ছবি তোলাটা তোমাদের অনেকের খুব পছন্দের কাজ। ছবি তোলার পর সেই ছবি ঘষামাজা করা, মানে যেটাকে এডিট করা বলে আর কি, সেটাও অনেকে খুব আগ্রহ নিয়ে করে থাকো নিশ্চয়ই। এমনকি এর জন্য অনেকে তো ফটোগ্রাফির কোর্সও করে থাকে। তো সেই ছবি যেই যন্ত্র দিয়ে তোলা হয়, সেই ক্যামেরা সম্পর্কে আমরা কতদূর জানি? মানে ক্যামেরা দিয়ে অথবা মোবাইলের ক্যামেরা ফাংশন দিয়ে ক্লিক করে ছবি তো তুলতে জানোই, কিন্তু এই পুরো ব্যাপারটা কীভাবে ঘটে, তা জানতে ইচ্ছে করে না? এই যে, তুমি কেবল একটা ক্লিক করলে, কিন্তু ছু মন্তর ছু করে কী চমৎকার ছবিটা উঠে যাচ্ছে, এমনকি অনেক সময় অন্ধকারেও ছবি উঠছে। এই ‘ছু মন্তর ছু’ এর আসল রহস্য কী? আজ চলো সেটাই জানার চেষ্টা করি।
শুরুতেই আমরা বুঝার চেষ্টা করবো, একটা ক্যামেরা কীভাবে কাজ করে। এজন্য এক্কেবারে সহজে জিনিসটাকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করবো আমরা। ক্যামেরা মূলত আমাদের চোখের অনুসরণে বানানোর চেষ্টা করা হয়েছে। এজন্য এটার কাজের সাথে আমাদের চোখ কীভাবে কাজ করে তার বেশ মিল আছে।
ক্যামেরার ব্যাপারে বলতে গেলেই প্রথমে আসে লেন্সের কথা। আমরা চোখের লেন্স দিয়ে যেমন দেখি, ক্যামেরাও তার লেন্স দিয়ে দেখে। তোমরা তো অনেকেই জানো আমাদের চোখ কীভাবে দেখতে পায়। খুব সহজে বললে কোনো বস্তু থেকে আলো প্রতিফলিত হয়ে আমাদের চোখে এসে পড়লে তখনই আমরা ঐ বস্তুটিকে দেখতে পাই। একারণে অন্ধকার ঘরে সাধারণভাবে যেহেতু কোনো বস্তু আলোকিত থাকে না, তাই আমরাও ওখানে কিছু দেখতে পাই না। একইভাবে ক্যামেরার লেন্সেও কোনো বস্তুর আলো প্রতিফলিত হয়ে এসে পড়লে, সে আলো গ্রহণ করার ব্যবস্থা থাকে।
তুমি একটা বদ্ধ অন্ধকার ছোট রুমের কথা কল্পনা করো। এই ঘরে শুধু একপাশে একটা দরজা আছে। আর কোনো দিক দিয়ে এখানে আলো প্রবেশের সুযোগ নেই। কোনো ঘরের দরজা কি সবসময় খোলা থাকে? থাকে না। তেমনিভাবে এই ক্যামেরাঘরের দরজাও স্বাভাবিকভাবে বন্ধ থাকে। এই ঘরের দরজায় একটা স্মার্ট পর্দা আছে। এটাকে প্রয়োজনমতো বড় ছোট করা যায়। এছাড়া এই ঘরে দরজার উল্টোদিকে আছে একটা জাদুকরি আয়না। এই আয়নায় যা-ই দেখা যাবে, তাই রেকর্ড করে ফেলা যায়।
অনেক হলো হেয়ালি কথাবার্তা। এবার চলো সরাসরি ক্যামেরায় ফিরে যাই। এই ছোট্ট বদ্ধ অন্ধকার রুমটা হলো ক্যামেরা। খেয়াল করে দেখবে, ক্যামেরায় লেন্সের দিক ছাড়া অন্য কোনো দিক থেকে আলো প্রবেশের সুযোগ থাকে না। আর লেন্সের ঐ জায়গাটায় হলো ক্যামেরার সেই একপাশের দরজার খোলা জায়গা। অবশ্য খোলা থাকে না। বিভিন্ন ধরনের গ্যাস দেয়া থাকে সেখানে, সে আলাপে আমরা পরে আসছি। তো এই লেন্সের ফুটোয় দরজার মতো যে জিনিসটা কাজ করে, তাকে বলা হয় শাটার। আর দরজায় সেই স্মার্ট পর্দা হলো অ্যাপাচার, এটা দিয়ে আলো প্রবেশের সময় একে প্রয়োজনমতো বড় ছোট করা যায়। আর লেন্সযুক্ত দরজার উল্টোপাশে থাকে সেন্সর, যাকে আমরা একটু আগে জাদুকরি আয়নার সাথে তুলনা করেছি। আর তার সাথে এখন থাকে ভিউ ফাইন্ডার, অর্থাৎ মনিটরের মতো যেদিক দিয়ে আমরা যে বস্তুর ছবি তুলছি, তা দেখতে পাই।
