় উড়ে যাচ্ছে। কিন্তু কিছুরই পরোয়া করছে না ওরা। পাছে লোকটাকে হারিয়ে ফেলে!
খুব দ্রুত হাঁটছে সামনের লোকটা। পথটা তার পরিচিত হওয়াতে কোথাও আটকাচ্ছে না। কিন্তু ছেলেমেয়েদের হাঁটতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। লাইটও জ্বালাতে পারছে না। তাতে লোকটা সতর্ক হয়ে যেতে পারে।
সামনে ভাঙাচোরা একটা দালান। দূর থেকে ওটাকে দেখে একটা ভূতের বাড়ি বলেই মনে হচ্ছে। ছাদজুড়ে বিভিন্ন আগাছা গজিয়ে উঠেছে। আলভির কাছে মনে হচ্ছে, ছাদের ওপরে একগাদা ভূত হেঁটে বেড়াচ্ছে। কেউ কেউ ওর দিকে তাকিয়ে ভেংচি কাটছে। লম্বা লম্বা সাদা দাঁত বের করে শাসাচ্ছে- খবরদার মানুষের বাচ্চারা! এদিকে আর এসো না! অনেকদিন মানুষের গোশত খাওয়া হয় না! তোমরা এলে কিন্তু ভুড়িভোজ করবো! তারপর দাঁত কেলিয়ে হাসছে। বিকট সে হাসি। লাল লাল দাঁত দেখা যাচ্ছে এবার।
মনে মনে সূরা কালাম যা জানে সব পড়তে থাকলো আলভি।
রাফির দৃষ্টি সামনের কালো ছায়ামূর্তিটার দিকে। বেশ বড়োসড়ো একটা উঠান মতো খোলা জায়গা দালান ঘরটার সামনে। শান দেয়া জায়গাটার মাঝে মাঝে শান উঠে নিচের মাটি বেরিয়ে পড়েছে। কোথাও কোথাও আগাছা জন্মেছে।
দালানটার সামনে গিয়ে ঘাড় দিয়ে ঠেলা দিলো ছায়ামূর্তিটা। ক্যাঁচ ক্যাঁচ আওয়াজ তুলে একটা দরজা খুলে গেলো। ভেতরে হালকা আলো জ্বলছে। কুপি জ্বলছে একটা।
সবাইকে থামতে বললো রাফি। অপেক্ষা করতে বললো।
দরজাটা খোলাই রইলো।
ওরা এবার সাবধানে কোনো শব্দ না করে কুঁজো হয়ে সামনে এগিয়ে চললো দালানটাকে ডানে রেখে।
দালানের ওপাশে একটা জানালা আছে। সুপারি গাছের পাতা আর ছেড়া সিমেন্ট ও ছালার বস্তা দিয়ে আটকানো হয়েছে। দালানের আরও কয়েক জায়গায় ভাঙা এবং একই পদ্ধতিতে আটকানো।
অমনই এক ভাঙা অংশের সামনে গিয়ে থামলো ছেলেমেয়েরা। রাফি সাবধানে সুপারির পাতা সরিয়ে ভেতরে উঁকি দিলো। কুপির কাঁপা কাঁপা আলোয় যা দেখলো, তাতে ওর প্রাণটা কেঁদে উঠলো। ভেতরে ছেড়া একটা বিছানার ওপরে একটা ছেলে শুয়ে আছে। গায়ের ওপরে ততোধিক ছেড়া ও পট্টি দেয়া একটা কাঁথা। মাথার কাছে সঙ্গে আনা জিনিসগুলো রেখে ঘরের এক কোণায় চলে গেলো একটু আগে যে ছায়ামূর্তিটা ভেতরে ঢুকেছে। ঘরে কোণায় একটা অ্যালুমিনিয়ামের জগ, একটা গেলাস, দু’টো ভাঙা প্লেট এবং টুকটাক আরও কিছু জিনিস।
রাফি এবার ছেলেটার দিকে মনোযোগ দিলো। কাঁথার ওপর থেকেও বোঝা যায়, ছেলেটার শরীর খুবই জীর্ণশীর্ণ। গলা পর্যন্ত ঢাকা শরীরে হাড়হাড্ডি গোনা যাবে যেনো। মাথায় উশকোখুশকো একরাশ চুল।
ছায়ামূর্তিটা নিজের শরীর থেকে ছালার লম্বা আলখেল্লাটা খুলে একপাশে রেখে জগ, প্লেট ও গেলাস নিয়ে ছেলেটার কাছে গেলো। ধীরে ধীরে ছেলেটার মাথা ধরে তাকে উঠিয়ে বসালো। পাশে রাখা জিনিসগুলো থেকে চিড়া বের করে প্লেটে ঢাললো। জগ থেকে পানি ঢেলে ভালো করে চিড়া ধুয়ে তারপর কলা চটকে ছেলেকে খাওয়াতে লাগলো।
রাফির হৃদয়টা তখন হুঁ হুঁ করে কাঁদছে। এই তাহলে খাবার চুরির রহস্য!
