এলিয়েনের সাথে বন্ধুত্ব

মো. তামিম মাওলা

0
43
এলিয়েনের সাথে বন্ধুত্ব

অন্ধকার মহাকাশের বিশাল শূন্যতায় একদিন, হঠাৎ-ই ভোরের ঊষার মতো আলোকিত এক বিশাল বিস্ফোরণের ছটা দেখা গেলো। একটি জ্বলন্ত রকেটের ধ্বংসাবশেষ মহাকাশের পথে ছড়িয়ে পড়তে থাকলো। এক ভয়াবহ দুর্ঘটনার শিকার হয়ে রকেটটি মঙ্গল গ্রহের পাথুরে বুকে বিধ্বস্ত হলো। রকেটের একমাত্র আরোহী ক্যাপ্টেন রিয়াজ, একজন তরুণ মহাকাশবিজ্ঞানী, যাকে মহাকাশে পাঠানো হয়েছিল একটি বৈজ্ঞানিক মিশনে, সে আশ্চর্যজনকভাবে বেঁচে গেলো।
তবে এই বেঁচে থাকাকে আসলে বেঁচে থাকা বলা উচিত নয়। বরং তার মৃত্যুর ক্ষণটা একটু পিছিয়ে গেলো মাত্র। কারণ তার কাছে ছিল মাত্র ৫০ দিনের অক্সিজেন এবং খাবার। এর মধ্যে কিছু খাবার আবার পুড়েও গিয়েছিল। অথচ আশেপাশে কোনো প্রাণের অস্তিত্ব ছিল না, শুধু মঙ্গলের শুষ্ক, সুনসান মরুভূমি এবং সাথে নিয়ে আসা অল্প কিছু সরঞ্জাম।

রিয়াজ শীঘ্রই বুঝতে পারে যে, এই অবস্থা থেকে বেঁচে বের হওয়া খুব কঠিন। সে মঙ্গলের বুকে খাবার এবং পানি খুঁজে বের করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল। কিন্তু মঙ্গলের পরিবেশ এতটাই বিপজ্জনক যে, বেঁচে থাকাই তার জন্য কঠিন হয়ে পড়েছিল। গরম এবং ঠান্ডার মধ্যে ব্যাপক তফাৎ, অক্সিজেনের প্রবল সংকট, সবকিছুই রিয়াজকে কঠিনভাবে মোকাবেলা করতে হচ্ছিল।
কিছুদিন পরে সেখানে কিছু হিংস্র এলিয়েন চলে আসে যারা খুব ক্ষুধার্ত এবং মাংশাসী ছিলো। তারাও সেখানে মরিয়া হয়ে খাদ্য খুঁজছিলো। এতে রিয়াজের বেঁচে থাকাটা চরম হুমকির মুখে পড়ে যায়।

দিনগুলো একে একে ভয়ে ও নানা সংকটে চলে যাচ্ছিল। একদিকে এলিয়েনরা তাকে দেখতে পেলেই মেরে ফেলবে, আবার অন্যদিকে খাবারের মজুদও দ্রুত শেষ হয়ে আসছিল। সাথে অক্সিজেন সংকটও প্রকট হয়ে উঠছিল দিন দিন। সে জানত, এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে হলে তাকে কিছু একটা করতে হবে।

একদিন, খাবারের খোঁজে বের হওয়ার পর হঠাৎ তার চোখে পড়ল কিছু অদ্ভুত চিহ্ন, যেন কোনো অজ্ঞাত প্রাণী তার আশপাশে চলাফেরা করছে। সে তখন আরও কিছুটা সতর্ক হয়ে এগিয়ে গেল।
তিন দিন পর, এক রাতে হাঁটতে হাঁটতে সে হঠাৎ একটি অদ্ভুত গুহার সামনে এসে পৌঁছে। গুহার মধ্যে থেকে আলোর বিচ্ছুরণ ঘটছিলো। রিয়াজ সহসা বুঝতে পারে, এটি সাধারণ কোনো গুহা নয়; এর মধ্যে কিছু একটা রয়েছে। একটু ভয় ভয় লাগলেও সে আগ্রহ নিয়ে গুহার মধ্যে প্রবেশ করলো। ভিতরে ঢুকে সে দেখল এক বিশালাকার প্রাণী দাঁড়িয়ে আছে, যার শরীর ছিল রূপালি রঙের, অনেক উঁচু এবং শক্তিশালী। তার চোখে ছিল এক রহস্যময় দৃষ্টি। রিয়াজ অনেক ভয় পেয়ে যায় প্রাণীটিকে দেখে।

রিয়াজ ভয় পাচ্ছিলো যে, এলিয়েনটি তাকে আক্রমণ করবে না তো? তবে, এলিয়েনটির দৃষ্টি আক্রমণাত্মক ছিলো না। বরং তার চোখের দৃষ্টি যেন কিছু সংকেত দিচ্ছিল। তার চোখের ভাষা বলছিলো যে সে রিয়াজের সাথে কথা বলতে চায়। রিয়াজ কিছুটা সাহস বুকে নিয়ে আস্তে আস্তে একটু এগিয়ে গেল। এটা দেখে এলিয়েনটিও এগিয়ে এসে তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো এবং অদ্ভুত শব্দ করে সংকেত দিলো। সে বুঝতে পারে, এলিয়েনটি তাকে কিছু বলতে চায়, কিন্তু ভাষার সীমাবদ্ধতার কারণে বুঝাতে পারছে না। তবে এটুকু নিশ্চিত যে, এলিয়েনটি তার বন্ধুই হবে।

