আজকের দিনে দূর যাত্রার সহজ পদ্ধতি উড়োজাহাজ। এই উড়োজাহাজ আবিষ্কারের পিছনে রয়েছে অনেক গল্প। পাখিদের ডানা মেলে মুক্ত আকাশে উড়তে দেখে মানুষেরও আকাশে ওড়ার ইচ্ছা হয়েছে। মানুষের আকাশে ওড়ার এই চেষ্টা অনেক পুরানো। ‘ইবনে ফিরনাস’ মানুষের আকাশে উড্ডয়নের প্রথম যে প্রচেষ্টা, তার একজন সফল স্বপ্নদ্রষ্টা হিসাবে স্মরণীয় হয়ে আছেন। তাঁর উড্ডয়ন প্রচেষ্টা সম্পর্কে ঐতিহাসিক ফিলিপ কে হিট্টি তাঁর ‘হিস্ট্রি অফ আরব’ গ্রন্থে মন্তব্য করেন “ইবনে ফিরনাস প্রথম ব্যক্তি যিনি আকাশে ওড়ার জন্য বৈজ্ঞানিক ভাবে প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। তাঁর এই প্রচেষ্টাকেই বলা হয় আধুনিক উড়োজাহাজ আবিষ্কারের প্রথম ধাপ।”
ইবনে ফিরনাসের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে আল জাহুরী পরের শতকে আকাশে উড়তে চেষ্টা করেছিলেন। ১০০৭ খ্রিষ্টাব্দে আল জাহুরী তুর্কিস্তানের উলু মসজিদের ১০০২ ফুট উঁচু মিনার থেকে ঝাঁপ দিয়ে ওড়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু দুঃখজনক ভাবে তার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয় এবং তিনি নিচে পড়ে গিয়ে ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরণ করেন। এরপর ইংল্যান্ড ও চীনের অনেকেই আকাশে ওড়ার চেষ্টা করেও সফলতার দেখা পায় নি।
১৫০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে আব্বাস ইবনে ফিরনাসের উদ্ভাবিত উড্ডয়ন যন্ত্র থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে বিখ্যাত ইতালিয়ান শিল্পী ‘লিউনার্দো দ্য ভিঞ্চি’ আধুনিক উড়োজাহাজের নকশা এঁকেছিলেন। যদিও জীবদ্দশায় ভিঞ্চি সেই যন্ত্রের পরীক্ষামূলক ব্যবহার করতে পারেননি। ১৬৩০ খ্রিষ্টাব্দে ওসমানীয় শাসনামলে আহমদ সেলেবি ইস্তাম্বুলের গালাটা টাওয়ার হতে গ্লাইডিং করে তুর্কির বসফরাস পাড়ি দিয়েছিলেন। আহমদ সেলেবির সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে ১৬৩৩ খ্রিষ্টাব্দে লাগারি হাসান সেলেবি গান পাউডার দিয়ে রকেট বানিয়ে ইস্তাম্বুলের তোপকাপি প্রাসাদের নিকট সফলভাবে প্রায় ৩০০ মিটার উঁচুতে আকাশে উঠে যান। তার রকেটের জ্বালানি শেষ হয়ে গেলে বর্তমানের প্যারাসুটের মতো পাখার মাধ্যমে বসফরাসের পানিতে নেমে আসেন।
এরপর ১৭০০ সাল থেকে ১৯০০ সাল পর্যন্ত শতাধিক আকাশ ভ্রমণপিপাসু আকাশে ওড়ার চেষ্টা করেছিলেন। তাদের অনেকের প্রচেষ্টাই ইতিহাসে সমুজ্জল হয়ে আছে। অবশেষে ১৯০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের রাইট ভাতৃদ্বয় প্রথম উড়োজাহাজ নিয়ে সফল ভাবে আকাশে ওড়ার স্বীকৃতি অর্জন করেন। আর এ যুগে আকাশে ওড়া সহজ করে দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। আধুনিক বিজ্ঞানের এ যুগে শুধু আকাশে ওড়াতেই সীমাবদ্ধ নন, বরং তারা যাচ্ছেন মহাকাশেও।
