হিম হিম শীত শীত

মুহাম্মদ ইসমাঈল

0
278

ছয়টি ঋতুর দেশ আমাদের এ দেশ। সুজলা, সুফলা, শস্য শ্যামল আমাদের সোনার বাংলাদেশ। আসলেই আমাদের দেশে সোনা ফলে।
হিম হিম শীত শীত নিয়ে আমাদের দেশের কবি সাহিত্যিকরা অনেক কবিতা লিখেছেন। শীতের উদ্ভিদ, শিশির বিন্দু, অস্থির নক্ষত্র, শীতের সেবা, শীতের চাদর, শীতের কার্ডিগান, শীতের ডেনিম শার্ট, ডেনিম প্যান্ট, ডেনিম বেল্ট, এমনকি ডেনিম জুতাও আছে। শীতের আগুন পোহানো তখন কী যে আকর্ষণ করতো। শীতের সকাল মুগ্ধ করে ফেলতো আমাকে, শীত ছিল সেখানে হাঁসের পায়ের মত নরম। কিন্তুু আজ বুঝি শীত কি নিদারুন, কী কষ্ট, শীতের মধ্যে কী একাকিত্ব, কী নিঃসঙ্গতা, শীতের দেশে যারাই থাকেন তারা ছাড়া শীতের এত অনুভব কেউ করতে পারে না। শীত নিয়ে একসময় কত যে রোমান্টিকতা ছিল, এখন শীতের বাস্তব রূপ দেখি। মনে হয় কোটি কোটি বরফ সমুদ্রের নিচে পড়ে আছে। বরফে ঢাকা চারদিক। বৃক্ষ সাদা, পথঘাট সাদা, পাহাড় সাদা, হৃদের জল, নদীর জল, কঠিন বরফ। বরফেই ছেয়ে আছে যেন আকাশ, সারা প্রকৃতি। এই বরফের পৃথিবীতে না থাকলে বোঝা সম্ভব নয় শীত কী, শীত কেমন। একদিন শীতকে মনে হতো কোমল মাধুর্যময়। আজ মনে হয় রুক্ষ কঠিন, যেন পাথর। মাটি নেই, তৃণ নেই, যতদূর চোখ যায় দেখি বরফবৃক্ষ, বরফবীথি। শীতকাল যে কত নির্জন নিঃসঙ্গতায় বিধুর হতে পারে। তা শীতের দেশে বাস করলেই কেবল অনুভব করা যায়।

মনে হয়, পৃথিবী জোড়া এখন শীতকাল। সবখানেই শীতের প্রকৃতি। শীতের এই সুদূর ভীষণ কঠোর তাড়না সবখানেই ঠা-া বরফ। পৃথিবী জুড়ে বোধহয় মানুষের বরফের মন আরো শীতল।

একটি ইংরেজি কবিতা পড়েছিলাম :
Blow, blow, thou winter wind.
Thou art not so unkind
এখন এই রূপ নিজের চোখে দেখতে পাচ্ছি। সিলভিয়া প্লাথ যে বছর গভীর দুঃখ বেদনা ও নিঃসঙ্গতায় আত্মহননের পথ বেছে নেন, ঢেউ ঢেউ হিউজের কাছ থেকে তখন তিনি দূরে।

সে বছর ইউরোপ-আমেরিকাজুড়ে ছিল প্রচন্ডতম শৈত্যপ্রবাহ, মানুষের জীবন দুর্বিষহ। তারই মধ্যে এই বেদনা কাতর কবি নিঃশব্দে আত্মহননের পথ বেছে নেন। শীত কি তাকে আরও নিঃসঙ্গ করে ফেলেছিল। আরও এলোমেলো, আরো উন্মাদগ্রস্থ, কে জানে ।

