অশ্রুজলে ধোয়া

আনোয়ার হোছাইন

0
105

খাবার টেবিলে খেতে বসে মাথাটা রেগে টং হয়ে যায় মাহির। তার যত অপছন্দের খাবারের সমাবেশ সেখানে শাক, সবজি, মাছ। দেখেই চোখ ফেটে জল এসে যায় তার। আচ্ছা, মামণিটা এমন কেন? কোন বিষয়ে তার পছন্দ-অপছন্দের কানাকড়ি মূল্যও তার কাছে নেই? শাক, সবজি, মাছ, দুধ এসব ছাড়া কি পৃথিবীতে খাবার মতো কিছুই নেই? সে কি গরু যে, প্রতিবেলা তাকে নিয়ম করে কচ কচ করে ঘাস, লতাপাতা চিবাতে হবে? মাছ খেতে তার কেমন এক অসহ্য গন্ধ লাগে, অথচ বিড়ালের মতো প্রতিদিন মাছ খাবার জন্য তাকেই করা হবে জোরাজুরি? যে দুধের গন্ধে তার বমি এসে যায়, সেটা খেতে না পারলে কিনা মামনির বাক্যবাণ ঝরতে থাকে কুয়াশাচ্ছন্ন শীতের রাতে শিশির ঝরার মতো? অসহ্য! একেবারেই অসহ্য! কোন মা কি তার ছেলের প্রতি এমন নির্দয়, নিষ্ঠুর, নির্মম হতে পারে?
শুধু কি খাবার? মাহির কোন্ কাজটা আম্মুর বিধিনিষেধের আওতামুক্ত? চুল কাটাতে গিয়ে একটু এদিক ওদিক হলে কতরকম অপমানজনক তিরস্কারই না তাকে হজম করতে হয়! সেদিন কেটে আসা চুল যথোচিত ভদ্রস্থ হয়নি বলে মামণি তাকে পুনরায় সেলুনে পাঠিয়ে সেলুনমালিকের কাছে কী লজ্জাটাই না দিলো! এভাবে কি বাঁচা যায়? না এটাকে বেঁচে থাকা বলে? উঠতে, বসতে, জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে শাসনের এমন উদ্যত চাবুক তার জীবনকে করে তোলে বিবর্ণ, ধুসর, অসহনীয়। অথচ তার বন্ধুদের মায়েরা ছেলেদের পছন্দ-অপছন্দের প্রতি কত না যত্নশীল। বন্ধু নীরবের পছন্দের খাবার ফার্স্টফুড। ছেলের পছন্দের খাবারের ব্যবস্থা করতে তার মায়ের তো অনাগ্রহ নেই! আইসক্রিম আদরের খুব প্রিয়। তার মা তো কোনোসময় তাকে আইসক্রিম কিনে দিতে কার্পণ্য করেন না! কাচ্চি বিরিয়ানিটা খুব প্রিয় রনির। তার মা-ও তো তাকে প্রায়ই সেটা কিনে খাওয়ান! কিন্তু তার বেলাতেই কেন বিধি-নিষেধের এমন বেড়াজাল?
অপ্রিয়, বিস্বাদ, কটুগন্ধময় সব খাবার খাওয়ার জন্য তার উপরেই কিনা যত চাপ, প্রতিচাপ? তার মতো হতভাগ্য, পৃথিবীতে আর একটাও কি আছে? উহু, একটু ভুল বলা হলো, তার মতো ইঁদুর কপালে আরো একজন আছে, সে তারই বন্ধু আয়ান। বরঞ্চ বলা ভালো, আয়ানের অবস্থা তার চেয়ে শোচনীয়, একেবারে দূর্বিষহ, নরক যন্ত্রণাময়! আয়ানকে নাকি প্রতিদিন সকাল-বিকেল লেবু, আদার রস সহযোগে কীসব অসহ্য পানীয়ও গিলতে হয়। আরে বাবা দণ্ডপ্রাপ্ত কোনো আসামীকেও তো মানুষ এভাবে শাস্তি দেয় না। আর নিজের পেটের ছেলেকে কিনা…! না, না এভাবে বাঁচার কোনো মানে হয় না। আজকেই এই বন্দীখানার অসহ্য পরিবেশ থেকে মুক্তি নিয়ে আয়ানের সাথে চূড়ান্ত কথা বলতে হবে।
