অপারেশন তরমুজ

বাকী আব্দুল্লাহ

0
179

বৈশাখ মাস প্রায় শেষ! জৈষ্ঠ এসেই গেল। গরমের মওসুমের কারণে সব স্কুলেই ছুটি চলছে। লিচুর ভরা মওসুম এখন। আঁটির আমগুলো পেকেছে, কলম বাঁধা আম বা ভালো জাতের আমগুলো এখনো তেমন পাক ধরেনি। ভালো জাতের আমগুলোর মধ্যে শুধু হিমসাগর আম পেকেছে। তার পরও সব হিমসাগর আমে এখনো পাক ধরেনি। তবে যে গাছগুলোর বয়স অনেক বেশি সে গাছগুলোর আম পাক ধরেছে অনেকটাই। কোনো কোনো গাছের আম কেবল সিঁদুরে রং নিচ্ছে। কাঁঠালের ক্ষেত্রে ঠিক তেমন। পাকা কাঁঠাল একেবারেই নেই। অনেক পুরোনো গাছগুলোর মধ্যে দু’একটা গাছে কাঁঠাল পেকেছে।
স্কুল ছুটি হয়েছে মাত্র দু’দিন, এর মধ্যে অনেকেই চলে গেছে নিজেদের আত্মীয়বাড়িতে। কেউ মামাবাড়ি, কেউ বোনের বাড়ি, কেউ বা ভাবির সাথে ভাবির বাবার বাড়িতে বেড়াতে গেছে। রাহাত গরমের ছুটিতে কোথাও ঘুরতে যাবে না। তার নানুবাড়ি বেশি দূরে না হওয়ায় সে যেকোনো সময় নানুবাড়িতে যেতে পারে। নানুবাড়িতে যাওয়ার জন্য স্কুল থেকে ছুটি নেয়ার প্রয়োজন হয় না। সে কারণে ছুটির সবসময় গ্রামের বন্ধুদের সাথে কাটায়। এবারো ব্যতিক্রম হবে না রাহাতের। প্রতিবারের মতো এবারের গরমের ছুটিটাও গ্রামে হেসেখেলে কাটাবে সে।

এখন দুপুর। রোদের তেজ তীব্র। রাহাত, রাজু, আরিফ, আসাদ পুকুরপাড়ে বসে আছে। গ্রামের ছেলেমেয়েরা পুকুরে লাফালাফি করছে। রাহাতদের পুকুরের পাড়ের বিশাল একটি কাঁঠালগাছ পুকুরের দিকে হেলে আছে। ছেলেমেয়েরা সেই গাছের মগডালে উঠে পুকুরের পানিতে লাফিয়ে পড়ছে। পানিতে লাফিয়ে পড়ে যেন এক স্বর্গীয় সুখ অনুভব করছে তারা। এ কারণে পানি থেকে উঠে আবারো সেই গাছের মগডালে উঠছে এবং আগের মতোই পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। ছেলেমেয়েদের লাফালাফি দেখে মাছেরাও লাফিয়ে উঠছে। প্রতিটি লাফের সাথে সাথে পুকুরের পানি লাফিয়ে এসে পাড়ে ধাক্কা খেতে থাকে, আর সেই ধাক্কার সাথে সাথে দুই একটা মাছ লাফিয়ে শূন্যে ভেসে সূর্যের দর্শন নিচ্ছে। পুকুরের এক পাড়ে হেলে পড়া আমগাছ থেকে রাজু বেশ কিছু আম পেড়ে এনেছে। বাড়ি থেকে মরিচের গুঁড়ো আগেই এনে রেখেছিল। ঝিনুকের খোসা ঘঁষে তৈরি বিশেষ কাটার দিয়ে আম ছিলছে এবং নারিকেলে মালায় রাখা লবণ ও মরিচের গুঁড়ো একটু একটু করে নিয়ে আম মেখে মেখে খাচ্ছে ওরা। পুকুরের দক্ষিণ পাশের মাঠে রজনীর চাষ করেছে কলিম