ও ক্যাপটেন মাই ক্যাপটেন

মাহবুবুল হক

0
182

ফুলকুঁড়ি আসরের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিন অনেক বড় আনন্দের দিন। তোমরা বালক আর আমি বয়স্ক বালক। বলো তো কার আনন্দ বেশি আমার না তোমাদের? তোমরা হয়তো বলবে যে বয়স্ক বালক আবার আনন্দ করবে কী করে? করবে করবে, আনন্দ তো মনের! মনের আনন্দ বড় আনন্দ! আমি চোখ বুজলেই তো ৪৪ বছরের আনন্দ দেখি। হাজার হাজার বেলুন দেখি। হাজার হাজার ফুলকুঁড়ি দেখি। কতজন কত ভাবে পতাকা উড়াচ্ছে। কত মার্চপাস্ট করছে। কত শৃঙ্খলা, কত নির্দেশনা, কী অনুপম, নিখুঁত সব দৃশ্য। সত্যি বলছি এই এখন এখানে বসে সব যেন দেখছে আমার ছানি পড়া চোখ। কিন্তু চোখ বুজলে সব দেখা যায়। এই তো তোমরা হাসছো কথাবলছো, বক্তৃতা করছো, গান গাচ্ছ, তোমাদের থিম করতালি দিচ্ছ। ভোজ হচ্ছে, একদল খাদ্য বিতরণ করছে, আরেকদল মজা করে খাচ্ছে। মজার মজার কথা হচ্ছে। কিন্তু শৃঙ্খলার কোনো অভাব নেই। ব্লু-নীলে-সাদায় সাজানো তোমাদের পোশাক। ওই তো দূর থেকে আসমানের নীল সাদা মেঘের নোঙ্গর যেন। আকাশ আর মেঘের এই যে মাখামাখি, উহঃ খুব দারুণ লাগছে আমার কাছে। কখনো দেখছি ইঞ্জিনিয়ার ফয়েজ ভাইকে, কখনো দেখছি সানাউল্লাহ নূরী ভাইকে, কখনো বিচারপতি আবদুর রউফ ভাইকে, কখনো মাসুদ আলী, কখনো শাহ আব্দুল হালিম, কখনো জয়নুল আবেদীন আজাদ, কখনো এ কে এম বদরুদ্দোজা, কখনো হাসান মুর্তাজা। ওই তো আমার দৃষ্টিসীমায় উঁকিঝুঁকি মারছে আবু জাফর, মাহিন, মুহিব্বুল্লাহ।
অনেকের কথাই মনে পড়ছে তাদের মধ্যে শফিউল আলম রতন(মরহুম), ডা. মোয়াজ্জেম হোসেন, বিজ্ঞানী পবন, তপন, আদনান এরা সবাই ছিল উজ্বল কর্মী। মার্চপাস্টে কেউ জাতীয় পতাকা উড়াচ্ছে, আবার কেউউড়াচ্ছে ফুলকুঁড়ি আসরের পতাকা। আরে ওই তো কবির কবি আল মাহমুদকে দেখা যাচ্ছে। মাত্র ক’দিনআগে আমাদের ছেড়ে তিনি চলে গেলেন। আবার আমার দৃষ্টিসীমায় কাউকে যেন দেখা যাচ্ছে। আরে.. আমাদের আব্দুর রশিদ চৌধুরী, সাংবাদিক গিয়াস কামাল চৌধুরী, ভুটিবাবু শহিদুল ইসলাম, নধরকান্তি নূরী ভাই আমার পেটে গুঁতো মারছেন, অনেকের সঙ্গে দুষ্টুমি করছেন। মিউজিক্যাল চেয়ার খেলার সময় সে কি আনন্দ! সবচেয়ে বেশি আনন্দের দৃশ্য দেখছি চোখ বাঁধা অবস্থায় হাঁড়িভাঙা খেলায়। নৌবিহার, বনভোজন।মোটরসাইকেলের পেছনে বসে নূরী ভাইয়ের দূরে চলে যাওয়া, শুধু কি ঢাকায়? সারাদেশের কত অনুষ্ঠানের ছবি আমি জ্বলজ্বলভাবে দেখছি। নাহ, হঠাৎ এই আনন্দের মধ্যে আমার মনটা বিষাদে ম্লান হয়ে গেল।
ফয়েজ ভাই নেই, নূরী ভাই নেই, গিয়াস ভাই নেই, আল-মাহমুদ নেই। ফুলকুঁড়ি আসরের সাথে কত ওতপ্রোত সম্পর্ক। মনটা বলছে ওরা এত আনন্দের আসর ছেড়ে চলে গেল কেন? কী অসুবিধা ছিল তাদের এই নশ্বর পৃথিবীতে? একটু আশ্বস্ত হয়ে মন বলছে ওরা বিষণড়বড়ব বা দুঃখ নিয়ে যায়নি। ওরা মহান আল্লাহর সেই ডাকে চলে গেছেনÑ যে ডাকে তিনি বলছেন, ‘হে প্রশান্ত আত্মা তুমি আনন্দচিত্তে ও খুশি মনে জানড়বাতে (তোমার গৃহে) প্রবেশ করো’। তারা নিজ নিজ ঘরে ফিরে গেছেন। এখানে তো ছিলেন মুসাফিরখানায়। কে আর কত দিন মুসাফিরখানায় থাকতে পারে বলো? যখন নিজ নিজ ঘর থেকে ডাক আসে, সেই ডাক তো আরো আনন্দের ডাক। মহা আনন্দের ডাক। তার নিজ বাড়িতে ফিরে যাওয়া, তার চেয়ে আর আনন্দ কি আছে বলো? ওই তো দেখতে পাচ্ছিÑ ফুলকুঁড়ি আসরের একটি রুমে একদল ফুলকুঁড়ি গান গাচ্ছে, গলা ভাজছে।