স্কুলে এসে পড়ায় মন বসে না মাহির। টিফিন ছুটিতে আয়ানের সাথে বসে তাদের এতদিনকার পরিকল্পনাটা বাস্তবায়নে করণীয় ঠিক না করা পর্যন্ত অস্বস্তি যায় না তার। স্বাধীনতাশূন্য রিক্ত জীবনের ধুসর পর্দা ছিড়ে মুক্ত বাতাসে শ্বাস নেওয়ার জন্য এটা একান্ত অপরিহার্য হয়ে পড়েছে বৈকি! এ ব্যাপারে আয়ানের ভরসায় বসে থেকে অনেক সময় নষ্ট হয়েছে, কিন্তু আর নয়। আজকেই তার সাথে একটা চূড়ান্ত কথা বলে ফেলতে হবে। আয়ানের মতো এমন ভীতুর ডিম, গর্দভের জন্য সে অবশ্য অপেক্ষা করতোও না। যদি না একাকী বের হবার মতো নগদ কিছু টাকার ব্যবস্থা তার থাকতো। আয়ানের বাবা বিরাট বড়লোক। তার পকেট থেকে পাঁচ ’শ কি হাজার টাকার নোট সরালেও কিচ্ছু টের পান না তিনি। আর এভাবে গত একবছরে প্রায় ত্রিশ হাজার টাকা জমা হয়েছে আয়ানের। তাই মাহি আয়ানকে ছাড়া একাকী ঘর ছাড়ার সাহস পায় না। কিন্তু মেছোভূতটার অপেক্ষায় থেকে কি কোনো লাভ হবে? মনে মনে আয়ানকে গালি বকে মাহি। সেবার তো বাসা থেকে চুপিচুপি কাপড়চোপড় গুছিয়ে এনেও আয়ান আজ নয়, আরেকদিক বলে ফিরে গিয়েছিল। মনে মনে তিক্ততা আর অস্বস্তিটা বাড়তেই থাকে মাহির।
শ্রাবণের মধ্য দুপুর। আকাশে মেঘমালার বিপুল সন্তরণ। কৃষ্ণ মেঘের সঘন উপস্থিতিতে চতুর্দিকে আঁধার আসে ঘনিয়ে। প্রায় অন্ধকার পরিবেশে সবকিছুকে কেমন যেন মুষলধারায় ভাসিয়ে নেয়ার উন্মাতাল প্রস্তুতি। মাহির হৃদয়াকাশেও সে মেঘের চঞ্চল ছোটাছুটি। বারে বারে সেখানে ধ্বনিত হয় বজ্রপাতের তর্জনগর্জন। জীর্ণতা আর দীর্ণতাকে ভাসিয়ে নেয়ার আটঘাট প্রস্তুতি সেখানে। কিন্তু কখন সেখানে মূষলধারায় নামবে বর্ষণের অবিরাম ধারা? কখন সে উদ্দাম প্লাবনে খড়কুটোর মতো ভেসে যাবে মাহির যত দুঃখ-কষ্ট?

দুই
কর্দমাক্ত মাঠে ফুটবল নিয়ে মেতে উঠেছে সবাই। যতটা না খেলা হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি হচ্ছে পরস্পরের গায়ে কাঁদা ছিঁটাছিটি। অন্যদিন মজার এ খেলায় মাহিরের আগ্রহই ছিল সবচেয়ে বেশি। কিন্তু অবাক কাণ্ড! আজ একেবারে শান্তশিষ্ট হয়ে মাঠের এক কোণায় চুপচাপ বসে আছে সে। কিছুক্ষণ পর আয়ানও এসে অবস্থান নেয় তার পাশে। তার চেহারা আরো থমথমে। আষাঢ়ের প্রবল বর্ষণের পূর্বাভাস তাতে। আয়ানের থমথমে মুখ দেখে মুখ ফুটে কিছু বলে না মাহি। সময় বয়ে যায়। দুজনেই নির্বিকার বসে থাকে অনেকক্ষণ। একসময় অসহনীয় গুঁমোট কাটাতে প্রশ্নমুখর হয় মাহি, কীরে ভীতুর ডিম! মন খারাপ কেন?
আর বলিস না। আম্মু বলেছিল বিকেল বেলা তার সাথে কী একটা কাজে যেতে। আমি বলেছি খেলার পরে যাবো। তাতেই যত্তসব বকাঝকা শুনতে হয়েছে। গোমড়ামুখে জবাব দেয় আয়ান।
এতে মন খারাপের কী আছে? নিত্যদিনের রুটিনবাঁধা অনুষঙ্গ। কোনোদিন না হলেই বরং অস্বাভাবিক লাগে।
তাই বলে সারাদিনে খেলার জন্য মাত্র যে ঘন্টাখানেক সময় পাই, সে সময়েই কিনা ওনাদের যত কাজের দরকার পড়ে? অন্যসময় বললে কি যাই না?