ইবনে ফিরনাস। তাঁর আসল নাম ‘আব্বাস আবু আলকাসিম ইবনে ফিরনাস ইবনে ইরদাস আল তাকুরিনি’। তিনি ছিলেন একাধারে একজন আবিষ্কারক, প্রকৌশলী, উড্ডয়ন বিশারদ, চিকিৎসক, আরবি সাহিত্যের কবি এবং আন্দালুসীয় সুরকার। তিনি ৮১০ খ্রিষ্টাব্দে স্পেনের আন্দালুসের ইযন রেড ওয়াল্ডায় জন্ম গ্রহণ করেন। জ্ঞানার্জনের জন্য রেড ওয়াল্ডা থেকে তিনি কার্ডাভায় গমন করেন। এরপর তিনি বাগদাদে চলে যান। তখন বাগদাদের বাইতুল হিকমা ছিল মুসলিম জ্ঞান পিপাসুদের তীর্থস্থান। সেখানে তিনি বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেন এবং ফিরে এসে কর্ডোভায় বসবাস শুরু করেন।
ইতিহাসে আব্বাস ইবনে ফিরনাস প্রথম মানুষ যিনি এক জোড়া পাখা নিয়ে আকাশে উড়েছিলেন। তিনি প্রথম মানব বহনকারী ভারী যন্ত্র ক্ল্যাইডার তৈরি করেছিলেন এবং সফলভাবে উড্ডয়ন করেছিলেন, তাই তাকে আকাশে উড়ার পথ প্রদর্শক বলা হয়।
৮৫২ সালে ইবনে ফিরনাস আকাশে ওড়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। প্রথমে তিনি নিজেকে পালকে আবৃত করে নেন। এরপর শরীরে এক জোড়া পাখা যুক্ত করেন। তিনি আকাশে উড়ার জন্য স্পেনের কর্ডোভার একটি মসজিদের মিনারে ওঠেন। এরপর মিনার থেকে লাফ দেন। কয়েক মুহূর্ত তিনি উড়তে সক্ষম হলেও পরে মাটিতে পড়ে যান। মাটিতে পড়ে তিনি কোমর এবং পিঠে গুরুতর আঘাত পান। আঘাত পেলেও সেই মুহূর্তে তিনি প্রাণে বেঁচে যান। তবে তার পরিহিত পোশাক নিচের দিকে নামার গতিকে কমিয়ে দেয় বলে তেমন আঘাতপ্রাপ্ত হননি। এই ঘটনার পর তিনি উড্ডয়ন যন্ত্রটির আরও উন্নয়ন ও কার্যকারিতার প্রতি মনযোগ দেন। ধীরে ধীরে তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন।
ঐতিহাসিকদের মতে দীর্ঘ ২৩ বছর পর তাঁর বয়স যখন ৬৫ বছর, তখন তিনি আবারও আকাশে ওড়ার প্রচেষ্টা চালান। দ্বিতীয়বার উড্ডয়নের পূর্বে তিনি উড্ডয়ন যন্ত্রে কাঠ, পালক ও রেশমের কাপড় ব্যবহার করেছিলেন। ইবনে ফিরনাস বিশ্বাস করেছিলেন কিছুক্ষণ উড্ডয়নের পর পূনরায় একই স্থানে ফেরত আসতে পারবেন। তিনি তাঁর নতুন আবিষ্কৃত উড্ডয়ন যন্ত্র নিয়ে কর্ডোভার লুসাপা এলাকায় একটি উঁচু পাহাড়ে ওঠেন। জাবাল আল-আরুস নামক পাহাড়ের চূড়া থেকে তিনি ঝাঁপ দেন। কার্ডোভা থেকে অনেক মানুষ তাঁর আকাশে ওড়া দেখার জন্য ভিড় জমিয়েছিলেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, তিনি বেশ কিছুক্ষণ আকাশে উড়তে থাকেন। এরপর প্রবল গতিতে ভূ-পৃষ্ঠে অবতরণ করেন। প্রবল গতিতে ভূ-পৃষ্ঠে নামতে গিয়ে তিনি পুনরায় আঘাতপ্রাপ্ত হন। তিনি আবারও গুরুতর আহত হন। তিনি সফলভাবে উড়লেও একটি ভুল করেছিলেন। তাই অবতরণের সময় গতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। আঘাত পেয়েও ইবনে ফিরনাস হতাশ হননি।
তাঁর নকশায় কী ভুল ছিল তা নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু করেন। তাঁর ভুল শনাক্তকরণের প্রচেষ্টা চালান। ইবনে ফিরনাস পাখি ও অন্যান্য উড়ন্ত বস্তুর গতি বিধি নিয়ে গবেষণা করেন। তিনি বুঝতে পারেন, তিনি অবতরণের সময় গতি নিয়ন্ত্রণের জন্য যান্ত্রিক কোনো পদ্ধতি তাঁর নকশায় সংযোজন করেননি। তিনি পাখির ডানা এবং লেজের কার্যকারিতা নিয়েও পর্যালোচনা করেন। তিনি লক্ষ্য করেন, পাখি আকাশ থেকে অবতরণের সময় তার ডানা এবং লেজকে সমভাবে কার্যক্ষম রাখে, যার কারণে গতি নিয়ন্ত্রণশক্তি বৃদ্ধি পায় এবং পাখি সহজেই অবতরণ করতে পারে। কিন্তু ইবনে ফিরনাসের উড্ডয়ন যন্ত্রে গতি কমানোর কোনো প্রযুক্তি ছিলনা। তাই তিনি দুর্ঘটনায় পড়েন। তিনি তাঁর গবেষণায় এই বিষয়টির গুরুত্ব লিপিবদ্ধ করেন। তাঁর এই গবেষণার ফলে বিজ্ঞানীরা ‘অর্নিথপটার’ (পাখির মতো ডানা ঝাঁপটে আকাশে ভেসে থাকার একটি প্রযুক্তি) তৈরির পথ খুঁজে পেয়েছিলেন। বিংশ শতাব্দির এভিয়েশন ইঞ্জিনিয়ারদের বিমানের ডিজাইন তৈরির পেছনে ইবনে ফিরনাসের গবেষণার গুরত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। দ্বিতীয়বার আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার পর ইবনে ফিরনাস আরও প্রায় ১২ বছর বেঁচে ছিলেন। কিন্তু তাঁর পক্ষে আকাশে ওড়া আর সম্ভব হয়নি।
আব্বাস ইবনে ফিরনাস আকাশে উড্ডয়নের প্রচেষ্টার প্রথম সফল মানব হলেও বিজ্ঞানের অন্যান্য ক্ষেত্রেও তাঁর অনেক অবদান রয়েছে। তিনি আল-মাকাতা নামক জলঘড়ির আবিষ্কার করেছিলেন। এটি পানির শক্তি দ্বারা পরিচালিত ঘড়ি। স্ফটিক ও বালি দ্বারা কাচ তৈরির বিষয়ও তিনি গবেষণা করেছেন। যে কাচ এখনও ব্যবহার হয়ে আসছে। তিনি লেন্সও তৈরি করেছেন। ক্ষীণদৃষ্টি মানুষদের জন্য যে চশমা ব্যবহৃত হয় সেই কাচ তৈরিতেও ছিল তাঁর দীর্ঘ গবেষণা।
জ্যোতিবিজ্ঞান চর্চার আগ্রহ থেকে তিনি একটি যান্ত্রিক সৌরজগতের মডেল তৈরি করেন, যেখানে সকল গ্রহ-উপগ্রহ স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঘুর্ণয়মান ছিল। তাঁর একটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার হলো পাথরের স্ফটিক কাটার প্রক্রিয়া। স্পেন স্ফটিক কাটার জন্য মিশরের উপর নির্ভর ছিল। তাঁর এই আবিষ্কারের ফলে মিশরের উপর নির্ভরশীলতা থেকে স্পেন রেহাই পায়। তিনি নিজের বাড়ির একটি কক্ষে নক্ষত্র, মেঘ, বজ্র, আলোকপাত এসব দেখার ব্যবস্থা করেন। এটি ছিল তাঁর ভূগর্ভস্থ একটি যান্ত্রিক গবেষণাগার। এছাড়া তিনি বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে অসংখ্য বই রচনা করেন। তিনি কর্ডোভার সঙ্গীত বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসাবেও নিযুক্ত ছিলেন।
বিজ্ঞানজগতে তাঁর অবদান ও সাফল্যে তাঁকে ইতিহাসে মহাজ্ঞানী ব্যক্তির মর্যাদায় ভূষিত করা হয়েছে। ইরাকের বাগদাদ এয়ারপোর্টের নিকট রয়েছে তাঁর একটি বিরাট ভাস্কর্য। স্পেনের কর্ডোভায় একটি সেতুর নামকরণ করা হয়েছে এই দার্শনিকের নামে। চাঁদের একটি জ্বালামুখের নামও নামকরণ করা হয়েছে ইবনে ফিরনাসের নামে। এছাড়া ২০১৩ সালে ইংল্যান্ডের গাড়ী নির্মাতা প্রতিষ্ঠান রোলস রয়েলস একটি গাড়ীর সংস্করণ বের করে ‘ইবনে ফিরনাস মোটিভ’ নামে।
ধারণা করা হয়, এই মহাজ্ঞান বিশারদ ৮৯০-৮৯৫ সালের কোনো এক সময়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। অনেক ইতিহাসবিদের মতে, ক্রাশ ল্যান্ডিংয়ের সেই আঘাতজনিত অসুস্থতার প্রভাবেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ০