বাপ কা বেটা

সেলিম খান

0
43

ছেলেটির বয়স কত? কে জানে? বড়জোর চৌদ্দ পনেরো হবে। নাকের নিচে হালকা গোঁফের আভাস দেখে আমি বয়স আন্দাজ করেছি। ছেলেটির সঙ্গে আমার পরিচয় ভেড়ামারা হাইস্কুলের অপারেশনের দায়িত্বে থাকাকালীন। ছেলেটি আমার শহীদ সহযোদ্ধা গফুর ভাইয়ের নয়নের মণি পুত্রধন। সেই জুন মাসে জামালপুরের অপারেশনে গফুর ভাইয়ের সাথে প্রথম পরিচয়। ধীরে ধীরে সখ্য। গফুর ভাই যুদ্ধক্ষেত্রে তার ছেলের কথা বেশি বলত। ছেলের জন্য আমাদের আড়ালে চোখের জল ফেলত। তারপর জুলাই মাসের দিকে আমরা একটি অপারেশনে গিয়েছিলাম। আসলে জায়গার নাম ঠিকভাবে মনে নেই। চারদিকে ছিল আখক্ষেত। উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিম, সব দিকে শুধু আখক্ষেত। আর এই আখক্ষেতগুলোর মাঝখান দিয়ে চলে গেছে রেললাইন। আর ওপারে আছে ছোট্ট একটা প্ল­াটফর্ম।ওটা হানাদারদের গোপন অস্ত্র-ঘাটি। ওখানে পাহারায় আছে গোটা বিশেক আর্মি। আশ্চর্যের বিষয় হলো এই অস্ত্রঘাঁটিতে কোনো রাজাকার নেই। হয়তো হানাদাররা রাজাকারদের বিশ্বাস করে না। বিশ্বাস করবে কিভাবে, যারা দেশের সাথে বেঈমানি করতে পারে তারা তো ওদের সাথেও বেঈমানি করতে পারে। যাই-ই হোক ওই অস্ত্রঘাঁটির সব সৈন্যকে মারতে হবে। মারা তো বড় কথা নয় ওদের চমকে দিতে হবে। ওদের ভেতরে ভয় ঢুকিয়ে দিতে হবে। আমরা ছিলাম তিনজন। আমি, গফুর ভাই ও নানক কাকা। আমরা তিনজনই ভারত থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। আর আমি তো গ্রেনেড লক্ষ্য আঘাত করতে পারদর্শী। আমরা আখক্ষেতের ভেতরে নিরাপদ দূরত্বে পজিশন নিলাম। তারপর প্ল­ার্টফর্মের দিকে লক্ষ্য করে আমি দুইটা গ্রেনেড ছুড়ে মারলাম। ভয়ঙ্কর একটা বিস্ফোরণ হলো। ওদের এলএমজি গর্জে উঠল। আমরা কিছুক্ষণ চুপচাপ। ওদের গুলি চালানো বন্ধ হতেই গর্জে উঠল আমাদের হাতের স্টেনগান আর থ্রি নট থ্রি রাইফেল। বারবার অবস্থান পাল্টে গুলি করতে থাকলাম আমরা। হঠাৎ ওরা আমাদের দিকে লক্ষ্য করে মর্টার শেল নিক্ষেপ করতে শুরু করল। এমনিতেই শুকনো আখক্ষেত আর আখের পাতাগুলোও মচমচে শুকনো। মর্টারের বিস্ফোরণে আখক্ষেতে আগুন জ্বলে উঠল, একেবারে দাবানলের মতো। আমরা এত কিছুর পরও ওদের কোনো অংশে ছাড় দেইনি। অবস্থান পাল্টে গুলি চালিয়েই যাচ্ছি। অবস্থান পাল্টাতে গিয়ে হঠাৎ গফুর ভাই বুক বরাবর দুইটা গুলি খেলো। তারপর যেন মুহূর্তেই গুলির পর গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেল গফুর ভাইয়ের বুক। একটা গুলি কপালের মাঝ বরাবর লাগল। গফুর ভাইয়ের মাথার খুলি উড়ে গেল। ছিটকে বেরিয়ে এলো মাথার ঘিলু। কী বীভৎস! আমি সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে বারবার অবস্থান পাল্টে গুলি করতেই