বাজপাখির শাস্তি

আব্দুস সালাম

0
32

এক দেশে সুন্দর একটা গ্রাম ছিল। সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা, ছায়াঘেরা গ্রামটি দেখতে ছিল ছবির মতো। সেই গ্রামে কোনো কিছুর অভাব ছিল না। গ্রামটির এক পাশে ছিল অবারিত ফসলের মাঠ। মাঠটি আবার ছোট-বড় গাছপালায় ঘেরা ছিল। গাছগুলো ছিল পাখপাখালির অভয়ারণ্য। কিছু কিছু গাছের ফোঁকরে কাঠবিড়ালিরা বাস করত। ইঁদুররা বাস করত ফসলের মাঠের বিভিন্ন গর্তে। সকলে গাছের ফলমূল এবং মাঠের ফসল খেয়ে জীবনযাপন করত। খাবারের কোনো অভাব ছিল না। পশুপাখিরা ছিল একে অপরের বন্ধু। সকলে মিলেমিশে সুখে-শান্তিতে বসবাস করত। একদিন চলার পথে একটা খরগোশের সঙ্গে ইঁদুরের দেখা হয়ে গেল। খরগোশ ইঁদুরকে দেখে বলল, ‘ওহে ইঁদুর ভাই, খুব সাবধানে থেকো! মাঠের শেষপ্রান্তে বড় যে নারিকেল গাছ আছে না? সেই গাছে আমি এক বাজপাখিকে দেখেছি। সে সুযোগ পেলেই কিন্তু আমাদের ধরে ফেলবে। প্রথমে খরগোশের কথা ইঁদুরের বিশ্বাস হয়নি। পরেরদিন ঠিকই ইঁদুরের বিশ্বাস হয়। সে বাজপাখিকে একটা সেগুনগাছের ডালে বসে থাকতে দেখে। এভাবে কিছুদিনের মধ্যেই পাখিটি অনেকেরই নজরে পড়ে। এর ফলে পাখ-পাখালি, কাঠবিড়ালি ও ইঁদুরদের মধ্যে একটা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়। তারা ভয়ে ভয়ে জীবনযাপন করতে থাকে। কারণ তারা জানতো বাজ শিকারি পাখি। ছোট ছোট পশুপাখিদের শিকার করে। তাই সকলে এই দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তির জন্য একটা উপায় খুঁজতে থাকে।

সেগুনগাছের ফোকলে এক কাঠবিড়ালি তার বাচ্চাদের নিয়ে বসবাস করতো। একদিন সকালবেলায় মা কাঠবিড়ালি ঘুম থেকে উঠে পড়ে। সে গাছের ফোকল দিয়ে বাইরে মুখ বের করতেই দেখে নিকটেই একটি ডালে সেই বাজপাখিটি বসে আছে। মা কাঠবিড়ালি খুব ভয়ে পেয়ে যায়। সে আর বের হতে পারে না। বাজপাখি যখন উড়ে যায় তখন মা কাঠবিড়ালি ও বাচ্চাগুলো ঘর থেকে বের হয়। মা কাঠবিড়ালি বাচ্চাদের আগেই বাজপাখিটির বিষয়ে সতর্ক করে দেয়। তাই বাচ্চাগুলো সাবধানে চলাফেরা করে। ওদিকে ইঁদুরদেরও একই অবস্থা। তারাও খুব সাবধানে চলাফেরা করে। মাঠে সেবার বাদামের চাষ করা হয়েছে। কাঠবিড়ালি বাদাম খাওয়ার জন্য মাঠে যায়। যেতে যেতে ইঁদুরের সঙ্গে দেখা হয়। তারা বাজপাখি নিয়ে আলোচনা করতে থাকে। এমন সময় অন্য একটা ইঁদুর মুখ ভার করে তাদের দিকে এগিয়ে আসে। তারা এর কারণ জিজ্ঞেস করলে ইঁদুরটি বলে, দু’দিন ধরে আমার একটা বাচ্চাকে খুঁজে পাচ্ছি না। নিশ্চয়ই এটা ওই রাক্ষুসী বাজপাখির কাজ। সে আমার বাচ্চাকে খেয়েছে। ইঁদুরটির কথা শুনে কাঠবিড়ালি বলে, তুমি ঠিকই বলেছ। এই তো ক’দিন আগে পাখিটা একটা কাঠবিড়ালিকে ধরে নিয়ে যায়। এর একটা বিহিত করতেই হবে। নইলে আমাদের আর রক্ষা নেই। একদিন হয়তো আমাদের সকলকে একে একে ওর পেটে যেতে হবে।