কি আর করবি বন্ধু! আয়ানের পিঠে সান্ত্বনাসূচক হাত বুলায় মাহি, কিছু একটা করা সাহসে না কুলালে মুখ বুজে এসব অত্যাচার তো সহ্য করতেই হবে তাই না?
না, না। আর নয়। এবারে সত্যি সত্যি কঠিন শপথ নিয়ে এসেছি। সত্যিই আমি এ কারাগার ছেড়ে অগস্ত যাত্রায় বেরিয়ে পড়বো! আয়ানের কথায় কেমন এক দৃঢ়তা টের পায় মাহি। তবুও তাকে বাজিয়ে দেখার জন্য বিদ্রুপাত্মক পরিহাসে মেতে ওঠে সে, আরে রাখ তোর অগস্ত যাত্রা। অগস্ত যাত্রার মানে জানিস? ঘর থেকে দু’কদম ফেলতেই যার কলিজা শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে যায়, সে ধনীনন্দন ছাড়বে চিরদিনের জন্য সুখের আলয়?
অন্যদিন হলে মাহির এহেন খোঁচায় তেলেবেগুনে জ্বলে উঠতো আয়ান। কিন্তু আজ তার মাঝে সেরকম কোনো আভাসই পরিলক্ষিত নয়। খুব সংক্ষেপে নিজের সিদ্ধান্তের দৃঢ়তা জানিয়ে দেয় শুধু, সত্যি বলছি। কসম।

মনে মনে ভীষণ আশান্বিত হয় মাহি। অনেকদিন পর তার প্রত্যাশা পূরণ হতে চললো নাকি? মুক্তির শ্বেত পায়রারা ডানা মেলবে নাকি তার বিস্তীর্ণ নীলিমায়? এরপর নানান পরিকল্পনায় মেতে ওঠে দু’জন। সাব্যস্ত হয় যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করে আগামী সপ্তাহে রওনা হবে তারা। সাথে কী কী নিতে হবে, কেউ টের না পায় মতো কাপড়চোপড় ও অন্যান্য জিনিসপত্র কীভাবে সরানো হবে তার বিশদ প্ল­্যানও সাজায় তারা নিখুঁতভাবে।
হঠাৎ বড় বড় ফোটায় ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামে। আয়ানের আবার ঠাণ্ডার ধাত। দৌড়ে বাসার দিকে চলে যায় সে। কিন্তু মাহির মন সায় দেয় না জায়গা ছেড়ে উঠতে। অনেক দিনের জমানো ব্যথার অবসানে ঝুম বৃষ্টিতে ভিজতে খুব ভালো লাগছে তার। মনে হচ্ছে বর্ষণের প্রবলধারা তার দেহমন থেকে যাবতীয় দুঃখ-কষ্ট-পেরেশানীকে ধুয়েমুছে দিচ্ছে। ওহ্! সে এক অনন্য অনুভূতি! স্বচ্ছ সুখের সে এক অজানা পরশ! তার মন চলে যায় দিগন্ত পেরিয়ে অচিনপুরের দেশে। যেখানে আকাশের নীলিমা দিগন্তে এসে মেশে। পাখপাখালির জীবনদায়িনী মহাসঙ্গীত সেখানে সর্বদা কোরাস গায়। ফুলের কুঁড়িরা সেখানে হাসিমুখে বিলায় বন্ধুত্বের সুরভি আহবান। জীবন সেখানে ব্যস্ততার কোলাহলে যান্ত্রিক নয়। সময়েরা নয় বাঁধাধরা শৃঙ্খলে বন্দী। মনের ইচ্ছেরূপী প্রজাপতিরা আটক নয় নিষেধের ঘেরাটোপে! সে আর আয়ান সেখানে বুট-বাদাম ফেরি করে যা উপার্জন করে, তা দিয়েই দিব্যি চলে যায় তাদের দিনকাল। তারপর ইচ্ছেমতো বিহঙ্গের মতো ডানা মেলে মুক্ত আকাশে ওড়াউড়ি। আহ্! স্বাধীনতার আনন্দানুভূতি কি ভাষায় প্রকাশ করা যায়?

