মুখ পুড়ল শেয়ালের

আমিনুল ইসলাম হুসাইনী

0
22

গ্রাম থেকে অনেক দূরে; মধুডাঙা বন। দূর থেকে ছায়ার মতো দেখায়। এই বনে বাঘও নেই, সিংহও নেই। আছে কেবল খরগোশ, হরিণ, বানর আর কিছু পাখি। সে বনের রাজা ছিল একটা শেয়াল। শেয়ালটা ছিল খুবই দুষ্ট। বনের নিরীহ পশুপাখিদের অনেক কষ্ট দিত!

দুষ্ট শেয়ালের দুষ্টামি দিনদিন বেড়েই চলেছে। আজ কচ্ছপের মাছ কেড়ে নেয় তো- কাল কুমিরের ডিম খেয়ে ফেলে। ওর ভয়ে পাখিদের চোখেও ঘুম নেই। কে জানে; কখন কার ছানা চুরি করে নিয়ে যায়!

বনের হিজল গাছে ছিল মাছরাঙার বাসা। সে বাসায় মাছরাঙার আরও দুই বন্ধু থাকে। কাঠঠোকরা ও ছোট্ট টুনটুনি।
কাঠঠোকরা বনে গিয়ে কাঠ কাটে। মাছরাঙা শিকার করে টাটকা পুঁটিমাছ। টুনটুনি সেই মাছ এত্ত মজা করে রান্না করে, ঘ্রাণেই জিভে জল চলে আসে। কিন্তু দুষ্ট শেয়ালের ভয়ে তাদের কারো মনে সুখ নেই। টুনটুনিকে সারাদিন একা থাকতে হয়। দুষ্ট শেয়ালটা যদি কিছু করে বসে!
এই ভয়ে গত সাত দিন মাছরাঙা মাছ শিকারে যায়নি। কাঠঠোকরাও বনে গিয়ে কাঠ কাটেনি। ওরা ঘরে বসে টুনটুনিকে পাহারা দেয়। কিন্তু এই সাত দিনে ওদের জমানো সব মাছ ও কাঠ ফুরিয়ে যায়। সে জন্যেই লোকে বলে- বসে খেলে রাজার ভাণ্ডারও ফুরিয়ে যায়!

আজ সকালে মাছরাঙা ও কাঠঠোকরা কাজে বেরিয়েছে। যাওয়ার সময় টুনটুনিকে পইপই করে বলে দিয়েছে- আমরা কাজে যাচ্ছি। তুমি ঘর-দোর দেখে রেখো। সাবধান! টুঁ শব্দটিও করো না। দুষ্ট শেয়াল যা-ই বলুক, ঘর থেকে বের হবে না।
দুষ্ট শেয়ালটা কিন্তু কাছেই ছিল। একটা ঝোপের ভেতর লুকিয়ে সব কথা শুনছিল। মাছরাঙা ও কাঠঠোকরা চলে যেতেই দুষ্টটা ঝোপ থেকে বেরিয়ে আসে। তারপর হিজল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে ছড়া কাটে-

টুনটুনি টুনটুনি
কেমন আছিস ভাই?
কত দিন হলো ও রে
দেখা তোর নাই!
আয়, আয় ভাই
তোর সাথে সুখ দুখ
ভাগ করে যাই।

শেয়ালের ছড়া শুনে টুনটুনি গলে যায়। ভুলে যায় বন্ধুদের বারণ। বোকাটা দরজা খুলে নাচতে নাচতে বাইরে বেরিয়ে আসে। আর তখনই দুষ্ট শেয়াল খ্যাঁক করে ধরে ফেলে। তারপর দিলো এক ছুট…।
টুনটুনি তখন বন্ধুদের চিৎকার করে ডাকলো-

দুষ্ট শেয়াল নিলো ধরে
তোমরা গেলে কই
জলদি এসো বন্ধু আমার
বাঁচাও প্রাণের সই।

টুনটুনির ডাক শুনতেই মাছরাঙা ও কাঠঠোকরা ছুটে আসে। তাদের ধারালো ঠোঁট দিয়ে শেয়ালকে আচ্ছা মতো কামড়ে দেয়। ওদের ধারালো ঠোঁটের কাছে শেয়াল যেন দুধের শিশু। শেয়ালের পুরো শরীর চালুনির মতো ঝাঁঝরা হয়ে গেছে! শেষে টুনটুনিকে রেখে প্রাণ নিয়ে পালালো।

