রোজা ও ঈদে খাওয়া দাওয়া

ডা. আশরাফ হোসেন

0
48

বন্ধুরা, রমজান ইবাদতের মাস, ত্যাগের মাস, ভালো কাজে প্রতিযোগিতার মাস এবং গুণাহ মুক্ত থাকার মাস। এই মাসে একটি ভালো কাজের জন্য আল্লাহ-তায়ালা দশ গুণ পুরস্কার দেবেন। কিন্তু কেন যেন রমজান মাসে সবাই খাবারের প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে। কে কত খেতে বা রান্না করতে পারে। কিন্তু এসব ভাজা-পোড়া, গুরুপাক খাবার খেলে কী হতে পারে, তা কি আমরা জানি? সারা দিন রোজা রাখার পর পাকস্থলী খুব ক্ষুধার্ত ও দুর্বল থাকে। তারপর যদি এত রকম গুরুপাক খাবার একসঙ্গে খাওয়া হয়, তাহলে কী অবস্থা হবে? পেটের সমস্যা, মাথাব্যথা, দুর্বলতা, অবসাদ, আলসার, অ্যাসিডিটি, হজমের সমস্যা ইত্যাদি হবে রোজার নিত্যসঙ্গী। অনেকের ওজনও বেড়ে যায়।
এ বিষয়ে পুষ্টিবিদরা বলেন, রোজায় দামি খাবার খেতে হবে এমন নয় বরং সুষম, সহজপাচ্য ও পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে। গুরুপাক খাবার, পোড়া তেল, বাইরে ভাজা-চপ, পেঁয়াজি, বেগুনি, কাবাব, হালিম, গোশতজাতীয় খাবার না খাওয়া ভালো। এতে হজমে নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে।
দিনের বেলায় দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকার কারণে রোজার শেষে শরীর, মস্তিষ্ক ও স্নায়ুকোষ খাবারের মাধ্যমে তাৎক্ষণিক শক্তির জোগান চায়। তাই দীর্ঘ সময় পর ইফতারে খাবারটাও তেমন সহজ ও সুপাচ্য হওয়া চাই। চাই স্বাস্থ্যকর, পুষ্টিকর ও সুষম খাবার।
ইফতারের শুরুতে সাধারণ পানি এক-দুই ঢোঁক পান করে এক গøাস বানানো ফলের শরবত হলে ভালো হয়। খেজুর, চিঁড়া, চালের জাউ ইত্যাদি খাওয়া যেতে পারে। ইফতারের পর রাতের খাবারটাও কিছুটা হালকা ও সহজে হজম হয় এমন হওয়া উচিত। যেমন লাউ, লাউশাক, মিষ্টিকুমড়া, শসা, পটোল, ঝিঙে, কচুশাক, কচু ইত্যাদির ঝোল তরকারি, এক টুকরা মাছ অথবা এক টুকরা গোশত হতে পারে। সাহরিতে খুব বেশি পরিমাণে খাবার না খেয়ে রুচি অনুসারে স্বাভাবিক খাবার খাবে। সারা দিন খেতে পারবে না বলে ইচ্ছেমতো উদরপূর্তি করে খাবে না। পেটের এক-চতুর্থাংশ খালি রাখবে। আর মনে রাখবে, একজন মানুষের সারা দিন যে পরিমাণ পানি ক্ষরিত হয়, সে পরিমাণ রাতে পান করা উচিত।