তিন
মাছিটা অনেকক্ষণ ধরেই জ্বালাতন করছিল মাহিকে। সারাক্ষণ নাকে, মুখে ভন ভন শব্দে কানে তালা লেগে যাবার দশা তার। মাথায় কেমন যেন ঝিম ধরে গেছে। ইচ্ছে করছে এক থাপ্পড়ে হারামীটার ভবলীলা সাঙ্গ করে দিতে। কিন্তু মারবে কি, সে তো নিজের চোখদুটোই মেলতে পারছে না! হাতদুটো মনে হচ্ছে পাথরের মতো ভারী। কী ব্যাপার? শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলি তার অচল হয়ে গেল নাকি? নাকি মারা গেছে সে? না, না, তা কী করে হয়? তাহলে মাছির ভনভন শব্দ আর মামণির কুরআন তেলাওয়াতের সুর শুনতে পাচ্ছে কীভাবে সে? তাছাড়া এতক্ষণ আয়ানকে নিয়ে ট্রেনের বগিতে ফেরি করে বুট-বাদাম বিক্রি করছিলো কীভাবে সে, এই বাদাম! বুট, বাদাম! গরম গরম ভাজা বুট-বাদাম! কিচ্ছু বুঝতে পারে না মাহি। চেতন-অচেতনের মাঝামাঝি এক নিঃসাড় অনুভূতি নিয়ে হাসপাতালে নির্জীব পড়ে থাকে সে।
ছেলের মুখে পুনরায় ফেরিওয়ালার কণ্ঠস্বর ও বলার ভঙ্গিমা অনুসরণে আবোল-তাবোল বকাবকি শুনে চমকে ওঠেন মাহির মা। প্রবল জ্বরের ঘোরে আজ তিনদিন ধরে অচেতন ছেলে অসংলগ্ন কথাবার্তা বলেই চলেছে। দরদী মায়ের উৎকন্ঠিত হৃদয় তাই সততই ছিল পেরেশান। ছেলের চিন্তায় অস্থির মাতৃমন এই তিনদিনে এক ফোটা দানাপানিও গ্রহণ করেননি। সারাক্ষণ অচেতন ছেলের শিয়রে বসে মহান স্রষ্টার কাছে ছেলের রোগমুক্তির জন্য জানিয়েছেন সকাতর নিবেদন। মাহির বাবা ও অন্যান্যরা তাকে অনেক বুঝিয়েও এতটুকু সময়ের জন্য তাকে বিশ্রাম নিতে রাজি করাতে পারেননি। বিশেষভাবে আয়ানের কাছে মাহির মনোবেদনা ও তাদের অনেক প্ল্যান-পরিকল্পনার কথা শুনে অনুশোচনার তীব্র আগুনে নিয়ত দগ্ধ হয়েছেন। যে ছেলের মঙ্গল আর অকল্যাণ থেকে রক্ষার জন্য তিনি সর্বদা সজাগ দৃষ্টিতে থাকেন সক্রিয়, সে ছেলেই যদি উল্টো তাকে ভুল বোঝে তা এক অব্যক্ত মনোবেদনার কারণ হলেও মাতৃমনের মায়াপ্রান্তরে জাগলো ভিন্নরকম আবেগ-অনুভূতি। তার কাছে মনে হতে লাগলো, অতিরিক্ত চিপাচিপির ফলে লেবু যেমন তেঁতো হয়ে যায়, তেমনি সন্তানের কল্যাণার্থে শাসন যেরূপ দরকার, তেমনি তাতে পরিমিতিবোধের আবশ্যকতাও গুরুত্বহীন নয়। তাই মনোকষ্ট তার বেড়ে চলে উত্তরোত্তর। সাশ্রু নয়নে আবোলতাবোল বকতে থাকা ছেলের