এ হলো ক্যামেরায় কী আছে, তার বিবরণ। তাহলে এটা কীভাবে কাজ করে? স্মার্টফোন, ডিজিটাল ক্যামেরা অথবা ডিএসএলআর। ব্যাখ্যাটি কিন্তু মোটামুটি একই রকম। বিষয়টি সহজভাবে ব্যাখ্যা করা যাক।
স্মার্টফোনের ক্যামেরায় ব্যবহৃত লেন্সটি আমরা যে বস্তু বা বিষয়ের ছবি তুলতে চাইছি তার দিকে ফোকাস করে।
প্রকৃতি থেকে আলো ক্যামেরার লেন্সে প্রবেশ করে।
লেন্সের অ্যাপাচার প্রবেশ করা আলোর পরিমাণ নির্ণয় করে।
শাটার সেন্সরটি ঠিক কতটা সময় আলোর সংস্পর্শে ছিল- এই বিষয়টি পরিমাপ করে।
সেন্সরটি ব্যক্তি, বিষয় বা বস্তুর একটি ছবি প্রাথমিকভাবে ধারণ করে।
ক্যামেরার সামগ্রিক হার্ডওয়্যার বিভাগ ছবিটি নিয়ে কাজ করে এবং চূড়ান্তভাবে ছবিটি প্রদর্শন করে।
পুরো প্রক্রিয়াটি মূলত পদার্থবিদ্যার কয়েকটি ধাপ অনুসরণ করে সম্পন্ন হয়। কিন্তু ক্যামেরায় ব্যবহৃত লেন্স, সেন্সর এবং অ্যাপাচারের আকার-আয়তনের ভিন্নতার কারণে উপরে উল্লেখিত ধাপগুলোর দুই থেকে চার পর্যন্ত ধাপগুলো স্মার্টফোনভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। লেন্স, সেন্সর, এবং অ্যাপাচারের আকার-আয়তনের ভিন্নতার কারণে লেন্সের মধ্যে আসা আলোর পরিমাণে তারতম্য ঘটে এবং এই কারণে ছবির বৈশিষ্ট্য এবং গুণাগুণে পার্থক্য দেখা যায়।
এখন আজকের দিনের যত আধুনিক আর পাওয়ারফুল ক্যামেরা আমরা দেখতে পাচ্ছি, সেটা তো আর হুট করে একদিনে আসমান থেকে নাজিল হয়ে যায়নি। দীর্ঘদিন ধরে প্রযুক্তির ঘষামাজা হয়ে এই অবস্থায় এসেছে। ক্যামেরার এই জার্নিটা সম্পর্কে জানা যাক এবার।

পৃথিবীর প্রথম ক্যামেরার নাম কি জানো? ক্যামেরা অবস্কিওরা। এই ল্যাটিন শব্দের অর্থ হলো অন্ধকার রুম। ১০২১ সালে আরব বিজ্ঞানী আল হাইসাম প্রথম এইরকম একটা ধারণার ব্যাপারে তার বই ‘কিতাব আল মানাযির’ এ লেখেন। উনাকে তাই ক্যামেরার অগ্রদূত বলা হয়। তবে এর আগে ৪০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে চীনা দার্শনিক মোজির লেখায় আর ৩৩০ খ্রিষ্টাব্দের গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটলের লেখায় এর আংশিক ধারণা দেখা যায়। এটি ছিল মূলত একটি অন্ধকার বক্স, যার একপাশে ছোট্ট একটা ছিদ্র দিয়ে আলো প্রবেশ করতে পারতো। সেই আলো উল্টোদিকে গিয়ে তার একটা প্রতিবিম্ব তৈরি করতো। তবে শুরুর দিকে এই প্রতিবিম্ব সংরক্ষণের সুযোগ ছিল না। তাই দেখে দেখে কেবল ছবি এঁকে সংরক্ষণের কোনো বিকল্প ছিল না। এরপর ১৮২৭ সালে ফরাসি বিজ্ঞানী জোসেফ নিসেফোর নিপ্স বিশেষ প্রক্রিয়ায় ছবি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেন। তবে এতে একেকটি ছবি তৈরি হতে সময় লাগতো প্রায় ৮ ঘণ্টা, আবার এ ছবি খুব তাড়াতাড়ি উঠান হয়ে যেতো।

