গ্রীষ্মের ছুটির পর থেকে নাহিদের মধ্যে পরিবর্তন লক্ষ করল শাহিন। আগের মতো সবাইকে নিয়ে আড্ডা দেয়া স্কুল ফাঁকি দেয়া, সুযোগ পেলেই ঘুরতে যাওয়া এই বদঅভ্যাসগুলো যেন নাহিদ ভুলে যাচ্ছে। প্রতিটি কাজের ক্ষেত্রে সময়ের প্রতি লক্ষ রাখে। অপরিকল্পিত কোনো কাজ করে না। যেন নির্দিষ্ট একটি নিয়মের মধ্যেই সে চলে এসেছে। কিন্তু হঠাৎ এই পরিবর্তন কেন? প্রশড়ব জাগে শাহিনের মনে।

নাহিদ আর শাহিন একে অপরের ভালো বন্ধু। স্কুলে নতুন এসে শাহিনকে বন্ধু করে নেয় নাহিদ। নাহিদ জেএসসি পরীক্ষা দিয়েছে অন্য একটি স্কুল থেকে। তবে শাহিন এই স্কুলেই পড়ছিল আগে থেকেই। একসময় শাহিনকে ছাড়া নাহিদ কোথাও যেত না। ক্লাসে যাওয়া, ক্লাস থেকে আসা, খেলতে যাওয়া, ঘুরতে যাওয়া, এককথায় প্রতিটি কাজে একসঙ্গে থাকতো ওরা। এমনকি অনিচ্ছা সত্ত্বেও নাহিদকে সঙ্গ দেয়ার জন্য বিভিনড়ব প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে হয়েছে শাহিনকে। কিন্তু গ্রীষ্মের ছুটির পর থেকে নাহিদের মধ্যে কিছু পরিবর্তন লক্ষ করেছে শাহিন।

পড়াশোনায় শাহিন ভালো হলেও নাহিদ কিন্তু তেমন খারাপ না। গত অর্ধবার্ষিক পরীক্ষায় নাহিদের রোল সাত হলেও বার্ষিক পরীক্ষায় শাহিনের পরের স্থান দখল করে রোল দুইয়ে চলে এসেছে নাহিদ। নাহিদের সাম্প্রতিক এই পরিবর্তনে শাহিন দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে। ফলে এই পরিবর্তনের কারণ বের করার সিদ্ধান্ত নিলো শাহিন।

স্কুলের গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে ফিরোজদের বাড়িতে বেড়াতে যায় নাহিদ। ফিরোজ নাহিদের ফুফাতো ভাই। নামকরা একটি সরকারি কলেজে ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। জেএসসি, এসএসসি দুটোতেই গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছে। ভালো ছেলে হিসেবে এলাকায় নামডাক রয়েছে ফিরোজের। নাহিদ দেখল ফিরোজের রিডিং রুমে বিশাল একটা বুকশেলফ রয়েছে। যেটাতে গল্প, উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনীসহ বিভিনড়ব মনীষীর জীবনসংবলিত ইসলামিক, অনৈসলামিক অনেক বই আছে। যা দেখে নাহিদ তার চেহারাটাকে বাংলা পাঁচের মতো করে ফেলে। স্কুলের সিলেবাসের বাইরে তেমন একটা অন্য বই পড়তে পছন্দ করে না নাহিদ। তাই এসব বই একেবারেই দেখতে পারে না সে। কিন্তু ফিরোজের টেবিলের বাম পাশে বড় একটি ডায়েরি দেখে চমকে উঠেছে নাহিদ! তবে খুলে দেখার সাহস হয়নি তার। কোনো এক সময় এক হুজুরের কাছ থেকে শুনেছিল, অনুমতি ছাড়া কারো জিনিসপত্রে হাত দেয়া গুনাহ। তাই দেখেনি ডায়েরিটা। তবে ডায়েরির ভেতর কী আছে তা দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে তার মন। সুযোগ পেলেই একবার খুলে দেখবে ফিরোজের ডায়েরিটা।

একদিন রাতে খাবারের পরে গল্প করতে বসে নাহিদ ও ফিরোজ। বিভিনড়ব বিষয়ে কথা বলছিল তারা। কথার ফাঁকে নাহিদ জিজ্ঞেস করে, তুমি এতগুলো বই কী করো? এগুলো পড় কখন? রেজাল্টও ভালো করেছ তুমি। অথচ আমি সবকিছু বাদ দিয়ে শুধুই পড়াশোনা করি তবুও জেএসসিতে এ প্লাস পেলাম না।

ফিরোজ বলল, বই পড়ার কারণে আমার এত সফলতা। বই পড়ে আমি এমন কিছু জানতে পারি, শিখতে পারি যা পাঠ্যবইয়ে নেই। এমনকি মা-বাবা বা অন্য কারো কাছ থেকেও এমন কিছু জানতে পারি না যা বই পড়ে আমি জানতে পারি। বই পড়ার কিছু গুরুত্বও তুলে ধরল নাহিদের সামনে। নাহিদ কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনছিল।

কথা শেষ হলে নাহিদ বলল, বই পড়ে এমন কী জেনেছ তুমি যার কারণে এত সফলতা?