মাথায় মমতাভরা হাতখানি বুলাতে থাকেন তিনি। ছেলের কষ্টগুলো সহস্রগুণ বর্ধিত হয়ে তার বুকে বিঁধতে থাকে বিষাক্ত শেল হয়ে। চোখ দিয়ে ঝরতে থাকে শ্রাবণধারার মতো অবিরাম প্রবাহ। বারেবারে সন্তানের আরোগ্য কামনায় প্রভুর কাছে আত্মনিবেদনে ব্রতী হন তিনি।
পৃথিবীতে মাতৃস্নেহের সত্যিই কোনো তুলনা নেই। অনন্য, অসাধারণ, উপমাবিহীন সে মমতা-পরশ। আশীর্বাদের সে সর্বজয়ী উপাদানই ধরাধামে জীবকূলের অস্তিত্বকে রেখেছে সাবলীল, ছন্দময়, প্রকাশোন্মুখ। কিন্তু মাহির মায়ের স্নেহ-মমতার যুথবদ্ধ বহিঃপ্রকাশ ছিল তারচেয়েও মহিমাছড়ানো, আবেগভরা, বিষ্ময়জাগানো। মৃত জীবাত্মার প্রাণহীন দেহেও যেন তা বহাতে পারে প্রাণের স্পন্দন। আর মায়ের এমন অমানুষিক পরিশ্রম, ক্লান্তিবিহীন সেবা-যত্ন আর হৃদয় নিংড়ানো মিনতি আর আবেদনে মরণোন্মুখ মাহির দেহ ফিরে পায় প্রাণচঞ্চল সাড়া।

চার
হাসপাতালের সপ্তম দিনের সূচনালগ্ন মাহির মায়ের জন্য বয়ে আনে প্রত্যাশা ও আনন্দের সোনালি বিচ্ছুরণ। আঁধারের বুক চিরে ঊষালোকের জীবনদায়িনী বিকাশ যেন! দীর্ঘ সাতদিন জ্বর ও নিউমোনিয়ায় ভোগার পর আজ মাহির শরীর অনেকটাই সুস্থ। তার শীর্ণ দেহে প্রাণচঞ্চলতার সাড়া লক্ষণীয়। মাহির মায়ের চোখে-মুখে তাই স্বস্তির প্রকাশ-বিকাশ। মহান স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতার অন্তহীন অনুরণন তার হৃদয়মাঝে।
কেবিনের দরজা ঠেলে নির্দিষ্ট সময়ে হাজির হন ডিউটি ডাক্তার। মাহির অবস্থার উন্নতি দেখে হর্ষোৎফুল্ল হয়ে ওঠেন তিনি, মাশাআল্লাহ্, রোগীর অবস্থা দ্রুত ইম্প্রুভ হচ্ছে। তারপর মাহির মায়ের দিকে ফিরলেন তিনি। বললেন, আপনি সত্যিই সার্থক মা। জন্ম এবং মৃত্যু আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত চিরন্তন এ সত্যকে কিছুক্ষণের জন্য ভুলে গেলে বলা যেত মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করেই আপনি ছিনিয়ে এনেছেন আপনার ছেলেকে।
Ñ কী যে বলেন! ছেলের অসুস্থতায় কোনো মা কি স্বাভাবিক থাকতে পারে?
Ñ সে তো ঠিকই আছে। কিন্তু আমার চিকিৎসাজীবনে কোনো মানুষকে এভাবে বিরামহীন পরিশ্রমে অনন্য সেবায় বিলীন হতে দেখিনি!
মাঝখানে কথা বলে ওঠেন মাহির বাবা, শুধু কি সেবা আর যত্ন? তার পাশাপাশি এই সাতদিনের প্রতিটি মুহূর্ত সে ব্যস্ত ছিল আল্লাহর দরবারে অশ্রুবিসর্জনে ফরিয়াদমুখর।
Ñ না, না, এটা আপনার নেহায়েত বাড়াবাড়ি ভাবী। মাহির মাকে লক্ষ করে বলেন ডাক্তার, এভাবে বিরামহীন পরিশ্রমে আপনি নিজেই ভেঙ্গে পড়বেন যে!