চাচা। যার কারণে দক্ষিণ পাশ থেকে রজনীগন্ধার বাতাস এসে পুরো এলাকা সুবাসিত করে তুলেছে। দক্ষিণ পাশ থেকে বাতাস এলে রজনীর সুবাসমাখা বাতাস ভেসে আসে। আর যখন উত্তর পাশ থেকে বাতাস আসে তখন উত্তর পাশে থাকা বিশাল বিশাল কয়েকটি আঁটির আমগাছ থেকে পাকা আমের ঘ্রাণ এসে পাকা আমের গন্ধে লোভনীয় পরিবেশ তৈরি করছে। পাকা আমের গন্ধ নাকে এলে রাহাতরা স্থান পরিবর্তন করে আটির আমের বাগানে যায়। চতুর্দিকে ডালপালা ছড়ানো একটি গাছে উঠে ওরা সবুজ পাতা ও সবুজ আমের মধ্যে থেকে খুঁজে খুঁজে দু-একটা পাকা আমের দেখা পায়। সেই আম পেয়ে আনন্দে মেতে ওঠে সকলেই। ওরা সবাই প্রতিযোগিতা করে পাকা আম খোঁজা শুরু করে, যার ফলে গাছ নড়ে ওঠে আর সেই নড়ে ওঠা ঝাঁকুনিতে বেশি পাকা আমগুলো থপাস করে মাটিতে পড়তেই পুকুরে গোসল করতে থাকা ছেলেমেয়েরা দৌড়ে গিয়ে আমগুলো কুড়িয়ে নেয়। আম পেয়েই দৌড়ে পুকুরের পানিতে নেমে ডুব দিয়ে গোসল করতে থাকা অন্য ছেলেমেয়েদের মধ্যে হারিয়ে যায় ওরা।

গ্রীষ্মের বিকেল! এই সময়টাতে বিকেল বেলা কাউকেই বাড়িতে পাওয়া যায় না। সাত্তার মাস্টারের বিশাল উঠানটাতে অন্য সময় অসংখ্য ছেলেমেয়ের ভিড় থাকলেও গ্রীষ্মের এই সময়টাতে খেলা করার জন্য
কোনো ছেলেমেয়েকে খুঁজে পাওয়া যায় না। সবাই গরু নিয়ে মাঠে চলে যায়। মাঠে গিয়েই সবার সব রকমের খেলাধুলা হয়। অন্য ঋতুগুলোতে বাড়ির উঠানে খেলাধুলা হলেও এই গ্রীষ্মের সময় মাঠে চাষের জমিতে খেলা হয়। কয়েক হাজার একর চাষের জমি নিয়ে রাহাতদের গ্রামের মাঠ। এই বিশাল মাঠের চারপাশে তরিতরকারি, শাকসবজি ও ফুলের চাষ হয়। সামান্য কিছু জমিতে পাটের চাষও দেখা যায়। আর মাঠের মাঝখানটা সব ধানচাষ হওয়ার কারণে বৈশাখ মাসের ২০ তারিখের পর থেকে আষাঢ় মাসের ১৫ পর্যন্ত মাঠ ফাঁকা পড়ে থাকে। আর এই সময়টাতে গ্রামের লোকেরা মাঠে গরু চরায়। গ্রামের প্রতিটি বাড়িতেই একাধিক গরু আছে। রাহাত সচ্ছল পরিবারের ছেলে। তার বাবা স্কুলশিক্ষক তারপরও তাকে বিনোদনের জন্য গরু চরাতে যেতে হয় মাঠে। মাঠে না গিয়ে কি উপায় আছে এ দু’মাস তো কেউই বিকেল বেলায় বাড়ি থাকে না। তাই বাধ্য হয়ে তাকেও গরু চরাতে যেতে হয় সবার সাথে।
