পরিবর্তন

মাহাথির আরাফাত

0
93

শাইরাকে আমি শুধু একটা কথা বলতে পারি না। ওর সাথে কত কথাই হয়। কিন্তু সে কি আসলে মানুষ না রোবটÑ এটা বলতে আমার মুখে বাধে। খুব সুনিপুণভাবে সে আমার সংসারের কাজকর্ম করে। চেহারা অত্যন্ত চমৎকার। দেখলেই মনে হয় মানবপ্রজাতি। মানুষের চেহারা এত সুন্দরÑ এটা আমি মেনে নিতে পারি না। তবে সে এতই রূপসী যে, কখনো মনে হয়Ñ সে বুঝি কোনো উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন নারীরোবট। আমার স্বামী অনেক দয়ালুগোছের মানুষ। একদিন সন্ধ্যায় দেখি সে শাইরাকে নিয়ে হাজির। কোনো পূর্বপরিকল্পনা ছাড়াই শাইরাকে আমার কাছে নিয়ে এসে বলল, ওর নাম শাইরা, ওর একটা কাজের খুব দরকার। তাই ওকে আমাদের এখানে নিয়ে এসেছি। তুমি ঘরের সব কাজ একা করো। আজ থেকে ও তোমার সব কাজে সহযোগিতা করবে, কেমন? আমি এতে যে অনেক খুশি হয়েছিÑ তা না। আমার কোনো কাজই করতে কষ্ট বা অসুবিধা হয় না। বরং খুব আগ্রহ নিয়েই করি। তারপরও আমার স্বামী কোনো কারণে একে ধরে এনেছে তা ভেবেই পাই না।