এতক্ষণ রাফির গা ঘেষে অন্যরা একই দৃশ্য দেখছিলো। হঠাৎ আলভি হুড়মুড় করে ভেতরে পড়ে গেলো রাফিকে নিয়ে।
চমকে উঠে দাঁড়ালো লোকটা। বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইলো ছেলেমেয়েদের দিকে। কী করবে বা বলবে কিছুই ভেবে পেলো না।
রাফি তাকে অভয় দিয়ে বললো, ‘আপনি ভয় পাবেন না। আমরা আপনাদের কোনো ক্ষতি করবো না।’
অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে লোকটা ও তার ছেলেকে ভয় পাওয়া থেকে আটকালো রাফিরা।
লোকটার কাছ থেকে জানা গেলো, তার বাড়ি অনেক দূরে। গেলো বন্যায় তার বাড়িঘর সব ভেসে গেছে। সাথে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে তার একটি মেয়ে ও স্ত্রীকেও। তারা বাপ আর ছেলে কোনো রকম বেঁচে গিয়েছে। এখানে ওখানে ঘুরতে ঘুরতে এখানে এসে উঠেছে দিন দশেক হলো। তার ছেলেটা খুবই অসুস্থ। বিশেষ করে মা আর বোনের শোকে বেশি ভেঙে পড়েছে। আর নিজেও কাজকর্ম করতে পারে না। কিছু করতে গেলেই হাঁফিয়ে ওঠে। মাথা ঘুরে পড়ে যায়। তাই বাধ্য হয়েই রাতে খাবার চুরি করে। ছেলেকে খাওয়ায়। বাধ্য হয়েই কাজটা করতে হয় তাকে।
সবই ছিলো তার। গরু, হাঁসমুরগি, পুঁইয়ের মাচা, ঘরভর্তি জিনিসপত্র। এখন আর কিছুই নেই। স্ত্রী ও মেয়ের খবর জানে না। বেঁচে আছে কি না, তাও জানে না।
অনেক অনুনয় বিনয় করে তাদেরকে যেনো পুলিশে দেয়া না হয়।
ছেলেমেয়েদের খুবই খারাপ লাগে সবটা শুনে। মনগুলো কেঁদে ওঠে। তারা কতো আরামে থাকে এই শীতে, কতো গরম কাপড়চোপড় পরে, ভালো ভালো খাবার খায়। অথচ তাদের পাশেই এই অবস্থায় পড়ে আছে অসহায় এক পিতা ও তার অসুস্থ ছেলে! বাড়িঘর সব ছিলো তার। কিন্তু আজ সব হারিয়ে পথের ফকির! চুরি করে খাবার ব্যবস্থা করতে হয়।
লোকটা এবং তার ছেলের মতো আরও কতো মানুষ আশপাশে আছে তার হিসাব নেইÑ ভাবলো ওরা। তাদেরও কি বাঁচার অধিকার নেই। অধিকার নেই সমাজের আর দশটা মানুষের মতো শীতে ভালো কাপড় পরার, পেট ভরে তিন বেলা খাওয়ার, ভালো ঘরে ঘুমাবার?
ওরা সিদ্ধান্ত নেয়, কালই এর একটা ব্যবস্থা করতে হবে। এলাকার সবাইকে বলে এই লোক আর তার ছেলের জন্য একটা কোনো ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি খোঁজ নিতে হবে আশেপাশে আর কেউ শীতে কষ্ট পাচ্ছে কি না। তাদেরও পাশে দাঁড়াতে হবে। ০