বাড়ির প্রাচীরের সাথে টিনের ছাপড়া সেখানে রাহাতদের ছয়টা গরু থাকে। রাহাত এক এক করে ছয়টা গরুর গলা থেকে দড়ি খুলে দেয়। গরুগুলো ধীরে-ধীরে মাঠের দিকে রওনা হয়েছে। এমন সময় সে দুটি কোকিলের চিৎকার শুনতে পায়। ওপরের দিকে তাকিয়ে দেখতে পায়। তাদের গাছে দুটি পেঁপে পেকেছিল সে দুটির একটির অর্ধেক আর অন্যটি সামান্য খেয়ে ফেলেছে কোকিল। আর এই পাকা পেঁপে নিয়ে ফিঙে আর কোকিলের মধ্যে ঝগড়া লেগেছে। রাতুল একটি ঢিল নিয়ে পাখিদের উদ্দেশে ছুড়ে দিয়ে বলে, “গাছ লাগালাম আমরা, জমি আমাদের, সেই গাছে পেঁপে পেকেছে সেটা ফ্রিতে খাচ্ছো তাও আবার ঝগড়া করছো। গরু বেশ দূরে চলে যাওয়ায় রাতুল দ্রুত দৌড়ে গরুগুলোর কাছে চলে যায়। শুধু রাতুল নয় অনেকেই গরু নিয়ে মাঠের দিকে যাচ্ছে। গ্রামের মেঠোপথ গরুর পায়ের ধুলোয় অন্ধকার হয়ে গেছে। রাস্তা থেকে বেশ ঢালু মাঠে যাওয়ার পথটি, সেই ঢালু পথে নিজেরদের পা নিয়ন্ত্রণে রেখে গরুগুলো মাঠের দিকে ধেয়ে যাচ্ছে। যাওয়ার সময় একটি গরু অন্য গরুর গায়ের সাথে ঘষাঘষি করতে করতে এগিয়ে যায়। সুযোগ পেলে এই ভিড়ের মধ্যে চালাক বাছুরগুলো অন্য গাভীর দুধ খেয়ে নেয়। গ্রামের রাস্তা থেকে মাঠের দিকে যে রাস্তা নেমে গেছে সেই রাস্তার মুখেই কিছু তরকারির ক্ষেত আছে। তাই ক্ষেতের পাশে লাঠি নিয়ে একজনকে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। বিশ মিনিট ধরে শুধু গরু মাঠে নামতে থাকে ওই মেঠোপথ দিয়ে। এরপর সামনের গরুটাকে অনুসরণ করে পেছনের গরুগুলো ঘাসের সন্ধানে ছুটে চলেছে বিশাল মাঠের মধ্যে। যেখানে ঘাস আছে সেখানে খেতে শুরু করে দেয় গরু। কিছুক্ষণ পর দেখা যায় সহ¯্রাধিক গরুর একটি পাল মাঠে খাচ্ছে দলবেঁধে। আপনমনে গরুগুলো খেতে থাকে।

গরুগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য ১৫ টিম করা হয়েছে। প্রতিদিন দুটো করে টিম গরু নিয়ন্ত্রণ করে আর বাকি ১৩ টি টিম খেলাধুলা করে। বিভিন্ন রকমের খেলা। মাঠের মাঝখানে ছয়টি লোকেশনে ক্রিকেট খেলার জন্য পিচ কাটা হয়েছে। এর মধ্যে মাথা ভাঙার মাঠে একটি, হেলেঞ্চা, লক্ষ্মীবিল, ঢেউবিল, বকেরবিল ও পড়ে বটতলা মাঠে একটি করে মাঠ করা হয়েছে। গরুগুলোকে সপ্তাহে ছয়টি স্থানে নিয়ে যাওয়া হয় চরানোর জন্য। সে কারণে ছয়টি স্থানে ছয়টি মাঠ করা হয়েছে। দাঁড়িয়াবান্ধা, বৌফেলা, পাঁচুন পোতা, ক্রিকেট, ফুটবল আরো কতো খেলা খেলে তারা। আজ লক্ষ্মীবিলে খেলা হচ্ছে। রাহাতেরা ক্রিকেট খেলছে, ওদের কাছ থেকে সামান্য দূরেই ফুটবল খেলছে কিছু ছেলে। রাহাতদের টিমে ব্যাট করছে, রাহাত কলাপাতা চিরে চিরে রান গুনছে। যে কয়টা রান হচ্ছে কলাপাতা থেকে চিকন করে একটা ভাগ করে নেয়া হচ্ছে। খেলা শেষে চিকন অংশগুলো গুনলে কত রান হয়েছে সেটা বোঝা যায়। আবার কোনো কোনো দিন রান গোনার জন্য বাড়ি থেকে খাতা নিয়ে আসে ওরা!।