থাকলাম। আখক্ষেতে আগুন জ্বলছে। সেই আগুনে ইতোমধ্যে বেশ কিছু জায়গায় পুড়ে গেছে। তবুও আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে যাবো না। এবার নানক কাকাও গুলি খেলো। একটা গুলি একদম ডান চোখের ভেতরে, আর কয়েকটা গুলি বুকে। চোখটার দিকে তাকাতেই মনে হলো নানক কাকার চোখের ভিতরেই যেন স্বাধীনতার সূর্য উদিত হয়েছে। আমি হাল ছাড়লাম না। বারবার অবস্থান পাল্টে গুলি করতে
থাকলাম। আচমকা একটা গুলি এসে লাগলো আমার বাম কাঁধে। আর মাত্র দুই ইঞ্চি আগ-পিছ হলেই আমি শেষ। আমি আর অপেক্ষা করলাম না। কারণ শত্রুর হাতে ধরা পড়াটা খুব খারাপ হবে। আমি ওদের মুভমেন্টের আগেই গ্রেনেডগুলো নিয়ে দৌড় দিলাম। আর গ্রেনেডগুলো নিলাম এ কারণেই যে তখন আমাদের অস্ত্রের খুব সংকট। বহু কষ্টে বেজ ক্যাম্পে পৌঁছলাম। তারপর মাস দুয়েক চিকিৎসা চললো শরণার্থী হাসপাতালে। কিছুটা সুস্থ হওয়ার পর দায়িত্ব পেলাম আবার আরো একটি অপারেশনের। ভেড়ামারা হাই স্কুলের অপারেশন। ভেড়ামারা হাই স্কুল ছিল তখন হানাদারদের বেজ ক্যাম্প। ওই ক্যাম্প রেকি করতে যেয়েই ছেলেটির সঙ্গে আমার পরিচয়। ছেলেটি বড়ই মুখচোরা। কোনো বিষয়ে কৌতূহল নেই। যেন কোনো আকরিক পাথর দিয়ে ওর মনগড়া। নয়তো ওর মন অধিক শোকে পাথর হয়ে গেছে। ছেলেটির নাম নিশু। আমার শহীদ কমরেড গফুর ভাইয়ের নয়নের মণি পুত্রধন। আমি যখন ছেলেটিকে বললাম, তোমার আব্বা একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। ছেলেটি আমার দিকে কেমন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। মনে হয় শহীদ কিংবা মুক্তিযোদ্ধার মতো কঠিন শব্দের অর্থ ও বুঝতে পারছে না। আমি একটা বিষয় দেখলাম ও কোনো কিছু না বুঝলেও ওর জানার কোনো কৌতূহল নেই। আমি ওর ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে যা জানতে পারলাম তাতে আমার মনই পাথর হয়ে গেল। পাকিস্তানিরা ওদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে। নৃশংসভাবে হত্যা করেছে ওর মা ও দাদীকে। ক্যাম্পে তুলে নিয়ে গেছে ওর ষোলো বছরের বোনকে। আর ছেলেটিকেও তুলে নিয়ে এসেছে। কিন্তু ওর ফ্যালফ্যালে চাউনি দেখে ওকে বাঁচিয়ে রেখেছে। ও এখন হানাদারদের কামলা খাটে, বাজার করে ইত্যাদি। আমি ওর সঙ্গে কথা বলে, বন্ধুত্ব গড়ে, ওর বাবার পরিচয় দিয়ে প্রচুর গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আদায় করে নিলাম। যে পরিমাণে তথ্য নিশুর কাছে থেকে পেয়েছি তা আমরা বোধহয় রেকি করেও জোগাড় করতে পারতাম না। আমরা আমাদের আক্রমণের পরিকল্পনা সাজালাম। কিভাবে আক্রমণ করবো, কোন পথ দিয়ে ফেরত আসবো, কোন পথ দিয়ে আক্রমণে যাবো, এইসব। দিনটি ছিল বুধবার। সকাল থেকেই বৃষ্টি হচ্ছিল। সকাল