টুনটুনিকে বন্ধুরা আচ্ছামত বকুনি দেয়। কাঠঠোকরা বলে, বোকার হদ্দ একটা। কতবার বলেছি, ঘরের বের হবে না।
অভিমানে টুনটুনির ঠোঁট ফুলে ওঠে। কাঁদতে কাঁদতে বলে- আমি না হয় একটু বোকা। শেয়ালের মতো লোভী তো নই। তোমরা আমাকে বকতে পারলে?
মাছরাঙা ও কাঠঠোকরা দুজনেই স্যরি বললো। এতে কাজ হয়। টুনটুনির অভিমান পড়ে যায়। এরপর তিন বন্ধু শেয়ালকে শাস্তি দেওয়ার পরিকল্পনা করে।

পরদিন সকাল।
দুষ্ট শেয়ালটা আবারও আসে। ঝোপের ভেতর লুকিয়ে মাছরাঙাদের কথা শোনে। ঘরের ভেতর তখন মাছরাঙা ও টুনটুনি কথা বলছিল। মাছরাঙা টুনটুনিকে বলে- শোনো টুনটুনি, ওই কলসে আমার সাতটা ডিম আছে। ঘর থেকে কোত্থাও যাবে না। তাহলে পাজি শেয়াল আমার ডিমগুলো খেয়ে নেবে।

মাছরাঙার কথা শুনেই শেয়ালের জিবে জল আসে। মনে মনে বলে- আহ! কতদিন পাখির ডিম খাই না। যেভাবেই হোক, টুনটুনিকে আজ ঘর থেকে বের করতেই হবে।
কাঠঠোকরা ও মাছরাঙা বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। তাদের যাওয়ার কিছুক্ষণ পর, দুষ্ট শেয়ালও ঝোপ থেকে বেরিয়ে আসে। তারপর হিজল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে ছড়া কাটে-

নদীর ধারে দেখে এলাম
সোনা রাঙা ধান
শালিক টিয়ে ধান ভানছে
ফিঙেরা খায় পান।

ধানের কথা শুনতেই টুনটুনি বাসা থেকে বেরিয়ে আসে। শেয়াল তখন বললো- ভয় পেয়ো না ভাইটি। কাল যা হয়েছে, তার জন্যে স্যরি।
বোকা টুনটুনি শেয়ালকে জিজ্ঞেস করে- শেয়াল ভাই, তখন কী যেন বলছিলে?
দুষ্ট শেয়াল পুনরায় ছড়া কাটে-

নদীর ধারে দেখে এলাম
সোনা রাঙা ধান
শালিক টিয়ে ধান ভানছে
ফিঙেরা খায় পান।

ছড়া শেষ হতেই টুনটুনি নদীর দিকে ছুটলো। তার এই বোকামি দেখে শেয়াল ইচ্ছেমতো হাসলো। আর বললো, বোকার হদ্দ। মাথায় এক চিমটি বুদ্ধিও নেই।
এই বলে সে মাছরাঙাদের ঘরে ঢোকে। এদিক তাকায়, ওদিক তাকায়। কিন্তু কোথাও কলস দেখতে পায় না। তারপর রান্নাঘরে প্রবেশ করে। রান্নাঘরে প্রবেশ করতেই কলসটা দেখতে পেলো। তখন শেয়ালের চোখ এত্ত বড় হয়ে যায়। মনে মনে বলে- বোকা টুনটুনি; কলসটা ঢেকেও যায়নি!
তারপর এদিক-ওদিক তাকিয়ে যখন দেখলো, কেউ নেই। অমনি কলসে মুখ ঢুকিয়ে দেয়। আর তখনই সে চিৎকার করে উঠলো- মুখ পুড়ে গেলো রে! মুখ পুড়ে গেলো!

ঘরের বাইরে তখন মাছরাঙা, কাঠঠোকরা, টুনটুনিসহ বনের সব পশু-পাখি হাততালি দিয়ে ওঠলো। দেবে না কেন? দুষ্ট শেয়ালটা তাদের কম ‌জ্বালিয়েছে?

শেয়াল বুঝতে পারলো- তাকে শায়েস্তা করার জন্যই কলসিতে গরম পানি রাখা হয়েছিল। টগবগে গরম পানিতে শেয়ালের মুখ এমনভাবেই পুড়েছে, ওই পোড়া মুখ আর কোনো দিন ভালো হয়নি। কথায় আছে না- লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। পাজি শেয়ালের সেই দশাই হলো। ০