এরপর, রিয়াজ এলিয়েনটির সাথেই থাকলো কয়েকদিন। আস্তে আস্তে ইশারার মাধ্যমে তারা কথা বলতে থাকে। একপর্যায়ে এসে তারা শব্দ সংকেতের মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশ করতে থাকে। কয়েকদিনের মধ্যেই রিয়াজ এলিয়েনটি সম্পর্কে বেশকিছু তথ্য জেনে ফেলে।
এই এলিয়েনটির নাম থাক্স। সে মঙ্গলে একসময় একটি উন্নত সভ্যতার অংশ ছিল। তার জাতি মঙ্গলের এক প্রলয়ঙ্কর দুর্যোগে ধ্বংস হয়ে গেছে, এবং একমাত্র সেই বেঁচে গেছে। থাক্সের মধ্যে আছে এমনকিছু প্রযুক্তি, যা রিয়াজকে বেঁচে থাকার জন্য কিছু সাহায্য করতে পারে। এই অবস্থায়, তারা একে অপরের সহায়ক হয়ে উঠল। রিয়াজ শিখতে শুরু করল, কীভাবে মঙ্গলের শুষ্ক পরিবেশে বেঁচে থাকতে হয়, কীভাবে খাবার এবং পানির খোঁজ করতে হয়। থাক্স তাকে শিখিয়ে দিলো, কীভাবে মঙ্গলের গ্রহে বিভিন্ন ধরনের প্রয়োজনীয় উপকরণ খুঁজে বের করা যায়।

কিন্তু, সবচেয়ে বড় সমস্যাটি ছিল খাবার। রিয়াজের খাবারের মজুদ দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছিল, আর অক্সিজেনও তেমন অবশিষ্ট ছিল না। সে জানত, কিছু করতে না পারলে বাঁচার কোনো সুযোগ নেই। একদিন, যখন রিয়াজ খাবার খুঁজে বেড়াচ্ছিল, তখন থাক্স তাকে জানায় যে, তার কাছে একটি এলিয়েন প্রযুক্তি রয়েছে যেটা ইউ.এফ.ও. (UFO) নামে পরিচিত। এটি তাকে পৃথিবীতে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করতে পারে। তবে, এটি চালু করার জন্য কিছু ঝুঁকি নেয়ার প্রয়োজন। যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে যানটি নষ্ট হয়ে পড়ে রয়েছে। এখন ঠিক করার জন্য মেকানিকের যে নিরাপত্তাব্যবস্থা নেয়া লাগে, তা থাক্সের কাছে নেই। একটু সামান্য ভুলও যদি হয়, তবে দুজনের কেউই বাঁচবে না।

এক কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে রিয়াজকে। তার পৃথিবীতে ফিরে যাওয়ার জন্য তাকে তো বটেই, থাক্সকেও আত্মত্যাগ করতে হতে পারে। এদিকে তার খাবার শেষ, অক্সিজেনও শেষ। সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছিল। শেষ পর্যন্ত রিয়াজ সিদ্ধান্ত নিল, সে চেষ্টা করবে। চুপচাপ বসে বসে মৃত্যুর অপেক্ষা করার মধ্যে কোনো মাহাত্ম্য নেই। বরং মরতে হলে সে বীরের মতোই মরবে।
তারা একে অপরের দিকে তাকিয়ে কাজ শুরু করলো। কিছুক্ষণ পরই ইউ.এফ.ও.টি সচল হয়ে উঠলো। মুহূর্তের মধ্যেই একটি তীব্র আলো মঙ্গলের অন্ধকার বুকে যেন বিস্ফোরিত হলো। পরক্ষণেই রিয়াজ অনুভব করল যে সে মহাশূন্যে ভাসছে এবং পৃথিবীতে ফিরতে যাচ্ছে।

এক অদ্ভুত প্রশান্তি ফুটে উঠলো রিয়াজের মুখে। সে অনুভব করলো, মঙ্গলের মৃত্যুকূপ থেকে সে ফিরে আসতে পেরেছে একমাত্র বন্ধুত্বের শক্তির কারণেই। তার এলিয়েন বন্ধু থাক্স যদি তার জন্য জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত না হতো, তবে এতোক্ষণে হয়তো রিয়াজের মৃতদেহ পড়ে থাকতো মঙ্গলের বিরাণ বুকে। থাক্সের প্রতি কৃতজ্ঞতায় ভরে গেলো তার মন। হঠাৎ সে অনুভব করলো তার বুকপকেটে ধাতব কিছুর অস্তিত্ব। হাত দিয়ে দেখলো একটি লকেট, আর একটি ছোট্ট চিরকুট। চিরকুটে লেখা, “হে মানববন্ধু, যদি কখনও আমাকে মনে পড়ে, তাহলে লকেটটি মুখের সামনে ধরে মনের কথা খুলে বলবে। তোমার বার্তা পৌঁছে যাবে আমার কাছে।”
এক অজানা অনুভূতিতে শিউরে ওঠে রিয়াজের শরীর। হাতের মুঠোয় শক্ত করে চেপে ধরে লকেটটি। ০