হঠাৎ দেখা গেল ইশারত মিয়ার ছেলে ফয়সাল হাঁপাতে হাঁপাতে এসে কী যেন বলল, সবাই ছুটে চলল গরুর পালের দিকে। রাহাতেরাও রানগোনা ফেলে রেখে গরুর পালের গিয়ে ছুটে গেল। সেখানে গিয়ে দেখা ুেগল রমজান আলীর ষাড় আর আকবর আলীর বিশাল ষাঁড় লড়াই বাধিয়েছে। সবাই মিলে পাঁচুন (বাঁশের তৈরি লাঠি) দিয়ে ষাঁড়ের গায়ে মাথায় আঘাত করতে থাকে দশ মিনিট আঘাত করার পর রমজান আলীর ষাঁড়টাকে উদ্ধার করা হলো। আকবর আলীর ষাঁড়টার গায়ে অজ¯্র পাঁচুনের আঘাতে গা ফুলে উঠেছে। পাঁচুন দিয়ে মাইরের দাগগুলো খুব স্পষ্টভাবেই বোঝা যাচ্ছে। দলনেতা জামাল বলল, আকবর আলির ষাঁড়টাকে কে রাগিয়েছে? ফয়সাল বলে, জামাল ভাই। রমজান আলির ছেলে হাবিল আর আকবরের ছেলে ইন্তা তর্ক করে দুই গরুর লড়াই লেইগেছে।
জামাল রেগে বলে, ‘ওদের দুজনকে ধরে নিয়ে কিরিচির (ক্রিকেট পিচ) কাছে চল’ তারপর বিচার হবে। ওদেরকে ধরে নিয়ে আসা হলো ক্রিকেট খেলার মাঠের কাছে। তারপর গামছা দিয়ে দুজনের হাত বাঁধার হুকুম দিলে ছেলেরা হাত বাঁধে। এরপর সেই হাতের ভেতর দিয়ে হাঁটু ঢুকিয়ে হাঁটুর মাঝখানে পাঁচুন ঢুকিয়ে দেয় জামাল। পাঁচুনের দুই মাথা হাঁটুর দু’পাশ থেকে বেরিয়ে আছে। এবার তাদেরকে চিৎ করে রেখে দেয়া হয়। এটাই হচ্ছে এই মাঠের শাস্তি। এটাকে আঞ্চলিক ভাষায় ঘেড়ি বলে, হাবিল আর ইন্তা এক পাশে পড়ে আছে। ছেলেরা সবাই আবার খেলায় মনোযোগী হয়।
সন্ধ্যায় গরু নিয়ে বাড়ি ফেরার সময় তাদের শাস্তির সময়সীমা শেষ হবে। এর মধ্যে দলনেতার আবারো ডাক পড়ে। দলনেতা চলে যায়। সেখানে গিয়ে দেখতে পায় যে খয়রুন বিবির ছাগলের বাচ্চা হচ্ছে। কয়েকজনের সহযোগিতায় ছাগলটির তিনটি বাচ্চা হয়। তিনটিই খাসি বাচ্চা। সবাই বেশ খুশি। খয়রুন বিবির ছাগলের তিনটি বাচ্চা হয়েছে। তার মানে কাল খয়রুন বিবি সবাইকে খাওয়াবে। খাবার নিয়ে আসার দায়িত্ব দেয়া হলো তিনজনকে।
সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে গেছে আরো কিছুক্ষণ আগে। পশ্চিমে গ্রামের গাছের নিচে চলে গেছে অর্ধসূর্য, বাকি অর্ধেকটা ডোবার অপেক্ষায়। এখন সবাই বাড়ি ফিরে যাবে। বাড়ি ফেরার পালা। মাঠের সহ¯্রাধিক গরুর পালকে বাড়ির দিকে মুখ করিয়ে দিয়ে সবাই মহিষের পিঠে উঠে পড়ে।
