জাতীয় কবির ‘সংকল্প’ নামের কবিতাটি নিশ্চয়ই তোমরা পড়েছো-
“কীসের অভিযানে মানুষ চলছে হিমালয়ের চুড়ে
তুহিন মেরু পার হয়ে যায়
সন্ধানীরা কীসের আশায়;
হাউই চড়ে চায় যেতে কে চন্দ্রলোকের অচিনপুরে
শুনবো আমি, ইঙ্গিত কোনো ‘মঙ্গল’ হতে আসছে উড়ে।”
এমনই তো হয় অভিযাত্রীরা। ‘আপন সীমার বাঁধন টুটে’ তারা ছুটে যান দিকে দিকে; দেশ দেশান্তরের অজানাকে জানতে, অদেখাকে দেখতে, নতুন নতুন আবিষ্কারের নেশায়।
ধর্মপ্রাণ মানুষ যেমন মনে মনে স্বপ্ন দেখেন জীবনে অন্তত একবার মক্কা মদিনায় যাবেন, তেমনই বিশ্বের তাবৎ পর্যটক, অভিযাত্রী ইচ্ছা পোষণ করেন পৃথিবীর সর্বশেষ সীমায় পৌঁছার। যেখানে বছরের ছয় মাস দিন আর ছয় মাস রাত এমন দৃশ্য দেখতে কার না মন চায়! আর সেখানেই যদি থাকে মেরুপ্রভা বা মেরুজ্যোতি (নর্দার্ন লাইটস বা অরোরা বোরিয়ালিস) দেখার সুযোগ তাহলে তো কথাই নেই। মেরুপ্রভা হলো মেরুর দিগন্তে রাতের অন্ধকারে হঠাৎ ঝলসে ওঠা সবুজ, গোলাপি, ঈষৎ বেগুনি, মাঝেমধ্যে নীল ও সাদা আলোর বিচিত্র ঝলকানি। যারা এই মায়াবী ‘আলোর নাচন’ নিয়ে আগ্রহী, তারা জেনে নিও আলাদা করে। আজ শেষ সড়কপথের কথা বলি।
পৃথিবীর শেষ সড়কপথ তোমাকে নিয়ে যাবে পৃথিবীর সবচেয়ে উত্তরের এমন একটি জায়গায় যার পর আর কোনও রাস্তা নেই। মানে এটাই আখেরি রাস্তা।
পৃথিবীর শেষটা কোথায়? এই প্রশ্নে মানুষের কৌতূহলের শেষ নেই। অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমীরা সেই স্থান দেখতে চান সরেজমিনে। কিন্তু সেখানে পৌঁছানো কি সম্ভব? উত্তর, হ্যাঁ, সম্ভব। পৃথিবীর শেষ রাস্তাটির নাম হলো ই-৬৯ হাইওয়ে। মেরুজ্যোতি দেখা যেমন যেকোনো অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমীর স্বপ্ন, তেমনই পৃথিবীর শেষ রাস্তা (Last Road Of The World.) ধরে একবার হেঁটে যাওয়া। কিন্তু এই রাস্তাটিকে কেন বিশ্বের শেষ রাস্তা বলা হয়? আর কেনই বা সেখানে একা যাওয়া মানা? সেখানে গেলে কি অতল গহ্বরে তলিয়ে যাওয়ার ভয় আছে? কেন এত রহস্য সেই রাস্তা ঘিরে? কোথায় শুরু, আর কোথায় শেষ হয়েছে এই রাস্তা? চলো, জেনে নেয়া যাক।
পৃথিবীর শেষ রাস্তা ই-৬৯ হাইওয়ের অবস্থান উত্তর গোলার্ধে অর্থাৎ নিরক্ষরেখার উপরের দিকে। উত্তর মেরুর গা ঘেঁষে সড়কটি চলে গেছে নরওয়ের ওল্ডারফিউওর্ড গ্রাম (Olderfjord) থেকে উত্তর ইউরোপের নর্ডক্যাপ (Nordkapp) পর্যন্ত। যার পর আর কোনও সড়ক নেই। সেজন্যেই নরওয়ের ‘ই-৬৯ হাইওয়ে’ নামের এই সড়কটিকে বলা হয় পৃথিবীর শেষ রাস্তা বা Last Road Of The World.
