আর মাত্র দশদিন বাকি পবিত্র ঈদুল ফিতরের। চারদিকে ঈদ প্রস্তুতির একটা খুশির আমেজ বিরাজ করছে। রমজানের অর্ধেক যেতে না যেতেই নিতুর স্কুল ছুটি দিয়েছে। মাসখানেক পরেই তার সপ্তম শ্রেণির প্রথম সাময়িক পরীক্ষা। ঈদের ছুটি শেষ হলেই আবারও ব্যস্ততা শুরু হবে পড়াশোনা নিয়ে। তাই ছুটির দিনগুলো একটু উপভোগ করতে নিতু প্রতিদিন বিকেলে তাদের বাসার পাশের বড় খোলা মাঠটাতে খেলতে যায়। আশেপাশের শিশু-কিশোররা রোজ বিকেলে খেলতে আসে সেখানে। বড়রাও অনেকেই আসে, কেউবা শরীরচর্চা করতে, কেউবা বিকেলের অবসর সময় কাটাতে।
খেলার সময় নিতু প্রতিদিন মাঠে দুটো ছোট্ট মেয়েকে দেখে, দুজনের বয়স আট-নয় বছর হবে এমন। শুকনো মুখ, ময়লা মাখা ছেঁড়া জামা আর এলোমেলো চুলে কখনো মাঠে পড়ে থাকা ময়লা কাগজ টোকায়, কখনোবা বোতল টোকায়। আবার কখনো কখনো ফুলের মালা বিক্রি করে। নিতু ভাবলো আজ খেলা শেষে মেয়ে দুটোর সাথে কথা বলবে, কেন তারা ছোট্ট বয়সে এসব কাজ করে তা জানার জন্য। খেলা শেষে নিতু দেখলো মেয়ে দুটো মাঠ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। এদিকে ইফতারের সময়ও ঘনিয়ে আসছে প্রায়, তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে হবে। এজন্য নিতু সেদিন আর কথা বলতে পারলো না মেয়ে দুটোর সঙ্গে।
পরদিন নিতু মাঠে এসে দেখলো মেয়ে দুটো প্রতিদিনের মতোই বোতল কুড়িয়ে বস্তায় রাখছে। নিতু ওদের কাছে গিয়ে নাম জিজ্ঞেস করলে বড় মেয়েটা হাসিমুখে বললো আমার নাম হাসি, ও আমার ছোট বোন খুশি। বাহ্! তোমাদের নাম তো খুব সুন্দর, বলে নিতু মেয়ে দুটিকে আরও অনেক কিছু জিজ্ঞাসা করলো। অনেকক্ষণ কথা বলে নিতু জানতে পারলো ওদের বাবা নেই, একটা বস্তিতে মায়ের সাথে থাকে। মা অসুস্থতার জন্য কোনো কাজ করতে পারে না, তাই দুই বোন রাস্তায় পড়ে থাকা কাগজ, বোতল কুড়িয়ে সেগুলো বিক্রি করে, আর পাশের বাগান থেকে ফুল কুড়িয়ে ফুলের মালা বিক্রি করে। এভাবেই সামান্য উপার্জনের টাকা দিয়ে কোনোভাবে খেয়ে না খেয়ে জীবন পার করে ওরা। সবটা শুনে নিতুর খুব মায়া হলো হাসি খুশির জন্য। নিতু আবার জিজ্ঞাসা করলো তোমরা কি ঈদের জন্য নতুন জামা কিনেছো? কথাটা শোনামাত্র হাসির ছোট্ট বোন খুশি বললো আপা ঈদ কী? নতুন জামা কেন কিনতে হয় আপা?
ছোট্ট খুশির মুখের কথাটা শোনামাত্র নিতুর অনেক বেশি কষ্ট লাগলো, কষ্টে চোখের কোণে অশ্রæ চলে আসলো। কারণ ছোট্ট খুশি আজও জানে না ঈদের খুশি কী। নিতু বুঝতে পারলো হাসি খুশির মতো অসহায় শিশুদের জীবনে সারা বছর রোজা আসলেও ঈদ আসে না কখনই, আসে না ঈদের নতুন জামাও। নিতুর তখন মনে পড়লো সে তার বাবা মায়ের কাছে প্রতি ঈদে কতো কিছুই না আবদার করে, অথচ হাসি খুশির মতো অসহায় শিশুদের জীবনে ঈদ আনন্দ আসেই না কোনোদিন। এসব ভাবতে ভাবতেই হাসি খুশি আবার বস্তা হাতে নিয়ে অন্য দিকে চলে গেল। নিতুর সেদিন আর খেলায় মন বসলো না, তাই তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরলো। বাসায় এসে সারাক্ষণ ভাবতে থাকে ছোট্ট খুশির বলা সেই কথাটা, ‘আপা ঈদ কী, নতুন জামা কেন পরতে হয় আপা?’