যা-ই হোক, মেয়েটিকে (রোবটও হতে পারে) এনেছে ভালোই করেছে। আমি অন্তত কিছু কাজ থেকে রেহাই পেলাম। যেমনÑ আমার স্বামী এখন ওর সাথে হেসে হেসে গল্পগুজব করে। বিকেলে অফিস থেকে ফিরলে ও-ই চা বানিয়ে দেয়। আগে আমি খাওয়ার সময় খাবার পরিবেশন করতাম। এখন ও করে সেটা। আমি শুধু রেঁধে দিই। আমার স্বামী মজা করে খায়। বেশ ভালোই লাগে। আগে আমাকে নিয়ে ঘুরতে যেত, এখন দেখি ওকে নিয়ে খুব আনন্দে এখানে-ওখানে ইচ্ছেমতো বেড়াতে যাচ্ছে। কোথাও বেড়াতে যাওয়া আমার মোটেও ভালো লাগে না। মেয়েটি আসার পর থেকে আমি নিশ্চিন্তে সুখে আছি। কিন্তু আমার স্বামী তো খুব বাড়াবাড়ি করে ফেলছে ইদানীং। আমার দিকে এখন মনোযোগ দিয়ে তাকায়ই না, ভালো করে একটু আধটু কথাও বলে না। আগে আমি তাকে কত রকমের বই পড়ে শুনাতাম। তার প্রিয় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা পড়ে শুনাতাম। শুনেছি এই লোকটা নাকি সাহিত্যে নোবেলও পেয়েছিল। মোটকথা স্বামীর সেবায় আমি সবসময় ডুবে থাকতাম। আমার স্বামীও আমাকে খুব আদর যতœ করত। এখন হলোটা কী ওর? আমার অবশ্য খারাপ লাগে না। থাকুক না ও ওর মতো। ওই মেয়েটিকে (রোবট-ও হতে পারে) নিয়ে যদি সে বেশি সুখে থাকে, তাহলে আমার কোনও আপত্তি নেই। তোমাকে তোমার মতো থাকতে দিলাম, তুমি নিজেকে নিজের মতো গুছিয়ে নাও।
আমার স্বামী যে আমাকে চূড়ান্তপর্যায়ের অবহেলা করছে তা বুঝে ফেললাম সেদিন সকালবেলায়। আমি এক কাপ কফি বানিয়ে ওর সামনে গেলাম। তখন দেখি সে মেয়েটির (রোবট-ও হতে পারে) কোলে মাথা রেখে বাদাম খাচ্ছে। মেয়েটি (রোবট-ও হতে পারে) তাকে বাদামের খোসা ছাড়িয়ে দিচ্ছে। আমি অবশ্য বিষয়টা জটিলভাবে নিইনি। কিন্তু আমার স্বামী যখন বলল যে, আমার হাতের চা-কফি নাকি আজকাল ওর একদমই ভালো লাগে না। তখন থেকেই আমার বুদ্ধিমত্তায় কিঞ্চিৎ কী একটা যেন নাড়া দিয়ে উঠল। আমি ভাবতে লাগলাম আমার স্বামী আমাকে এখন স্ত্রী হিসেবে মেনে নেয় না। ওর আসলে হলোটা কী? ওই কাজের মেয়েটি (রোবট-ও হতে পারে) আসার পর থেকেই আমার স্বামী এমন হয়ে গেল কেন? আবার সেদিন বিকেলেই ঘুরতে গেল ওরা। আমাকে বলেও যায়নি পর্যন্ত। ফিরল অনেক রাত করে। আমি যে খাবারগুলো বানিয়ে রেখেছিলাম, ওগুলো রাতে খেলো না। বাইরে থেকে নাকি খেয়ে এসেছে। যখন শুনলাম মেয়েটিও খেয়ে এসেছে, তখনই বুঝলাম মেয়েটি আসলে পুরোপুরি মানুষ, রোবট না। আমার এত দিনের জমে থাকা সন্দেহ শেষ পর্যন্ত অবসান হলো। কারণ রোবটরা তো কোনো খাদ্য গ্রহণ করে না। আর এটা আমি খুব ভালো করেই জানি। মেয়েটি এতদিন এই বাসায় আমার স্বামীর সাথে কিছু খেয়েছিল কি নাÑ তা আমার চোখে পড়েনি অবশ্য।
আমার স্বামীকে এখন বলতে ইচ্ছে করেÑ ঘরে তোমার জলজ্যান্ত একটা স্ত্রী থাকতে অন্য একটা কাজের লোক রাখার কী দরকার? কিন্তু বলতে সাহসে কুলায় না। আমার বুদ্ধিমত্তায় এত সাহস মজুদ নেই। তবুও ইচ্ছে করে বলতে। কিন্তু ইচ্ছে করলেই তো আর হয় না। সাহস মজুদ থাকতে হয়। আমি তাই এত ঘাঁটাঘাঁটি করলাম না বিষয়টা নিয়ে।
আজকের দিনটা খুব ফুরফুরে। যদিও সকালে আকাশ কিঞ্চিৎ মেঘাচ্ছন্ন ছিল। বিকেলে আমার স্বামী তার কর্মস্থল থেকে ফিরে এসে বলল, তোমাকে এক জায়গায় নিয়ে যাব আজ। আমি খানিক ভেবে বললাম, কখন? সে বলল, এখনই। আমি আবার অল্পক্ষণ ভেবে বললাম, চলো। আমি আসলে এমনই। হুট করে যাবতীয় সিদ্ধান্ত নিতে হয়। আর এমন করেই আমাকে বলা হয়েছিল স্বামীর ঘরে আসার আগে।
স্বামী আমাকে নিয়ে গেল একটা বিশাল বড় ভবনের ভেতর। ভেতরে সবকিছু পরিপাটি করে সাজানো। তকতকে মেঝে, ওপরে লাইটিং ব্যবস্থাও উন্নত। একপাশে সারি সারি যন্ত্রপাতি। আমি একটু পরে বুঝলাম এটা আসলে একটা কারখানা। জায়গাটা আমার খুব চেনা চেনা লাগছে। মনে হচ্ছে আমি এর আগে এখানে ছিলাম। আমার এমন মনে হচ্ছে কেন? আমার স্বামী তারপর আমাকে নিয়ে গেল মিস্টার রিচ নামের এক ভদ্রলোকের কাছে। লোকটা বেশ লম্বা চওড়া। গাত্রবর্ণ ধবধবে সাদা, মাথায় ছোট ছোট বাদামি চুল। নাকের নিচে সামান্য গোঁফের রেখা। মিস্টার রিচ আমাকে বলল, কেমন আছো? আমি তৎক্ষণাৎ ভালো আছি বলে উত্তর দিলাম। তারপর তিনি কিছু যন্ত্রপাতি নিয়ে আমার গায়ে হাত দিলেন। আমি যেন ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছি। আমার স্বামী তখন একটু দূরে চেয়ারে বসে আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে।
দশ মিনিট অতিবাহিত হবার পর আমি মিস্টার রিচকে বললাম, ওই যে চেয়ারে বসে আছেনÑ উনি কে? মিস্টার রিচ বলল, উনি তোমার মনিব। যাও, উনার সাথে বাসায় চলে যাও।
মিস্টার রিচ তখন ওই লোকটাকে মানে আমার মনিবকে বলল, আজ থেকে ও আপনার স্ত্রীরোবট না। এত দিন তো স্ত্রীর ভূমিকায় কাজ করেছে। হা হা হা। স্ত্রী থেকে গৃহপরিচারিকা রূপে সেট করে দিয়েছি এখন। ঘরে তো সত্যিকারের স্ত্রী নিয়ে এসেছেন, ভাই। হা হা হা।
আমি চললাম আমার মনিবের সাথে তার বাসায়। আমাকে এখন কত কাজ করতে হবে। কিন্তু মিস্টার রিচ অকারণে কেন এত হাসল- আমি বুঝলাম না। এত বোঝার ক্ষমতা আমার বুদ্ধিমত্তায় মজুদ নেই। আমি একজন গৃহপরিচারিকা মাত্র। আমাকে কত কাজ করতে হবে এখন থেকে।