থেকেই ভাগ্য আমাদের বিপরীতে ছিল। বেলা বারোটার দিকে আমরা আমাদের পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী আক্রমণ শুরু করলাম। কিন্তু ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল না। আমরা তো জয়ী হতেই পারলাম না বরং আমাদের দলের বারোজন সদস্যের মধ্যে দশজনই মারা গেল। কেউবা গুলি খেয়ে, কেউবা মর্টার শেলের আঘাতে। আমি ও আমার এক সহযোদ্ধা নান্টু মিয়া বহুকষ্টে বেঁচে গেলাম। নান্টু মিয়ার পেটে একটি এলএমজির গুলি লেগেছিল। পথে নান্টু মিয়া আর চলতে পারে না। আমি নিশুর সহায়তায় নান্টুকে বেজ ক্যাম্পে নিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু পথিমধ্যে নান্টু মারা যায়। হতাশায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়লাম আমি। আজ কি জবাব দেব কমান্ডার সাবকে। আমি তখন চোখে আকাশ পাতাল দেখছিলাম। বারবার বলতেছিলাম আল্লাহ তোমার বিচার নাই, আল্লাহ তোমার বিচার নাই। ঠিক তখনই নিশু একটি ভয়াবহ আবদার করে বসলো,
আমাকে বললো, আপনে শুধু আমাকে এই দুইটা আনারস দেন, আমি ওই ক্যাম্প উড়ায়া দিমু।
আমি বললাম নিশু এটা আনারস নয়, এটা গ্রেনেড।
আচ্ছা তাই হলো। আমাকে দুইটা গ্রেনেড দেন আপনি। ওই ক্যাম্প উড়ায়া দিমু।
নিশু তুমি কি পাগল হয়েছো?
হয় চাচা আমি পাগল হয়ে গেছিগা। ওরা আমার চোখের সামনে আমার মাকে মেরেছে, আমার দাদীকে মেরেছে, আমার বোনকে আটকে রেখে নির্যাতন করছে। আপনি বলেন এই সব দেখে কোনো ছেলের মাথা ঠিক থাকে। আপনি আমারে গ্রেনেড দিবেন কি না কন।
অবশ্যই দেবো। কিন্তু তার আগে তোমাকে গ্রেনেডের পিন খোলা শিখতে হবে।
হ শিখুম। আপনে শিখাইয়া দেন।
আমি নিশুর বুকের ক্ষোভ দেখে ওকে আমাদের ক্যাম্পে নিয়ে আসলাম। ও সাতদিনের ট্রেনিং নিল। শিখে নিল গ্রেনেডের কারিকুরি। তারপর পাঁচটি গ্রেনেড নিয়ে রওয়ানা হলো হানাদারদের ক্যাম্পের দিকে।
এক দিন যায়, দুই দিন যায় হানাদারদের ক্যাম্পের কোনো বিস্ফোরণের খবর পাওয়া যায় না। আমরা মনে করি নিশু ধরা পড়ে গেছে।
দুই দিন পর আমরা ওই ক্যাম্প পুনরায় আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিই। শুরু করি পরিকল্পনা। কিন্তু সেই পরিকল্পনা আর বাস্তবায়ন হয় না। কারণ তৃতীয় দিন আমরা খবর পাই কে বা কারা ভেড়ামারা হাই স্কুলের ক্যাম্পটি উড়িয়ে দিয়েছে। একজন সৈন্যও বেঁচে নেই। আমার তখন গফুর ভাইয়ের কথা মনে হলো। আর মনে হলো তারই সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা নিশুর কথা। সেদিন মনের অজান্তেই বলে উঠেছিলাম, বাপ কা বেটা।
পরে আর কোনোদিনই নিশুকে খুঁজে পাইনি। হয়তো সেদিন নিশুও শহীদ হয়েছিল ওর পিতার মতো।
দশম শ্রেণি, ভেড়ামারা পাইলট মডেল উচ্চবিদ্যালয়, কুষ্টিয়া