Ñ অনেক কিছু জেনেছি। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, ওই যে ডায়েরিটা দেখছ না? হ্যাঁ দেখছি। সোজা উত্তর নাহিদের।

Ñ ফিরোজ আবার বলে উঠল, ওটা আমার ডায়েরি। আমি আমার সব কাজ নিয়মিত ডায়েরিতে লিখে রাখি। প্রতিদিন রাতে ডায়েরিটা সামনে নিই। তারপর ভেবে দেখি পরদিন কী কী কাজ আছে বা করতে হবে। ওপরে ওই দিনের তারিখটা দিয়ে সব কাজ ডায়েরিতে লিখে রাখি। ক্লাসের বাইরে যে সময়টুকু থাকে, তা কয়েক ভাগে ভাগ করে নিই। যেখানে ক্লাসের পড়ার পাশাপাশি কিছু আউট বই পড়া, পত্রিকা পড়া, খেলাধুলাসহ আরো কিছু কাজ অন্তর্ভুক্ত থাকে। যা করে আমি আনন্দ পাই। পরের দিন ডায়েরি দেখে দেখে একেকটা কাজ শেষ করতে থাকি এবং রাতে সব কাজ শেষ হয়েছে কিনা তা নিজে নিজে পর্যালোচনা করি। তারপর পরের দিনের কাজগুলো আবার ডায়েরিতে লিখে রাখি। এভাবে আমি আমার সময়গুলো নির্দিষ্ট পরিকল্পনার আলোকে অতিবাহিত করি। নাহিদ ফিরোজের কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। ফিরোজের কথা শেষ হলে নাহিদ বলল, আজ থেকে আমিও ডায়েরি লিখব এবং বিভিনড়ব বই পড়ব। ঠিক আছে বলে সেদিনের মতো দুজনেই ঘুমিয়ে পড়ল। পরেরদিন নাহিদ বাড়িতে চলে যাবার সময় ফিরোজ তাকে কিছু বই কিনে দিলো। নাহিদ বইগুলো নিয়ে বাড়িতে চলে যায় এবং তার জন্মদিনে বাবার গিফট করা ডায়েরিটা বের করে নিয়মিত ডায়েরি লেখা শুরু করে দেয়।

স্বাভাবিক নিয়মেই শাহিন একদিন নাহিদের বাড়িতে বেড়াতে গেল। বাড়িতে গিয়ে নাহিদের পড়ার টেবিলে বসতেই শাহিনের চোখ গিয়ে থামল নাহিদের ডায়েরির ওপর। অবশ্যই শাহিন আসবে জানলে নাহিদ ডায়েরিটা লুকিয়ে রাখত। শাহিন তাদের বাড়িতে প্রায় এলেও মাঝখানে বেশ কিছু দিন আসেনি। ডায়েরিটা খুলেই অবাক হলো শাহিন! গ্রীষ্মের ছুটির পর থেকে প্রতিটা দিন এবং প্রতিটা দিনের প্রতিটা কাজ নাহিদের ডায়েরিতে লেখা! এমনকি নাহিদ যে একদিন তাদের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল সেটাও তার ডায়েরিতে লেখা আছে! ডায়েরিটা যেন তার নিত্যদিনের প্রতিচ্ছবি! যা কিছু করে সব লেখা আছে ডায়েরিতে। শাহিন অবাক হয় এবং নাহিদের সাম্প্রতিক পরিবর্তনের কারণটি বুঝে যায়।

আজ নাহিদের কিছু ভাল্লাগছে না। সকালে নাশতা করার পর দুপুর পর্যন্ত আর কিছু খায়নি। দুপুরের খাবার না খেয়েই শুয়ে আছে সে। রসায়ন ছাড়া বাকি সব পরীক্ষা ভালো হয়েছিল নাহিদের। তবু রেজাল্ট নিয়ে টেনশন হচ্ছে। এবারের এসএসসি পরীক্ষার জন্য অনেক পরিশ্রম করেছে সে। রাত জেগে বেশি পড়ার কারণে মাঝখানে অসুস্থ হয়ে গিয়েছিল সে। মা অনেক বুঝানোর চেষ্টা করেছে তাকে। তবু যেন মনকে বুঝাতে পারছে না সে। চোখে একটু একটু ঘুম আসতে যাচ্ছিল এমন সময় নাহিদ নাহিদ বলে কয়েকটি আওয়াজ ভেসে এলো তার কানে। একবুক আশা নিয়ে দ্রুত উঠে দরজার দিকে আসতেই দেখতে পেল বাবাকে। বাবা দরজার সামনেই ছেলেকে পেয়ে হাসিমুখে তাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, তুমি গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছো!

শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়