বন্ধুরা, এবার জেনে নাও রোজার মাসে তোমরা কী খাবে আর কী খাবেন নাÑ
খেজুর বা খোরমা অবশ্যই খাবে। এতে আছে শর্করা, চিনি, সোডিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, ফসফরাস, আয়রন, কপার, সালফার, ম্যাঙ্গানিজ, সিলিকন, ক্লোরিন ফাইবার যা সারা দিন রোজা রাখার পর খুবই দরকারি।
চিনিযুক্ত খাবার বাদ দিলে ভালো হয়। এটা খুব তাড়াতাড়ি রক্তে চিনির মাত্রা বাড়িয়ে দেয়, ওজন বাড়ায়। তাই যথাসম্ভব চিনি ও চিনিযুক্ত খাবার কম খাবে।
সবজি ও ফল খেতে হবে নিয়মমতো। তা না হলে এই সময়ে কোষ্ঠকাঠিন্য হবে নিত্যসঙ্গী।
এই গরমে অন্তত ৮ থেকে ১০ গøাস পানি না খেলে হজমের সমস্যা হবে। ইফতারের পর থেকে ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত একটু পরপর পানি খেতে হবে।
সুষম খাবার খেতে হবে। আমিষ, শর্করা, চর্বি, ভিটামিন, দুধ, দই, মিনারেল, আঁশ ইত্যাদি খেতে হবে নিয়মমতো।
আঁশসমৃদ্ধ খাবার যেমন লাল আটা, বাদাম, বিনস, শস্য, ছোলা, ডাল ইত্যাদি খেতে হবে। এগুলো হজম হয় আস্তে আস্তে, তাই অনেক সময় পর ক্ষুধা লাগে। রক্তে চিনির পরিমাণ তাড়াতাড়ি বাড়ে না।
কাচা ছোলা খাওয়া ভালো। তবে তেল দিয়ে ভুনা করে খাওয়া ঠিক না।
চা, কফির মাত্রা কমাতে হবে। তা না হলে পানিশূন্যতা, কোষ্ঠকাঠিন্য, ঘুমের সমস্যা হতে পারে।
সাহরিতেও খুব বেশি খাওয়া বা সাহরি না খাওয়াটাও ঠিক নয়। সাহরি না খেলে শরীর দুর্বল হয়ে যাবে।
বর্জন করতে হবে ভাজা-পোড়া ও গুরুপাক খাবার যেমনÑ ছোলা ভুনা, পেঁয়াজি, বেগুনি, চপ, হালিম, বিরিয়ানি ইত্যাদি বাদ দিতে হবে।
প্রতিবেলা মাংস না খেয়ে অন্তত একবেলা মাছ খেতে চেষ্টা করতে হবে।
সহজপাচ্য খাবার, ঠাÐা খাবার যেমন দই, চিঁড়া খাবে। তাহলে সারা দিন রোজা রাখা নাজুক পাকস্থলী ঠিকমতো খাবার হজম করতে পারবে।
কোষ্ঠকাঠিন্য হলে ইসবগুল খেতে পারো।
বেশি দুর্বল লাগলে ডাবের পানি বা স্যালাইন খেতে পারো ইফতারের পর।
কোমল পানীয় ঘুমের সমস্যা, অ্যাসিডিটি, আলসার ইত্যাদির কারণ। তাই এ কোমলপানীয়কে সারা জীবনের জন্য পারলে বাদ দেবে।
বন্ধুরা, এবার এসো আমরা ঈদের দিনের খাওয়া-দাওয়া নিয়ে কিছু আলোচনা করি। রোজার এক মাসে মানুষের খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাপনে যে পরিবর্তন আসে তাতেই অনেকে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। মাসখানেক সিয়াম সাধনার পর ঈদের দিন সকাল থেকেই ইচ্ছামতো খাওয়া-দাওয়ার ধুম পড়ে যায়। আর ঈদের দিনে আনন্দের অন্যতম আয়োজনটাই হলো নানারকমের খাবারদাবার। সকালবেলা উৎসবের শুরুটাই হয় মিষ্টি, সেমাই, পোলাও, কোর্মাসহ হরেকরকমের খাবার দিয়ে। অনেকে এ সুযোগে একটু বেশিই ভ‚রিভোজ করে ফেলে। আসলে কিন্তু ঈদের দিন এভাবে লাগামছাড়া খাওয়া-দাওয়া করা স্বাস্থ্যের জন্য হতে পারে ভীষণ ক্ষতিকর। হঠাৎ এরকম অতিভোজনের ফলে পাকস্থলি তথা পেটের ওপর চাপটা পড়ে বেশি। নিজের ঘরে হরেক রকমের খাবারের সঙ্গে বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজনের বাসায় বেড়াতে গেলেই ইচ্ছা-অনিচ্ছায় আরো বেশি খেতে হয়। ফলে অধিক চাপে অনেক সময় পাকস্থলির এনজাইম ঠিকমতো কাজ করতে পারে না। এ কারণে পেট ব্যথা, গ্যাস্ট্রাইটিস, ডাইরিয়া, বমি, পেটফাঁপা বা বদহজম ইত্যাদি হরহামেশাই দেখা যায়।
সাধারণত ঈদের দিন প্রচুর তৈলাক্ত খাবার যেমন পোলাও, বিরিয়ানি, মুরগি, খাসি বা গরুর গোসত, কাবাব, রেজালা আর এর সঙ্গে মিষ্টিজাতীয় খাবার আমরা সবাই খাই। এসব খাবার পরিপূর্ণভাবে হজম করতে অন্তত ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা সময় লাগে। একসঙ্গে বেশি খাওয়ার ফলে পেটে অস্বস্তিকর অনুভ‚তি, ভরা ভরা ভাব, বারবার ঢেঁকুর ওঠা এমনকি বুকে ব্যথা পর্যন্ত হতে পারে।
আসলে ছোট বাচ্চাদের ঈদ আনন্দটা সবচেয়ে বেশি। তারা শখ করে দু-একটা রোজা রাখে, রোজা শেষে ঈদের দিন মজার মজার খাবার খেতে বেশি পছন্দ। তবে খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে অতিভোজনে বয়স্কদের মতো ছোটদেরও সমস্যা হতে পারে। যেকোনো কিছু খেলেই সবসময় শরীরে সমস্যা হবে এমন কথা নেই, শুধু পরিমাণটা ঠিক রাখলেই হলো।
কোনো শারীরিক সমস্যা না থাকলে হজমে সহায়ক সব ধরনের এনজাইম সঠিকভাবেই কাজ করে। এমনকি গুরুপাক, তৈলাক্ত বা চর্বিযুক্ত খাদ্যগুলো সহজে হজম হয়ে যায়। তবে অবশ্যই অতিভোজন না করাই ভালো। ঈদের নামাজ পড়তে যাওয়ার আগে অল্প করে সেমাই বা পায়েস খাওয়া ভালো। এগুলোর সঙ্গে কিশমিশ, বাদাম, ফলের জুস, যেমন পেঁপে, আম ইত্যাদি খেতে পারো। খাবার আধাঘণ্টা পর দেড় থেকে দুই গøাস পানি খেয়ে ঈদের নামাজ পড়তে যাবে। দিনে বিভিন্ন ধরনের খাবার খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে প্রচুর পানি ও অন্যান্য তরল খাবার খাওয়া ভালো। একবারে বেশি করে না খেয়ে অল্প অল্প করে বার বার খেতে পারো। যারা ঈদের দিন চটপটি জাতীয় খাবার পছন্দ করে তারা তেঁতুলের টক মিশিয়ে খেতে পারো। পোলাও বা বিরিয়ানির সঙ্গে অবশ্যই সালাদজাতীয় খাবার এবং দই খেতে পারো।