পাশের আরেক রুমে একজন টেবিল টেনিস খেলছে, তার কোনায় কেউ বসে ক্যারামবোর্ড খেলছে, আবার আরেক কোনায় চলছে ফুলকুঁড়ি পত্রিকার সাহিত্যসভা। আসর পরিচালনা করছেন জয়নুল আবেদীন আজাদ। অতিথির আসনে বসে আছেন আলী ইমাম, আমিরুল ইসলাম, লুৎফর রহমান লিটন, আসলাম সানী, বুলবুল সরওয়ার, আসাদ বিন হাফিজ, হাসান আলিম, মতিউর রহমান মল্লিক, মুকুল চৌধুরী, সোলায়মান আহসান, মোশাররফ হোসেন খান, শরীফ আবদুল গোফরান, শিল্পী হামিদুল ইসলাম, আহমদ মতিউর রহমান, তমিজউদ্দিন লোদী।
সবার নাম বলছি না। কিন্তু বিশ্বাস করো সবার চেহারা আমি দেখছি। না হলেও প্রায় ২০০ সাহিত্যসভায় আমি নিজে ছিলাম। কী উজ্জ্বল উচ্ছল প্রাণবন্ত দেখেছি এসব সাহিত্যসভাগুলো। পত্রিকার জন্য ছবি আঁকতো শিল্পী হামিদুল ইসলাম। জয়নুল ভাই তার পাশে বসে থাকতেন। ছবি আঁকতেন সবিহ উল আলম ভাই। পাশেসুবোধ বালকের মতো দেরি হচ্ছে বলে মাথা চুলকাতাম। শরীফ আবদুল গোফরান নিরীহ মানুষটি বসে আছে মোমিন উদ্দিন খালেদের বাসায়। খালেদের অনেক কাজ, অনেক ব্যস্ত। গোফরানের শরীরটা ভালো না, তবু সে বসে আল্লাহ- আল্লাহ করছে কখন খালেদ প্রচ্ছদসহ ছবিদেবে। আগামী মাসের পত্রিকা এ মাসের ২০ তারিখের মধ্যে প্রকাশ করতে হবে। এমন তাড়নায় একটা বিরাট যন্ত্রণা সৃষ্টি করতো। ওহ, সেকি দৌড়াদৌড়ি। একদিকে স্কুল- কলেজের পড়ালেখা, ফুলকুঁড়ি আসরের নিয়মিত অনেক কাজ অন্য দিকে পত্রিকার জন্য ছোটাছুটি। আহারে আমার কী যে মায়া লাগত। দেখতাম আর ভাবতামÑকী করে ওরা এত পারে? সবাই তো আর বাবা-মার কাছে থাকে না। লজিং, পেইং গেস্ট, মেস কোনোটাই তো আর অত সুন্দর ব্যবস্থা নয়। মায়ের হাতের ন্যালা তো আর সবার ভাগ্যে জোটে না। এই সব ছেলেরা আগামীদিনের নেতারা কী কষ্ট কী পরিশ্রমই না করত এবং করছে, পাশে থেকে না দেখলে তা বুঝা যায় না।
আসরের অফিসে পত্রিকার জন্য একটা ছোট্ট রুম ছিল। যেখানে আমি, জয়নুল আবেদীন আজাদ, শরীফ আবদুল গোফরান, জাকির আবু জাফর, মোজাক্কেরুল হক বসে পত্রিকার কাজ করতাম। আমাদের সামনে আসত আগামী দিনের কবি সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীরা। কত কথা হতো, কত আশার বাণী উচ্চারিত হতো! কত স্বপড়ব, কত পরিকল্পনা এখনো সে সব আছে। স্বপেড়বরা কখনো মরে যায় না। স্বপেড়বরা স্বপেড়বর জন্ম দেয়। কুঁড়িরা ফুল হয়, ফুলেরা ফল হয়। ফলেরা গড়েছে ফুল মেলা। সে তো আসরেরই অবদান! তোমাদের প্রধান স্লোগান হলো পৃথিবীকে গড়তে হলে সবার আগে নিজকে গড়ো। অনেকবার ভেবেছি, নতুন কোনো স্লোগান তৈরি করা যায় কি না। অনেক ভেবেছি অনেক ড্রাফট করেছি, কিন্তু ঘুরেফিরে মনে হয়েছে এত স্বপড়বময় আর বাস্তব কোনো স্লোগান হয় না। নিজেকে গড়তে হবে নিজের জন্য, পরিবারের জন্য, সমাজের জন্য, দেশ ও জাতির জন্য এবং সর্বোপরি সারা পৃথিবীর জন্য। পৃথিবীর অনেক জায়গায় তোমাদের সাথে দেখা হয়েছে। তোমাদের মানে ফুলকুঁড়িদের সাথে। প্রায় সবাইকে দেখেছি নিজ নিজ জায়গায় ক্যাপ্টেন বনে আছে। তখন আমার কাছে মনে হয়েছে এই আসর যেন ক্যাপ্টেন বানানোর আসর। চোখ বন্ধ করতেই একটি স্লোগান এসে কর্ণকুহরে প্রবেশ করছে ‘ও ক্যাপটেন, মাই ক্যাপটেন’ স্যালুট তোমাদেরকে।