ছোট বড় সবার প্রিয় চিত্রশিল্পী মোমিন উদ্দীন খালেদ

শরীফ আবদুল গোফরান

0
125

রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ছটফট করে ছেলেটি। চোখে মোটেও ঘুম নেই। মনে অনেক ভাবনা। সে আকাশের তারা গোনে। চাঁদের বুড়ির সাথে কথা বলে। চরকা কাটে। গল্প শোনে। মা হাতে বই তুলে দিয়ে বলতেন, পড়তে বসো। কিন্তু তার যে পড়তে ইচ্ছে করে না। তার ইচ্ছে করে শুধু বইয়ের পাতা উল্টাতে। বইয়ের পাতায় পাতায় খুঁটে খুঁটে ছবি দেখতে। একসময় খাতা পেন্সিল নিয়ে বসে যেতেন। শুরু করতেন আঁকাআঁকি। ছবি আঁকা। আঁকতে আঁকতে কাগজ শেষ হয়ে গেলে পুরো বই একেঁ একাকার করে ফেলতো। সে যে ছবি ভালোবাসে, ভালোবাসে ছবি আঁকতে। সেই ছোট বেলায় আঁকা শুরু করে আজ অবধি একেই চলেছেন।
তাকে নিয়ে মা-বাবার অনেক স্বপ্ন। বড় আশা তাঁদের। ছেলে অনেক বড়মানুষ হবে। লেখাপড়া শিখবে। কিন্তু তার যে পড়তে ভালো লাগে না। তার মন ছবির সাথে গাঁথা। মাঠ, নদী, পাখির ছানা, প্রজাপতির উড়াউড়ি, তারার মেলা, চাঁদের হাসি সবই যেন তার কাছে ছবির মতো। বাড়ির পাশে মাঠ। মাঠ বেয়ে বয়ে যায় পাহাড়ি নদী। গ্রীষ্মে এসব মাঠঘাট ধুঁ ধুঁ করে। হাওয়ায় হাওয়ায় কাঁপতে থাকে মাঠের পাকা ধান আর ঘাসের ডগা। এর মাঝে উঁকি দেয় কলমিফুল। গরুর পাল চড়ে বেড়ায় মাঠে মাঠে। বিলেঝিলে ভেসে বেড়ায় বালি হাঁস। বর্ষায় সবুজ ধানে মাঠ ভরে যায়। একসময় ধান পাকে। সোনালি রঙ ধারণ করে। সেই মাঠে ধান কাটতে কাটতে চাষিরা গান ধরে। ভাওয়াইয়া গান, ভাটিয়ালি, পল্লী গান। সে মাঠের চাষিদের কণ্ঠে এসব গান শুনতে শুনতে ও তোলা হয়ে উঠত। বাড়ি ফিরে খাতা পেন্সিল নিয়ে বসে যেত চাষিদের ধান কাটার ছবি আঁকতে। আঁকতে আঁকতে এক সময় খাতার পাতা ভরে যেতো। তবুও আঁকা শেষ হয় না যেন। খাওয়া নেই দাওয়া নেই। শুধু আঁকা আর আঁকা।
ঘুড়ি উড়ানোর জন্যে বাড়ির পাশে মাঠে চলে যেতেন। নাটাইয়ের সুতা ছাড়তে ছাড়তে এক সময় ঘুড়ি নীল আকাশে চলে যেত। এতে তার যে কত সুখ।
প্রজাপতি, ফুল, পাখি এসব তার খুব পছন্দ। অনেক সময় বনে বনে ঘুরে ঘুরে রঙিন প্রজাপতি খুঁজত। ঘুঘুর বাসা খঁজত। তাল গাছের নিচে গিয়ে বাবুই পাখির বাসা দেখত। বাবুয়ের বাসা যখন বাতাসে দুলতো তখন তার মনও এর সাথে সাথে দুলে উঠত। মাঠে মাঠে রাখাল ছেলেরা যখন গরুর পাল ছেড়ে দিয়ে গাছের ছায়ায় বসে বাঁশি বাজাত, তখন সে কি করত জানো? সেও তাদের সাথে গিয়ে বসতো। ছোটবেলায় তো তার স্বপ্ন ছিলো সে একজন শিল্পী হবে। মস্তবড় চিত্রশিল্পী। আসলে বড় হয়ে সে তাই হয়েছে। এখন কতো নাম ডাক তার। পত্রিকায় পাতায় পাতায় তার আঁকা ছবি। সবার মুখে মুখে তার নাম। তা বুঝি তোমাদের জানতে ইচ্ছে করে না? কে সেই নাম করা শিল্পী, কী তার নাম? কি তার পরিচয়? হ্যাঁ বন্ধুরা তা হলে বলছি শোন। তার নাম বললে তো তোমরা চমকে উঠবে। হ্যাঁ, সে আর কেউ নয়, ছোটবড় সবার প্রিয় শিল্পী মোমিন উদ্দীন খালেদ। তার কথাই তো এতক্ষণ তোমাদের বলছিলাম।
কিশোর বেলায় সেই ঘুড়ি উড়ানো, রঙিন প্রজাপতি দিয়েই সখ্য গড়ে ওঠে তার আঁকাআঁকির সাথে। তার ছবির আঁকার হাতখড়ি মা হোসেন আরা চৌধুরীর কাছে। বাবা আলমগীর চৌধুরী ও মা হোসেন আরা চৌধুরী দু’জনই জড়িত ছিলেন লেখালেখির সাথে। তাদেরও রয়েছে অনেক গল্পগ্রন্থ।