আমরা শৈশবে, কৈশরে কী মনোরম শীত দেখেছি। শীতের নরম রোদ, খেজুরের রস, পাটালি গুড়, ভাপা পিঠা, গোটা পিঠা, ভিজানো পিঠা, পিঠে পায়েসের গন্ধ, শীতের ফুল ভোলা যায় না।
শিমুল ফুলের কথাও ভোলা যায় না। আমার মনের মধ্যে শৈশবের সেই শীতকাল এখনো আছে। কী মনোরম শীত। শীত নিয়ে বাংলায় খুব বেশি কবিতা নেই। বুদ্ধদেব বসু শীতের কথা উল্লেখ করেছিলেন। শীত তার বইয়ের নামের মধ্যেও আছে।

শীতের গন্ধ পাওয়া যায় জীবনানন্দদাশের কবিতায়। এত স্পষ্ট, এত শীতের রূপ আর বোধহয় বাংলা কবিতায় তেমন চোখে পড়ে না। শীত ঋতু নিয়ে রবীন্দ্রনাথ মাত্র কয়েকটি গান লিখেছিলেন। আমি আমার কবিতা ও গানে শীত ঋতুকে অনুভব করার চেষ্টা করছি।
সেই শৈশবের শীতকাল, ভোরের রোদে বসে শীত শিহরণ, শীত উপভোগ, শীতের সবজি, শীতের উদ্ভিদ আমাদের বাল্য কৈশরের স্মৃতিতে জড়িয়ে আছে। আরো জড়িয়ে আছে, ভোরে ফজরের আযানের পূর্বে বাবার সাথে হোগরা টানতে যাওয়া (মাছ মারার এক প্রকার বাঁশের জাল) ডাকাতিয়া নদীতে।

সকালের ঘুম ভাঙতে চায় না। তারপরও বাবার আদেশে একসাথে পেককাদা হাটু পরিমাণ গড়িয়ে হোগরা টানতে যাওয়া। এই তীব্র শীতের মধ্যে।

শান্তি লাগতো তখনি যখন দেখতাম সরপুটি, শৈল, পাবদা, পুটি, টাকি ইত্যাদি মাছ ডুলা ভরে গ্যাছে। তখন ঠা-াটা তেমন আর লাগতো না।

যদিও তখন আমাদের দেশে শীত আরো তীব্র ছিল। শীতে প্রতি বছরই মানুষ মারা যায় সেই উত্তরবঙ্গে। সুকান্ত ভট্টাচার্য এই শীতপীড়িত মানুষের জন্য উত্তাপ চেয়েছিলেন।

আমি এখন বুঝি শীত কেমন দুঃসহ, মানুষ শীতে কত অসহায় হয়ে পড়ে, একা হয়ে পড়ে। শীতের দেশগুলোতে এক সময় মানুষের দুর্দশার শেষ ছিল না। শীতবস্ত্র সংগ্রহ করতে পারতো না সাধারণ মানুষেরা। এখন সেদিন নেই। এই বৈরী প্রকৃতি জয় করেছে শীতের দেশের মানুষ। এই কঠিন শীতের মধ্যেও সচল তাদের জীবন প্রবাহ, তাদের কর্মধারা। আমি জানতাম না জীবনের এক পর্যায়ে আমাকে শীতের দেশের নির্জনতা, একাকিত্বের মধ্যে জীবন কাটাতে হবে।

শেষ বয়সে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একবার দুঃখ করে বলেছিলেন, এবার পশ্চিমে দেশে গিয়ে আমি গানের গলা হারিয়ে এসেছি। শীত মানুষকে বড় একা করে দেয়। শীতে সে বড় একা, সে বড় নিঃসঙ্গ, নির্জন, আমি আমাকে নিয়ে টের পেয়েছি, পাশে কেউ নেই। যারা এক সময় কাছে ছিল তারাও নেই। বছরের পর বছর শীত আসলে একা। বরফের নদীর মতো। এমন শীত আমি দেখতে চাইনি। পৃথিবী এই শৈত্য কাটিয়ে জেগে উঠবে। তার অবসাদ, তার নিদ্রা, তার আচ্ছন্নতা কেটে যাবে। মানুষের সেই আলোকিত জীবনের দিকে আমি তাকিয়ে আছি। পৃথিবীর ছিন্নমূল মানুষেরা তাকিয়ে আছে সবাই।