উপরের লেখা পড়ে বুঝতেই পারছ, এরকম যন্ত্র কেউ খুব একটা কিনতে চাইবে না। মানুষ কিনতে পারার মতো প্রথম যে ক্যামেরা তৈরি হয়, তার নাম ছিল দাগেরোটাইপ। ১৮৩৯ সালে এটি তৈরি করেন ফ্রান্সের ল্যুইস দাগের। এতে একটা ছবি তুলতে ৩০ মিনিট মতো সময় লাগতো, আর ছবি তুলনামূলক বেশ দীর্ঘস্থায়ী হতো। কিন্তু দাগেরোটাইপ দিয়ে যে ছবি তোলা হতো, তার কোনো নকল কপি বের করা যেতো না। মানে একটাই ছবি হতো। মজার ব্যাপার হলো এ সমস্যা সমাধানের জন্য বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি। মাত্র ২ বছর পর ১৮৪১ সালে ইংরেজ গণিতবিদ উইলিয়াম হেনরি ফক্স টালবোট ক্যালোটাইপ ক্যামেরা তৈরি করেন। তার ক্যামেরা থেকে নেগেটিভ কপি বের করা যেতো, এ দিয়ে পরে আরো কপি করা যেতো।
বর্তমান সময়ে ক্যামেরার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো ফ্ল্যাশলাইট। ফ্ল্যাশলাইট আসার আগে ছবি তোলার জন্য প্রায় পুরোপুরিভাবেই সূর্যের আলোর উপর নির্ভর করতে হতো। ১৯২৫ সালে অস্ট্রিয়ান বিজ্ঞানী পল ভিয়েরকটার প্রথম ম্যাগনেসিয়ামকে বৈদ্যুতিকভাবে জ্বালান গ্যাস গ্লোবের মধ্যে। পরে ১৯৩০ সালে জার্মান কোম্পানি হাউজারের মাধ্যমে বাণিজ্যিকভাবে ফ্ল্যাশলাইট বাজারে আসে।
ক্যামেরার প্রযুক্তি যখন বিভিন্ন লেন্সের বৈচিত্র্য, আরো জটিল উন্নয়ন নিয়ে ব্যস্ত, তখন ১৯৪৮ সালে পোলারয়েড কর্পোরেশন বাজারে আনে এক নতুন ধাঁচের ক্যামেরা। ‘ল্যান্ড ক্যামেরা ৯৫’ নামের তাদের এই নতুন ক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলার এক মিনিটের মধ্যেই ইন্সট্যান্ট ছবি প্রিন্ট করে দিতো। শুরুর দিকে এটি শুধু সাদা কালো প্রিন্ট দিলেও ১৯৬৩ সালের দিকে রঙিন ছবিও এই সিস্টেমে প্রিন্ট করা যায়, এমন ক্যামেরা বাজারে আনে কোম্পানিটি। দীর্ঘদিন বেশ জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে পারলেও ডিজিটাল ক্যামেরার আগমনের পর ধীরে ধীরে এই ক্যামেরাগুলোর জনপ্রিয়তা কমে যায়।
আজকের দিনে যে ডিজিটাল ক্যামেরা বা ডিএসএলআর নিয়ে এত মাতামাতি, সেই ডিএসএলআর ক্যামেরার যাত্রা শুরু ১৯৭৫ সালে। এতে প্রথমবারের মতো মেমোরি কার্ড ব্যবহার করা শুরু হয়। অবশ্য সাধারণ মানুষের হাতে আসতে লেগে যায় ১৯৯০ সাল পর্যন্ত। প্রথম বাজারে বিক্রি হওয়া ডিজিটাল ক্যামেরা ছিল ডি ওয়াই ক্যাম মডেল ১।