অরোরা বা উত্তরের আলোর নাচন যদি হয় প্রকৃতির বিস্ময়; শেষ সড়ক হলো আধুনিক প্রকৌশলের বিস্ময়, যা মানুষের হাতে তৈরি। প্রায় ১২৯ কিলোমিটার দীর্ঘ এই পথে আছে পাঁচটি টানেল। টানেলগুলোর মোট দৈর্ঘ্য সাড়ে ১৫ কিলোমিটার। এর মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘ টানেলটির দৈর্ঘ্য প্রায় সাত কিলোমিটার।
নরওয়ের ফিনমার্ক অঞ্চলের একটি মনোরম হাইওয়ে ই-৬৯, যে পথে মনোরম ও চোখ ধাঁধানো নৈসর্গিক দৃশ্য বেশুমার। আছে বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক তাৎপর্যও। ইউরোপীয় রুট (ই-রুট) নেটওয়ার্কের সবচেয়ে মনোরম হাইওয়েগুলোর অন্যতম এই পথেই তুমি দেখতে পাবে সামি জনগোষ্ঠীর মানুষ ও তাদের জীবনযাত্রার বৈচিত্র্য। সামি একটি আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী, যারা ছড়িয়ে আছে নরওয়ে, সুইডেন, ফিনল্যান্ড এবং রাশিয়ার কোলা উপদ্বীপের উত্তরাঞ্চলেও। এদের মোট জনসংখ্যা এক লাখেরও কম।
এই পথে গেলে দুপাশে নজরে আসবে ছবির মতো অপূর্ব সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য। কোথাও সুনীল আকাশের পটে দিগন্ত বিস্তৃত সমুদ্রের বিপুল জলরাশি, কোথাও টানা পাহাড়শ্রেণী, কোথাও শুধু শুভ্র সফেদ বরফ, বরফ আর বরফ। আর শীতের দেশের মানুষের জীবন সংগ্রামের চিত্র। এই রাস্তা দিয়ে জীবনে একবার অন্তত না গেলে অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমীদের জীবনই বৃথা।
একা যাওয়ার সুযোগ নেই
সবকিছুরই নিজস্ব সুবিধা অসুবিধার দিক আছে। ই-৬৯ হাইওয়েরও। তাই এ পথে ভ্রমণের কিছু নিয়ম বাঁধা আছে। নিয়ম না মানলে সেখানে যাওয়ার কথা ভুলেও ভাববে না। প্রথমত এই সড়কে একা যাওয়া নিষেধ। কিন্তু কেন? রহস্যময় এই পথটি কি খুব ভয়ানক? উত্তর হ্যাঁ কিংবা না দুইই হতে পারে। এর অভিনব ভৌগলিক অবস্থানের কারণে এখানে কাউকে একা যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয় না। এখানে যেমন ভয়ানক গতিতে ঝড়ো বাতাস বয়ে যায় তেমনই ঠান্ডাও মারাত্মক। শীতে তাপমাত্রা মাইনাস ৪০ ডিগ্রি ছাড়িয়ে নেমে যায়। আর গ্রীষ্মকালেও মোটামুটি শূন্যের কাছাকাছি থাকে। গ্রীষ্মেও বরফ পড়ে। এখানে আবহাওয়ার কোনও ধরাবাঁধা বৈশিষ্ট্য নেই। এই ঝড়, তো এই বৃষ্টি। হঠাৎ শুরু হতে পারে প্রচণ্ড তুষারপাত অথবা দৃষ্টি আচ্ছন্নকারী তুমুল বর্ষণ। কখন কী অবস্থা থাকবে, বলতে পারে না কোন অত্যাধুনিক আবহাওয়া দপ্তরও। কিছুই বলে কয়ে আসে না। আর এই অপ্রত্যাশিত আবহাওয়ার কারণেই এ পথে কাউকে একা যেতে দেওয়া হয় না। অনেকে মিলে প্রোগ্রাম করে রীতিমতো গাড়ির বহর নিয়ে যেতে চাইলে তবেই অনুমতি মিলবে ভ্রমণের। এটা এজন্যে যে, কোনও কারণে কেউ বিপদে পড়লে অন্যরা যেন সাহায্য করতে পারে।
শীতকালে বরফ জমার কারণে রাস্তা বন্ধ থাকে, বিশেষ করে সর্ব উত্তরের অনেকটা অংশ। অতিরিক্ত তুষারপাত বা বৃষ্টি হলে এখানে গাড়ি চালানো ভয়ানক বিপজ্জনক।
শেষ পথের শুরু
১৯৩৪ সালে হাইওয়ে তৈরির সিদ্ধান্ত চ‚ড়ান্ত হয়। পরিকল্পনায় পর্যটন, মৎস্যচাষ ইত্যাদি শামিল ছিল। রাস্তার সম্প্রসারণ হয়েছে ধীরে ধীরে। পুরো রাস্তার নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয় ১৯৯২ সালে। নরওয়ে এমন একটি দেশ যেখানে একজন পর্যটকের আগ্রহের তালিকার অনেক কিছুই পাওয়া সম্ভব। এর মধ্যে অন্যতম, সড়ক পথে উত্তর মেরুর যতোটা সম্ভব কাছাকাছি পৌঁছানোর এই হাইওয়ে। একবার যদি ভ্রমণ করো, তবে নিশ্চিত, এটি তোমার জীবনের সেরা স্মৃতি হয়ে থাকবে। ০