
রোবট এখন আমাদের অতি চেনা। বিভিন্ন কাজে রোবট বা যন্ত্রমানব ব্যবহার করা হয়। এটা আবিষ্কৃত হতে অনেক সময় লেগেছে। শত শত বছর। রোবট আবিষ্কারের আগে স্বয়ংক্রিয় অনেক যন্ত্র আবিষ্কার হয়েছে। আর এই ক্ষেত্রে একজন মুসলিম বিজ্ঞানী অগ্রণী ভ‚মিকা পালন করেছেন। তাঁকে বলা হয় রোবটিক্সের জনক বা জনকস্থানীয়। তাঁর নাম ইসমাইল আল-জাজারি। তাঁর কথাই আজ বলছি।
জাজারি একজন বহুবিদ্যা বিশারদ। একজন আলিম, আবিষ্কারক, যন্ত্রকৌশলী, শিল্পী, গণিতবিদ ও রোবটিক্স। তাঁর অনেক পরিচয়। আর এত কিছু করেছেন তিনি আজ থেকে এক হাজারেরও বেশি বছর আগে। তিনি ১১৩৬ সনে মেসোপটেমিয়ার আল-জাজিরায় জন্মগ্রহণ করেন। সেখান থেকেই আল- জাজারি নামটির উপাধি পেয়েছেন। ইসলামের ইতিহাসে অষ্টম থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত সময়কে ইসলামের স্বর্ণযুগ বলা হয়। এই সময়ে মুসলিম বিশ্ব ব্যাপক বৈজ্ঞানিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অগ্রগতি সাধন করেছিল।
ইসমাইল আল-জাজারিকে রোবটিক্স বা স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের জনক বলা হয়। রোবটিক্স হলো প্রযুক্তির একটি শাখা, যা রোবটসমূহের ডিজাইন, নির্মাণ, কার্যক্রম ও প্রয়োগ নিয়ে কাজ করে। ১২ শতকে তার যান্ত্রিক সৃষ্টিগুলোকে ইসলামি স্বর্ণযুগের সবচেয়ে আশ্চার্যন্বিত যান্ত্রিক সৃষ্টি হিসেবে গণ্য করা হয়েছিল। তিনি ‘দ্য বুক অফ নলেজ অফ ইনজেনিয়াস মেকানিক্যাল ডিভাইস’ লেখার জন্য সর্বাধিক পরিচিত। যেখানে তিনি নিজের তৈরি ৫০টিরও বেশি যান্ত্রিক ডিভাইসের বর্ণনা দিয়েছেন। সেগুলো কীভাবে নির্মাণ করা হয়েছে তার বর্ণনাও দিয়েছেন। তাঁর আবিষ্কৃত মেশিনগুলো শুধু তাত্ত্বিক নয় ব্যবহারিকভাবেও ছিল ক্রটিমুক্ত। তার এই বইটি ছিল আধুনিক প্রযুক্তির দিক নির্দেশনা। ব্রিটিশ প্রকৌশলী “ডোনাল্ড আর হিল” এই বইটি সম্পর্কে বলেছেন আল-জাজারির সৃষ্টি কর্মগুলো বাদ দিয়ে আধুনিক প্রকৌশল বিদ্যার ইতিহাস রচনা করা সম্ভব নয়।
আল-জাজারির অন্যতম বিখ্যাত আবিষ্কার ছিল বিভিন্ন ডিজাইনের ঘড়ি। ঘড়ির ডিজাইনের মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হলো হাতির ঘড়ি। এটি ছিল প্রথম অটোমেশন ঘড়ি যা নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করে। এখানে একটি হিউম্যান রোবট একটি প্লেটে আঘাত করে এবং একটি যান্ত্রিক রোবট পাখি কিচিরমিচির আওয়াজ করে। এখানে একটি জল ঘড়ি আছে যা সময়ের সাথে সামঞ্জস্য রেখে সারাদিনের সঠিক সময় রেকর্ড করতে সক্ষম হতো। জল ঘড়ি একটি অটোমেটিক ঘড়ি যেটি আল- জাজারিরই আবিষ্কার। রাজপ্রাসাদে অতিথিদের সময় দেখার এবং বিনোদনের জন্য হাতি ঘড়িটি আবিষ্কার করা হয়েছিল। তিনি মোমবাতির মডেলেও ঘড়ি তৈরি করেছেন।
আল-জাজারি তুর্কিস্তানে রাজপ্রাসাদের প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
আল-জাজারির আবিষ্কৃত সবচেয়ে বড় ঘড়ি ছিল দুর্গঘড়ি। যাকে বলা হয় ‘ক্যাসল ক্লক’ যা ছিল একটি জটিল যন্ত্র। এটি ছিল ১১ ফুট উঁচু। টাইম কিপিং ছাড়াও এর অনেক কাজ ছিল। এতে রাশিচক্র, সৌর এবং চন্দ্র কক্ষপথের প্রদর্শন অন্তর্ভুক্ত ছিল। যন্ত্রটির বৈশিষ্ট্য ছিল অর্ধচন্দ্র আকারের একটি নির্দেশক। এটির আরেকটি বৈশিষ্ট্য ছিল স্বয়ংক্রিয়ভাবে সঙ্গীত বাজানো। আল জাজারি পানি দ্বারা পরিচালিত ঘড়ির উদ্ভাবন করেন। এটি পানির প্রবাহ দ্বারা পরিচালিত হতো। আল-জাজারির পানি চালিত এই ঘড়িটি ১৯৭৬ সালে লন্ডনের সায়েন্স মিউজিয়ামে সফলভাবে পূনঃনির্মাণ করা হয়েছিল।