মহিষের পিঠে করে বাড়ি ফিরছে সবাই। গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া সবগুলোরই পেট ভরে গেছে মাঠের ঘাস খেয়ে। তাই তারা ধীরে ধীরে চলছে। ছেলেমেয়েরাও মহিষের পিঠে চড়ে আনন্দ করতে করতে যাচ্ছে। খেলায় কে হারল, কে জিতল এই নিয়ে আলোচনা করছে কেউ। কেউ আবার গরুর লড়াই নিয়ে আলোচনা করছে।
রাহাত আর আছাদ একটি মহিষের পিঠে চড়েছে। রাজু আর আরিফ একটি গাভী মহিষের পিঠে চড়েছে। হাবিল ও ইন্তাকে শাস্তি দেয়া হয়েছে, সে কারণে খয়রুন বিবির ছাগলের বাচ্চাগুলোকে কোলে করে নিয়ে আসার দায়িত্ব পড়েছে তাদের। হাবিল দুটো বাচ্চা কোলে নিয়েছে এবং ইন্তা একটা বাচ্চা নিয়ে গরু ও মহিষের পেছনে পেছনে ধুলো মাখতে মাখতে আসছে। গরুর পায়ের সাথে মাটির ঘষা খেয়ে ধুলো ওড়ে। হাবিল আর ইন্তা গরুর পালের একেবারে পেছনে থাকার কারণে ধুলোদের ওড়াউড়ি খেলায় ওদের মাথার চুলগুলো ধূসর হয়ে যায়। একেবারে সামনের গরুগুলো গ্রামের ভেতরে ঢুকে গেছে। এখন নিজ দায়িত্বেই গৃহস্থের গোয়ালঘরে গিয়ে উঠছে গরুগুলো। প্রতিটি গরুই তার গৃহস্থের বাড়ি খুব ভালোভাবে চেনে। এ কারণে গরু বাড়ি নিয়ে যেতে তেমন ঝামেলা পোহাতে হয় না। গোয়ালের সামনে ডাবায় রাখা পানি খেয়ে গোয়ালে ঢুকে যায় গরুগুলো।

রাত আটটা। রাহাতরা সবাই একত্র হয়েছে। মাঠের মাঝখানে বেশ কিছু তরমুজের ক্ষেত আছে। ওরা আজ সেখানে যাবে তরমুজ চুরি করতে। চাঁদের বয়স বারো-তেরো দিন হয়ে গেছে। এ কারণে সন্ধ্যাবেলায় ঘোর অন্ধকার নামে। তবে রাত দশটার পরেই জোছনার দেখা মিলবে। ওরা সবাই তরমুজের ক্ষেতের দিকে রওনা হয় রাত নয়টার দিকে। রাহাত দাঁড়িয়ে আছে। আসাদ, রাজু ও আরিফ তিনজন গেছে তরমুজ ছিঁড়তে। তিনজনে ৯টা তরমুজ ছিঁড়ে একটি বস্তার মধ্যে নিয়ে চলে আসে। তরমুজগুলোর সাইজ ছোট হওয়াতে ৯টা ছিঁড়েছে। কারণ এই সাইজের তরমুজ একজনে একটার বেশি খেতে পারবে। তারপর না খেতে পারলে কালকে খাওয়া যাবে। এই ভেবে নয়টা তরমুজ ছিঁড়েছে তারা। তরমুজের বস্তা মাথায় নিয়ে ওরা গ্রামের দিকে রওনা হয়।

তরমুজ নিয়ে তারা রাহাতদের পুকুরের পশ্চিম পাড়ে বসেছে। এখন জোছনা উঠে গেছে। আসাদ তরমুজ কাটার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তরমুজ কাটার সময় আসাদ বলে, ‘ছোট কালো তরমুজ হেব্বি মিষ্টি হবে।’