বাজপাখির শিকার থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য এবার মাঠের কাঠবিড়ালি, ইঁদুর, খরগোশ ও বিভিন্ন প্রজাতির পাখি গোপনে সভা করে। আলোচনার সময় এক কাঠবিড়ালি বলে, এক কাজ করলে কী হয়? আমরা যদি মাঠের ভালো ভালো খাবার সংগ্রহ করে পালাক্রমে বাজপাখির বাড়িতে নিয়ে যাই, তাহলে সন্তুষ্ট হয়ে বাজপাখি হয়তো আমাদের শিকার করবে না। আর আমরা তখন প্রাণে বেঁচে যাবো। সকলে সমস্বরে বলে ওঠে উত্তম প্রস্তাব। তাহলে তা-ই হবে। বাজপাখিকে প্রস্তাবটা দেয়া যাক। সে যদি রাজি হয় তাহলে আমরা আমাদের কাজগুলো ভাগাভাগি করে নেবো। পরেরদিন এক টিয়া বাজপাখিকে একটা গাছে বসে থাকতে দেখে। টিয়া দূর থেকে পশুপাখিদের প্রস্তাবের কথা জানিয়ে দেয়। সব কথা শুনে বাজপাখি মনে মনে বলল, বসে বসে যদি খাবার পাই, তাহলে আর মন্দ কী? প্রস্তাব মেনে নেওয়াই ভালো হবে। তারপর বাজপাখি টিয়াকে বলে, সত্যি সত্যি তোমরা যদি আমার জন্য প্রতিদিন খাবার নিয়ে এসো, তাহলে আর তোমাদের শিকার করব না। তোমাদের প্রস্তাব মেনে নেবো। আর হ্যাঁ মাঠের শেষপ্রান্তে যে বড় নারিকেল গাছ আছে সেই গাছে আমি বাসা বানিয়েছি। ওখানেই থাকি। কাল থেকেই তোমরা কাজ শুরু করে দাও।

ওদিকে বাজপাখির প্রস্তাব মেনে নেয়ার কথা শুনে মাঠের সকল পশুপাখি খুশি হয়। এর জন্য একটু কষ্ট হলেও তাদের আর প্রাণ যাওয়ার ভয় থাকবে না। সিদ্ধান্ত মোতাবেক প্রতিদিন একজন একজন করে বাজপাখিকে খাবার দিয়ে আসে। বাজপাখি খাবারগুলো দেখে খুব খুশি হয়। সে খুব মজা করে খায়। খাওয়া-দাওয়া নিয়ে তার কোনো চিন্তা থাকে না। ভালোভাবেই তার দিনগুলো চলে যায়। কিছুদিন পর বাজপাখি ভাবল মাঠের খাবার আর ভালো লাগছে না। এবার কিছু মাংস খাওয়া দরকার। আর যাই হোক আগের মতো আর কষ্ট করব না। যে খাবার দিতে আসবে তাকেই ধরে খাব। সত্যি সত্যিই দেখা গেল যারা খাবার দিতে আসে তাদেরকেই বাজপাখি শিকার করে। এ বিষয়টি মাঠের পশুপাখিরা একদিন জেনে ফেলে। এতে তারা বাজপাখির প্রতি ক্ষুব্ধ হয়। আবার তারা গোপনে সভা করে। এই সমস্যা কিভাবে দূর করা যায় তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে। অবশেষে তারা একটা সিদ্ধান্ত নেয়। আর তা হলোÑ বাজপাখিকে ধরার জন্য তারা একটি ফাঁদ তৈরি করবে। সুযোগ মতো তারা বাজপাখিকে ফাঁদে ফেলবে। এ বিষয়ে তারা একটি পরিকল্পনা করে ফেলে।