আল জাজারি ছিলেন মুসলিম শাসন আমলের শ্রেষ্ঠ রোবটবিশারদ। তিনি সেকালে একটি যন্ত্রমানব তৈরি করেছিলেন। যেটিকে প্রাচীন কালের রোবট হিসেবে গণ্য করা হয়। সেটি ছিল ওয়াইন সরবরাহকারী একটি মেয়ে রোবট। তিনি স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিচালিত হাত ধোয়ার যন্ত্রও আবিষ্কার করেন। যেটি ব্যবহারকারীকে সাবান এবং তোয়ালে সরবরাহ করত। আল জাজারি তৈরি করেন ইঞ্জিনে ব্যবহৃত ক্রানক শ্যাফট এবং ক্রানক স্লাইডার। যা তিনি সিলিন্ডারে কানেকটিং রডের সাথে সংযুক্ত করেন। মেকানিজমটি একটি পিনিয়নের মাধ্যমে চাকার গতিকে বৃত্তাকারে ঘুরানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। ইহা ক্রমাগত ঘুর্ণন গতিকে একটি রৈখিক গতিতে রূপান্তরিত করে। আধুনিক যন্ত্রপাতি যেমন বাষ্পইঞ্জিন দহন বা জ্বালানী ইঞ্জিন এই ক্রান্ক শ্যাফটের মাধ্যমে গতিময় হয়। তিনি স্বয়ংক্রিয়ভাবে পানি উত্তোলনের পাম্প আবিষ্কার করেছেন। তাঁর পানি তোলার পাম্প যন্ত্রে ক্রানক স্লাইডার ব্যবহার করা হয়েছিল। তিনি একটি চেইন পাম্প তৈরি করেছেন যেটির মাধ্যমে কায়িক শ্রমের পরিবর্তে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালিত হয়ে পানি উত্তোলন করা হতো। আল-জাজারি গিয়ার এবং জল বিদ্যুৎ দ্বারা চালিত পানি সরবরাহের জন্য ও একটি পাম্প মেশিন আবিষ্কার করেন। যেটির মাধ্যমে কোনো কূপ বা হ্রদ থেকে প্রাসাদে, হাসপাতালে এবং মসজিদে পানি সরবরাহ করা হতো। আল-জাজারি জলবিদ্যুৎ দ্বারা চালিত স্বয়ংক্রিয় চলন্ত ময়ূর তৈরি করেছিলেন যা ছিল তামার তৈরি। আল-জাজারির তৈরি হিউম্যানয়েড অটোমেটা ছিল একজন ওয়েট্রেস- যে পানি, চা বা অন্যান্য পানীয় পরিবেশন করতে পারত। ইউরোপীয় রেনেসাঁর পথিকৃৎ ‘লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি’ আল-জাজারিকে ‘ক্লাসিক অটোমেটা’ উপাধি দিয়েছিলেন।
আল-জাজারি আধুনিক টয়লেটে ব্যবহৃত ফ্ল্যাশ মেকানিজম আবিষ্কার করেছেন। তিনি হাত ধোয়ারও অটোমেশন আবিষ্কার করেন। এটি একটি মানবমূর্তি যার বাম হাতে রয়েছে ময়ূরের মতো একটি কলস। আর ডান হাতে রয়েছে তোয়ালে, চিরুনি ও আয়না। এই মূর্তিটি তামা ও পিতল দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল। এই অটোমেটনটি রাজাকে সাহায্য করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছিল। আল-জাজারি ময়ূরের ডিজাইনে ঝরনা তৈরি করেছিলেন। যেটি রাজার হাত ধোয়া বা অজু করার জন্য ব্যবহৃত হতো। এটিও স্বয়ংক্রিয়ভাবে সাবান এবং তোয়ালে সরবরাহ করত।
আল-জাজারি তৈরি করেছেন স্বয়ংক্রিয় বাদ্যযন্ত্র বা মিউজিকাল রোবট। যা ছিল চারটি স্বয়ংক্রিয় সঙ্গীতজ্ঞের সাথে একটি নৌকা। যা রাজকীয় মদ্যপানের পার্টিতে অতিথিদের বিনোদন দেওয়ার জন্য একটি অটোমেটিক প্রোগ্রামবল ডিভাইস। এখানে ছিল কয়েকটি ছোট ছোট লিভার। যা বাদ্যযন্ত্রের উপর আছড়ে পড়ত এবং বাদ্যযন্ত্রগুলো বেজে উঠত।
আল-জাজারি ১০০ টিরও বেশি যন্ত্র আবিষ্কার করেছিলেন। একজন উদ্ভাবক এবং প্রকৌশলী হিসেবে আল-জাজারি তার কৃতিত্বের পাশা-পাশি একজন দক্ষ শিল্পীও ছিলেন। তিনি যেসব ডিভাইস বা যন্ত্র আবিষ্কার করেছেন সেগুলো তাঁর চিত্রকর্ম ব্যবহার করে চিত্রিতও করেছিলেন। আল-জাজারির তৈরি যন্ত্রের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল উন্নত মেকানিজম, উপাদান, ধারণা, সহজ পদ্ধতিতে ব্যবহার ও আকর্ষণীয় ডিজাইন। এই মুসলিম বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ও রোবটবিশারদ ১২০৬ সালে তুর্কিস্তানে মৃত্যুবরণ করেন। ০