এই প্রিয় শিল্পীর জন্ম কোথায় জানো? হ্যাঁ তাহলে বলছি শোনো। মোমিন উদ্দীন খালেদের আদি বাড়ি চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার পাইনদংয়ের হাইদচকিয়া গ্রামের আবদুল খালেক চৌধুরী বাড়ি। বাবা আবাস গড়েন চট্টগ্রামের বাকলিয়ায়। বাড়ির নাম ‘গ্রামীণ’। এই বাড়িতেই ১৯৬২ সালের ৯ মে শিল্পী মোমিন উদ্দীন খালেদ জন্ম গ্রহণ করেন। চট্টগ্রামেই তার লেখাপড়ার হাতে খড়ি। স্কুলে পার হয়ে চারুকলা কলেজ থেকে ১৯৮২ সালে ডিগ্রি এবং চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগ থেকে ১৯৮৬ সালে এম এ পাস করেন। স্ত্রী জিনাত রেহানা। ছেলে মাহদি আল মুবিন এবং কন্যা জারিন তাসনিমকে নিয়ে তাঁর সংসার। পাঁচ ভাই বোনের মধ্যে তিনি বড়। অন্য ভাইবোনেরা কেউ ডাক্তার, কেউবা শিক্ষকতার পেশায় জড়িত। ছোট ভাই মাঈন উদ্দিন জাহেদ। তার নাম সাহিত্য মহলে সবার মুখে মুখে।
তোমরা যদি লক্ষ করো দেখবে শিল্পী মোমিন উদ্দীন খালেদ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তার প্রতিভা, শ্রম ও সাধনার অবদান রেখে যাচ্ছেন। তিনি চিত্র শিল্পে অগ্রপথিকের ভ‚মিকার অধিকারী। তার সুদীর্ঘ কর্মময় জীবনে তিনি অসংখ্য বইপত্রের ও পত্রপত্রিকার প্রচ্ছদ অঙ্কন এবং অভ্যন্তরীণ অলঙ্করণ করা ছাড়াও এঁকেছেন বহু ছবি; সৃষ্টি করেছেন চিত্রশিল্প। জীবন জীবিকার প্রয়োজন কমার্শিয়াল আর্ট বা প্রায়োগিক চিত্রকর্ম করলেও মোমিন উদ্দীন খালেদ পাশাপাশি সৃজনশীল চিত্রকর্মের এবং কার্টুন আঁকার ক্ষেত্রেও তিনি নিবেদিত। কেবল সাধারণ শিল্পকর্মের ক্ষেত্রেও তার অবদান কম নয়। মোমিন উদ্দীন খালেদের চিত্রকর্ম পত্র পত্রিকায় প্রকাশের মাধ্যমে তাঁর সমাজসচেনতা, স্বদেশ প্রেম ও মাতৃভাষা প্রগতি এবং শিল্পদক্ষতার পরিচয়ই দেননি, তিনি তাঁর নির্ভীকতা এবং সাহসিকতার স্বাক্ষরও রেখেছেন। তাইত ছোটবড় সবার প্রিয় এই শিল্পী সংগ্রামী ও বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী। মোমিন উদ্দীন খালেদ শ্রম ও সাধনার মাধ্যমে একজন কৃতী চিত্রশিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত একজন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শিল্পসাহিত্যের প্রতি তার অনুরাগ তার পারিবারিক ঐতিহ্যের অন্তর্গত। মোমিন উদ্দীন খালেদ অত্যন্ত সজীব ও প্রাণবান এবং মনের দিক থেকে তারুণ্যের অধিকারী। এখানেই তো তিনি তোমাদের মতো শিশুদের বড় বেশী ভালোবাসেন। সকল শিশু পত্রিকায় চিত্রকর্মের মাধ্যমে তিনি শিশু কিশোরদের সাথে কতো কথাই না বলেন। গড়ে তোলেন সখ্যতা। বর্তমানে তাঁর কর্মক্ষেত্র জানো? বর্তমানে তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটে তিনি কর্মরত আছেন।
শিল্পী মোমিন উদ্দীন খালেদ অনেক গুলো পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৮২ সালে ভাষা আন্দোলনের ওপর পোস্টার প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার, ১৯৯১ সালে একুশের সংঙ্কলনের প্রচ্ছদ ও অলঙ্ককরণের জন্য জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র পুরস্কার লাভ করেন। এখনো তার তুলি থেমে নেই। তার আঁকাআঁকি চলছে তো চলছেই। প্রতি বছর একুশে বইমেলায় তার আঁকা প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ এগিয়ে থাকে। ফলে সারা দেশের প্রকাশনা ও পাঠক মহলে মুখে মুখে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়েছে।