Ñ কী করবো ডাক্তার সাহেব? মাহির মায়ের কণ্ঠ কেমন ভেজা ভেজা। Ñ ছেলেটা আমার নেহায়েত অবুঝ ও চাপা স্বভাবের। তার মঙ্গলের জন্য আমাকে প্রায়শই কঠোর হতে হয়। বাসায় নেই আমাকে বিভিন্ন কাজেকর্মে টুকিটাকি সাহায্য করার মতো কেউ। তদুপরি ছেলেমেয়েদের রয়েছে খাবারদাবার আর বিভিন্ন বিষয়ে ভীষণরকম বাছবিচার। তাদের জীবনাচরণও অগোছালো, বিশৃঙ্খল, যা আমার একেবারেই অপছন্দ। ফলে অনেক সময় মেজাজকে সামলে রাখা দায় হয়ে পড়ে। একটানা কথাগুলো বলে একটু থামেন মা। তারপর আবার যোগ করেন, তাইতো তাদের বুনিয়াদী জীবনের জন্য আমাকে আরোপ করতে হয় নানান কঠিনতা। আর আমার শাসনের প্রকৃতি বুঝতে না পেরে তাদের কচিমন হয়ে ওঠে নেহায়েত অবুঝ অভিমানে বিদ্রোহী। ছেলের চাপা স্বভাবের কারণে আমারও পরখ করার অবকাশ মেলেনি তার অন্তর্বেদনকে উপলব্ধি করার। দীর্ঘ কথাগুলোর শেষদিকে ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলেন মা।
মায়ের সরল কান্না ডাক্তারকে কেমন যেন বিব্রত করে তোলে। আরে! আরে! কাঁদছেন কেন আপনি? আজ তো আনন্দের দিন। আর শাসনের কথা বলছেন? যে ছেলে-মেয়ের মঙ্গলার্থে মা-বাবা তাদের যাবতীয় সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, আরাম-আয়েশকে হাসিমুখে জলাঞ্জলি দেয়, যাদের যাবতীয় প্রয়াস, সাধনা হচ্ছে সন্তানের সুখ-সুবিধার জন্য তাদের শাসনদণ্ডও ছেলে-মেয়েদের সুন্দর আগামীর জন্য একান্ত অপরিহার্য বৈকি!
Ñ না, ভাই। আমি বোধ হয় সে শাসনদণ্ড ব্যবহারে পরিমিতিবোধ ও যথার্থতা প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছি! কণ্ঠ তার এখনো ভারী ও আর্দ্র।
Ñ কী বলছেন ভাবী? আজকালকার ছেলেমেয়েদের চঞ্চলতার বিপরীতে এতো কোমল হলে কী চলে? বাইরে থেকে আপনাকে যতটুকু শক্ত ও কঠিন বলে মনে হয়, আসলে ভেতরটা দেখছি আপনার মোমের মতোই নরম। সে যাক, ছেলেকে ঘন ঘন তরল খাবার দিন। আর যেকোনো প্রয়োজন আমাকে জানাবেন বলে বিদায় নেন ডাক্তার।
এতক্ষণ ডাক্তার আঙ্কেলের সাথে মা-বাবার কথাগুলো মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিলো মাহি। তার প্রতি মামণির এমন সীমা ছাড়ানো ভালোবাসা, বর্ণনাতীত পরিচর্যার বিষয়টি তো সে এভাবে মনোযোগ দিয়ে ভাবেনি! আসলেই তো, মামণি তো তাঁর নিজের সুখ-সুবিধার জন্য তাদেরকে শাসনের গণ্ডিতে বাঁধেন না! বরঞ্চ আমাদের সবার সুন্দর, সুশৃঙ্খল জীবন পরিচালনার জন্যই তো আম্মুর এত উদ্বেগ-উৎকন্ঠা। আর পরম দরদী, স্নেহ-মমতার একমাত্র আধার সে মাকেই এতদিন ভুল বুঝে এসেছি আমি? হায়! মানুষ এত অর্বাচীন হয়? আমার মতো বোকা বুঝি পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি আছে? ভাবতে ভাবতে মায়ের প্রতি এক প্রবল ভালোবাসা ও আত্মগ্ল­ানির সুতীব্র হুতাশনে মাহির মন নদীতে জাগে উথালপাতাল ঢেউ। সে ঢেউয়ের প্রবল ঝঞ্ঝায় তার দু’চোখ বেয়ে নামে অশ্রুকণার ধারা। মনে মনে প্রতিজ্ঞামুখর হয় সে,
Ñ মামণি, আপনি দেখবেন, এখন থেকে আপনার সব কথার একান্ত অনুগত হবো আমি।
মাহির দুচোখে নীরব অশ্রুর ধারাপ্রবাহ দেখে আবার ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠেন মা।
Ñ কী ব্যাপার বাবা? আবার খারাপ লাগছে তোমার”? উৎকন্ঠায় ভরা তার কণ্ঠ শুষ্ক, বিষাদগ্রস্ত।
দু’পাশে মাথা নাড়ায় মাহি।
Ñ তাহলে? প্রশ্ন করে মা।
মাকে কী জবাব দেবে মাহি? তার আবেগরুদ্ধ আর্দ্র হৃদয় মুখে কোনো ভাষা জোগায় না। কিন্তু মনের অনুতাপ আর গ্ল­ানিময় অশ্রুকণাগুলোকে কোনোমতেই রোধ করতে পারে না সে। সে অশ্রুধারার সাথে গলে গলে পড়তে থাকে তার যত দুঃখ-ব্যথা ও অকারণ কষ্টবোধ।