হাল আমলে ছবি তোলার প্রধান অস্ত্র তো মোবাইল। এই কথা বলার যন্ত্র মোবাইলে ক্যামেরা ঢুকে পড়লো কখন? ২০০০ সালে জাপানের মোবাইল নির্মাতা প্রতিষ্ঠান জে ফোন প্রথম এই কাজ করে। তাদের প্রথম ক্যামেরা ফোনের নাম ছিল শার্প জে এসএইচ জিরো ফোর। তুমি কি আন্দাজ করতে পারো, এই প্রথম মোবাইল ক্যামেরা কত মেগাপিক্সেলের ছিল? থাক, বলে দিচ্ছি। এর ক্যামেরা ছিল .১ মেগাপিক্সেলের। যাই হোক, একইবছর বাজারে আসে স্যামসাং এর ক্যামেরা ফোন এসসিএইচ-ভি৪০০।

২০১৮ সালের জানুয়ারিতে গুগলের এক নতুন প্রযুক্তির ক্যামেরা বাজারে এসেছিল, একে বলা হতো, ‘ক্লিপস’। এ ক্যামেরা ছিল এআই ক্যামেরা। এই ক্যামেরা নিজে নিজে ছবি তুলতে পারতো। ধরো, তুমি একটা চমৎকার দৃশ্য দেখলে। সেটা হতে পারে কোনো শিশুর চমৎকার হাসি অথবা পোষা বিড়ালটির মজার কোনো কান্ড। তুমি সেই মুহুর্তটি ক্যামেরাবন্দি করতে চাইলে। কিন্তু খুব বেশি সম্ভাবনা এই যে, মোবাইল ফোন বের করে ক্যামেরা চালু করতে করতেই মুহুর্তটি শেষ হয়ে যাবে এবং তুমি চমৎকার একটি দৃশ্য ধারণ করতে মিস করে ফেলবে। ঠিক এই সমস্যাটিরই সমাধান হিসেবে বাজারে এসেছিল ক্লিপস। মানুষ কোন ধরনের ছবি তুলতে পছন্দ করে এ ব্যাপারে প্রায় ৩ বছর ধরে প্রশিক্ষণ দেয়া হয় একে। এটি কোনো জায়গায় সেট করে অন করে রাখলে এরপর এই ট্রেনিং কাজে লাগিয়ে নিজে নিজে ৭ সেকেন্ডের সাউন্ডবিহীন ভিডিও
ক্লিপগুলো রেকর্ড করতো। আইডিয়াটা বেশ মজার লাগলেও এই ক্যামেরা খুব কম সময়েই মার্কেটে তার চাহিদা হারিয়ে ফেলে। কারণ কেউই চায় না, তার অজান্তে কিছু রেকর্ড হোক। আর এই ক্যামেরা সবসময় অন থাকার কারণ প্রাইভেসি নিয়ে খুবই আপত্তি উঠছিল। ফলে পরের বছর ২০১৯ এর অক্টোবরেই এই প্রোডাক্টটি মার্কেট থেকে তুলে নেয়া হয়।
ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম প্রভৃতিতে ছবি পোস্ট করতে অনেকেরই বেশ পছন্দ। তুমি কি জানো প্রতিদিন এরকম কতগুলো ছবি ইন্টারনেটে আপলোড করা হয়? সংখ্যাটা প্রায় ৩.২ বিলিয়ন বা ৩২০ কোটির মতো। মজার ব্যাপার হলো, এখন পর্যন্ত এ যাবতকালের সবচেয়ে বেশি লাইক পাওয়া ছবিটি হলো একটা ডিমের ছবি। সারা দুনিয়ার খাদ্য তালিকায় উপর দিকে থাকার পাশাপাশি লাইক পাওয়ার কাতারেও দেখো ডিম জায়গা করে নিয়েছে।
ক্যামেরা নিয়ে একটা বিখ্যাত ধাঁধাঁ দিয়ে আজকের লেখাটা শেষ করি। প্রথম ক্যামেরার ছবি কোন ক্যামেরা দিয়ে তোলা হয়েছিল? প্রথমে শুনলে মনে হয়, আরে, তাই তো! তখন আর ক্যামেরা ছিল নাকি? ব্যাপারটা আসলে মোটেও এমন না। তুমি জাদুঘরে অনেক হাজার বছরের পুরনো জিনিস দেখেছ না? এই জিনিসের ছবি তোলার জন্য কি সেই হাজার বছর আগে ক্যামেরা থাকার দরকার ছিল? না। বরং জিনিসটা থেকে গেলে এখনকার লেটেস্ট ক্যামেরা দিয়েও তার ছবি তোলা যাবে। একই কথা সেই ক্যামেরার জন্য প্রযোজ্য। সিম্পল না? তো বন্ধুরা, তোমাদের নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানিয়ে শেষ করছি। আল্লাহ হাফেজ। ০