‘আমারও তাই মনে হয়।’ বলে রাজু।
আসাদ তরমুজ কেটে চার ফালি করেছে। এবার চারজন চারটি তরমুজ নিয়ে একসাথে তরমুজে কামড় দেয়। কামড় দিয়েই থেমে যায় সবাই।
‘কিরে এই তরমুজ চালকুমড়োর মতো গন্ধ ক্যান? রাহাত বলে।
আসাদ বলে, ‘আমিও তো তাই ভাবছি! বোধহয় এটা কাঁচা, এ কারণেই এমন লাগছে। আর একটা কেটে দেখি।
এরপর আর একটা কাটে। ওই তরমুজটারও একিই স্বাদ। ওটাও এক কামড় দিয়ে রেখে দেয়। এরপর একেক করে নয়টা তরমুজই কাটে। সবকটা তরমুজেরই এক গন্ধ, একিই স্বাদ, চাল কুমড়োর মতো গন্ধ আর পানসে।
‘নয়টা তরমুজ নিয়ে এলাম একটাও পাকা না। সব কয়টা ফুলো ‘বেশ আফসোসের সাথে বলে আসাদ
রাহাত বলে, ‘এ্যাঁ কাটার সময় তো খুব বলছিলি ছোট কালো তরমুজ খুব মিষ্টি হবে, আরে মিষ্টি তো দূরের কথা! এ তো তরমুজের মতোই মনে হয় না।
‘তরমুজ ফুলো হলে কী করবো, আমরা তো এনেছি ঠিক।’ রাজু বলে
রাহাত বলে, ‘আমি রান্নাঘর থেকে দিয়াশলাই আর কিছু পাটখড়ি নিয়ে এসে দেখছি তরমুজগুলো এমন হলো কেন? একথা বলেই রাহাত দৌড়ে বাড়ির দিকে যায়।
আসাদ আরিফকে বলে, তোদেরকে বললাম, চল লক্ষ্মীবিলে আবুলের পুকুরপাড় থেকে বড় তরমুজ নিয়ে আসি। তোরা বললি না, এঁকেন তে নে। এত কষ্ট করে তরমুজ আনলাম একটা তরমুজও পাকা না!
রাতুল দিয়াশলাই আর পাটখড়ি নিয়ে এসেছে। কিন্তু এলোমেলো বাতাসের কারণে দিয়াশলাইয়ের কাঠি থেকে পাটখড়িতে আগুন জ্বালানো সম্ভব হচ্ছে না। চারজন মিলে একটি বৃত্ত তৈরি করে যাতে বৃত্তের ভেতরে বাতাস প্রবেশ না করতে পারে। এরপর দিয়াশলাইয়ের কাঠি ঠুকে পাটখড়িতে আগুন দেয়। আগুন নিয়ে তরমুজের কাছে গিয়ে সবার চোখ কপালে ওঠে! আরিফ আর আসাদ রাজুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে কিছুক্ষণ মেরে নেয়।
‘আমার কী দোষ, তোরা দেখে নিতে পারলি না কেন?’ রাজু বলে
আসাদ বলে, ‘তুই’ই তো ক্ষেত দেখিয়ে দিয়েছিলি, যার কারণেই তো আমরা তরমুজ ভেবে এই চালকুমড়ো এনেছি।
চালকুমড়ো হলেও তো হতো, এ-তো জালি কুমড়ো। এই জালি কুমড়ো আমাকে রান্না করে দিলেই খাই না। আর আজ তোদের কারণে কাঁচা চিবিয়ে খেয়েছি। একবার না, নয়টা কুমড়োতে নয়বার কামড় দিয়েছি।
রাজু খুব কষ্টের সাথে বলে, ‘চালকুমড়ো যে কেন তরমুজের মতো হতে গেল।
রাহাত বলে, ‘হুম চিচিঙ্গার মতো হলেও তো পারত। তাই..না..।