একদিন সকালে টিয়াপাখি আঙুরের থোকা নিয়ে বাজপাখির বাড়িতে হাজির হয়। সেই সময় টিয়া মুখটা ভার করে রাখে। টিয়ার মুখভার দেখে বাজপাখি বলে, তোমার কী হয়েছে? মন খারাপ কেন? তুমি তো জানো আমার তো বয়স হয়েছে। যেকোনো সময় মারা যেতে পারি। তোমাকে দেখে আমার বড্ড কষ্ট হয়। আমরা তোমাকে সামান্য কিছু খাবার দিই। তাই খেয়েই তোমাকে সারাদিন কাটাতে হয়। মাঝেমাঝে আমাদের আসতে দেরি হলে তোমাকে উপোস থাকতে হয়। তাই বলছিলাম তোমাকে খাদ্য ভা-ারের একটা গোপন সন্ধান দেবো। যেখানে রয়েছে মজার মজার খাবার। ইচ্ছে মতো পেট পুরে খেতে পারবে।
– এক্ষুনি বলো। কোথায় সেটি?
– আরে আস্তে বলো। কেউ শুনে ফেলবে তো।
– আমার আর তর সইছে না। তাড়াতাড়ি বলো।
– না না। তোমাকে বলে বোঝান যাবে না। তোমাকে নিয়ে যেতে হবে। একবার জায়গাটা চিনে ফেললে, এরপর থেকে তুমি একাই যেতে পারবে।
– তবে এক্ষুনি চলো। জায়গাটা আমাকে দেখিয়ে দাও।
– আচ্ছা চলো।

টিয়া বাজপাখিকে ফাঁদের কাছে নিয়ে গেল। একটা খাঁচা দেখিয়ে বলল, ওই যে একটা খাঁচা দেখছ না? ওই খাঁচাটির নিচে রয়েছে খাদ্য ভা-ারের গোপন দরজা। তুমি খাঁচার ভেতরে ঢুকলেই দরজাটি পেয়ে যাবে। সেই দরজা দিয়ে তুমি গোপন খাদ্যভা-ারে প্রবেশ করতে পারবে। টিয়ার কথা বিশ্বাস করে বাজপাখি খাঁচায় প্রবেশ করার জন্য এগিয়ে গেল। যেই খাঁচার ভেতরে প্রবেশ করল আর অমনি ঘরটির দরজা বন্ধ হয়ে গেল। টিয়াকে আশেপাশে দেখতে না পেয়ে বাজ বুঝতে পারল যে টিয়া তাকে মিথ্যা বলেছে। এটা কোনো সাধারণ খাঁচা নয়। এটা আসলে একটা ফাঁদ। সে খুব চেষ্টা করল খাঁচা থেকে বের হবার জন্য। কিন্তু কোনোভাবেই বের হতে পারল না। কোনো উপায় না পেয়ে সে হাউ মাউ করে কাঁদতে লাগল।

ওদিকে বাজপাখির ফাঁদে আটকা পড়ার কথাটি মাঠের সকল পশুপাখির কানে পৌঁছে যায়। তারা ফাঁদের কাছে ছুটে আসে। বাজপাখিকে ফাঁদে আটক দেখে তারা খুশি হয়। বাজপাখি অতীত ভুলের জন্য অনুতপ্ত হয়ে উপস্থিত সকলের কাছে ক্ষমা চাইল। কিন্তু কেউ তাকে ক্ষমা করল না। তারা বলল, আমরা পালাক্রমে তোমার বাসায় গিয়ে খাবার পৌঁছে দিতাম। তুমি বসে বসে সেগুলো খেতে। অথচ তুমি তোমার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করলে। কিছুদিন থেকে আমরা লক্ষ করলাম যে তুমি মন চাইলেই আমাদের ধরে খেয়ে ফেলো। তোমার প্রতি আমাদের আর বিশ্বাস নেই। তুমি বিশ্বাসঘাতকতা করেছ। এর জন্য তোমাকে শাস্তি পেতে হবে। মৃত্যুই হলো তোমার একমাত্র শাস্তি। তোমার মৃত্যু হলেই আমরা মুক্তি পাব। এখন তুমি মৃত্যুর জন্য প্রহর গুনতে থাকো। এরপর বাজপাখিকে একা রেখে সকল পশুপাখি আপন আপন বাসায় ফিরে গেল। খাঁচার ভেতর কিছু খেতে না পেয়ে ক’দিন পর বাজপাখি মৃত্যুবরণ করলো।