দেখতে দেখতে ঈদ একেবারেই কাছে চলে এলো। আর তিনটা দিন পরেই পবিত্র ঈদুল ফিতর। তাই পরদিন শুক্রবার নিতুর বাবা মা নিতুকে নিয়ে ঈদের কেনাকাটা করতে যাবে বলে ঠিক করলো। নিতু ভাবলো কয়েক দিন আগে আমার মামা আর নানু ঈদ উপলক্ষে আমাকে যে টাকাগুলো দিয়েছে, সেগুলো দিয়ে আমি হাসি খুশির জন্য দুটো নতুন জামা কিনবো।
পরদিন নিতু তার বাবা মায়ের সাথে মার্কেটে গেল। নিজের পছন্দ মতো দুটো জামা নেয়ার পর নিতু আরও দুটো ছোট জামা চাইলো দোকানদারের কাছে। নিতুর মা অবাক হয়ে নিতুকে জিজ্ঞেস করলো এতো ছোট জামা তুমি কী করবে নিতু? নিতু বললো আমি আমার জন্য নিচ্ছি না মা, আমাদের বাসার পাশের বস্তিতে দুটো অসহায় মেয়ে আছে, ওদের বাবা নেই, অনেক গরিব ওরা। জীবনে কোনোদিন ওরা ঈদে নতুন জামা পরেনি। তাই আমার নানু আর মামা আমাকে যে টাকাগুলো দিয়েছে, সেগুলো দিয়ে আমি ওদের জন্য দুটো নতুন জামা কিনতে চাই। ওদের নতুন জামা দিতে না পারলে ঈদের দিন আমার অনেক খারাপ লাগবে। মেয়ের মুখে এমন কথা শুনে নিতুর বাবা মায়ের বুক গর্বে ভরে গেল সবার সামনে। তারপর তারা সুন্দর দেখে আরও দুটি ছোট জামা কিনলো। সবশেষে নিতুর বাবা মা নিজেদের জন্য কিছু কেনাকাটা করে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলো।
বাসায় এসে নিতু অনেক খুশি, হাসি খুশিকে ঈদে নতুন জামা দিতে পারবে ভেবে। পরদিন বিকেলে নিতু তার মায়ের থেকে জামাদুটো চাইলে নিতুর মা জামাদুটোর সঙ্গে নিজের একটা নতুন শাড়িও দিয়ে দেন হাসি খুশির মায়ের জন্য। নিতু আরও বেশি খুশি হয়ে একটা ব্যাগে করে কাপড়গুলো নিয়ে বেরিয়ে পড়লো বড় মাঠটার দিকে। মাঠে গিয়ে দেখলো হাসি খুশি প্রতিদিনের মতোই ফুলের মালা বিভিন্ন জনের কাছে বিক্রির চেষ্টা করছে। নিতু ওদের নাম ধরে ডাকতেই হাসি খুশি দৌড়ে নিতুর কাছে চলে এলো। নিতু বললো এই দেখো আমি তোমাদের জন্য নতুন জামা নিয়ে এসেছি, আর এই শাড়িটা তোমাদের আম্মুর জন্য। ঈদের দিন সকালে গোসল করে তোমরা এই জামাদুটো পরে মাঠে চলে আসবে, আমিও আসবো তোমাদের দেখতে। নতুন জামা পেয়ে হাসি খুশি আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল। জীবনে এই প্রথম ওরা ঈদে নতুন জামা পেল, খুশিতে ওদের মুখের কথাও আটকে আসছে বার বার। হাসি খুশি অনেক খুশি হয়ে কাপড়গুলো নিয়ে দৌড়ে ছুটে গেল বস্তির দিকে।
হাসি খুশির আনন্দ দেখে নিতুরও অনেক আনন্দ হলো। অতঃপর মনে মনে ভাবলো প্রতি ঈদেই সে তার জমানো টাকা দিয়ে হাসি খুশির মতো অসহায় শিশুদের মুখে হাসি ফোটাবে।