তোমরা কি বলতে পারো বৃক্ষের পরিচয় কীসে? বৃক্ষের পরিচয় হলো তার ফলে। আর একজন কবির পরিচয়? একজন কবির পরিচয় তার কবিতায়। তার ভাবে, বিষয়ের বিন্যাসে। কবি নজরুল ইসলামের পরিচয়ও তাঁর কবিতায়, তাঁর নাতিদীর্ঘ জীবনের সুদীর্ঘ ছন্দময় সংলাপে। তিনি নিজেই তাঁর কবিতার ভেতর নিজের পরিচয় তুলে ধরেছিলেন। মুখের হাসি আর বুকের ভালোবাসাকে মনের রঙে রাঙিয়ে জীবনের আকাশে রঙধনুর মতো এলিয়ে দেয়ার প্রয়াসী তিনি।
তিনি নতুন কবিতার প্রচলিত রীতি-নীতি, পুরনো ছন্দ ভেঙে নিজস্ব নিয়মে গড়ে তুলেছিলেন কবিতার নতুন ইমারত। আর কবিতার চমক বড়দের ক্ষেত্রে যেমন সত্য, ছোটদের ক্ষেত্রেও তাই।
নজরুল ইসলাম কোথাকার ছেলে, জানো? নজরুল ইসলাম চুরুলিয়া (ভারত) গ্রামের কাজী পরিবারের ছেলে। কাজীরা মুসলিম সমাজে মানভাজন লোক ছিলেন। তাঁদের পূর্বপুরুষরা বাদশাহী আমলে বিচারকের কাজ করতেন। ফলে তাদের গৌরববোধও বড় বেশি। চুরুলিয়া জামুরিয়ার অধীন একটি গ্রাম। চুরুলিয়ার কাজীরা বাদশাহী আমলে পাওয়া আয়মা সম্পত্তির মালিক ছিলেন। আমরা যাকে লাখেরাজ সম্পত্তি বলে থাকি (অর্থাৎ নিষ্কর)। কিন্তু নজরুলের পিতা কাজী ফকির আহমেদ নিঃস্ব অবস্থায় মারা যান। ফলে নজরুলের ভাগ্য নিজেকেই গড়ে তুলতে হয়েছে। অশেষ দুঃখ-কষ্টে কেটেছে তার বাল্যজীবন। সে সময়ে তার মতো একটি ছেলের, তাও আবার কাজী পরিবারের ছেলের, মনোযোগ সহকারে স্কুলে পড়াশোনা করার কথা ছিলো। কিন্তু দারিদ্রের বিড়ম্বনা তাকে এখান থেকে ওখানে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে। তৎকালীন দিনে একটা কথা প্রচলিত ছিলো, কাজী বাড়ির বিড়ালও তিন পাঠ পড়ে নেয়। আর কাজী বাড়ির ছেলে নজরুল স্কুলে পাঠ্যাভ্যাস করার পরিবর্তে লেটোর দলের গান বেঁধেছে, রেলওয়ের গার্ড সাহেবের বাসায় চাকরি করেছে। আর চাকরি করেছে আসানশোলের রুটির দোকানে। কিন্তু যদিও কথাগুলি নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। কোনটা ছোট কাজ, কোনটা বড় কাজ তাতে তার এতটুকুও আটকায়নি।
সবকিছু শুনে তোমাদের কী ধারণা হয়? ধারণায় আসে, সেই সময়ের চুরুলিয়ায় কাজী পরিবারের মধ্যে কিংবা নজরুলের অন্য আত্মীয় স্বজনরা যাদের স্বচ্ছল অবস্থা ছিলো, তারা নজরুলের খোঁজখবর নিতেন না। তাই বলে বুঝি তিনি লেখাপড়া শেখেননি! না, এটা মোটেও ঠিক নয়।
তোমরা নজরুলের জীবনকে জানতে চেষ্টা করলে বুঝতে কষ্ট হবে না যে তিনি পড়াশুনা করতে চাইতেন এবং পড়াশুনা করেছেন। তিনি ছোটাছুটি করেছেন। আবার এও আমরা দেখতে পাচ্ছি স্কুলের ভালো ছাত্র হওয়া সত্তে¡ও মেট্রিক পরীক্ষা পাশ করার চেয়ে সে দেশপ্রেমকেই উচ্চাসনে দিয়েছিলেন। বেঙ্গল ডবল কোম্পানিতে যোগ দেয়ার সে ডাক তার কানে পৌঁছেছিলো যে সে ডাককে দেশপ্রেমের ডাক ধরে নিয়েই তিনি তাতে সাড়া দিয়েছিলেন।
নজরুল ইসলাম কয়টি স্কুলে পড়াশুনা করেছিলেন জানো? আমরা তার তিনটি স্কুলে পড়ার কথায় জানি। ময়মনসিংহ জেলার দরিরামপুর হাইস্কুল, বর্ধমান জেলার মাথরুল হাইস্কুল এবং রানীগঞ্জের শিয়ারশোল বাজ হাইস্কুল। তিনি কিন্তু বড্ড ডানপিটে ছিলেন। কারুর শাসন মানতেন না। কাউকে ভয়ও করতেন না। ফলে সবাই কী বলতো জানো ? সবাই বলতো, বাউণ্ডুলে। একরোখা হলে কী হবে? তার হৃদয়ে সাহসের তুফান ছুটতো। সে কি বলতো জানো?
‘থাকবো নাকো বদ্ধ ঘরে
দেখবো এবার জগৎটাকে
কেমন করে ঘুরছে মানুষ
যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে।’
সবাই যখন ঘুমিয়ে যায় তখন তিনি জেগে থাকতেন। বিছানায় তখন তিনি চুপ চুপি আকাশের সাথে কথা বলতেন। তারাদের সাথে, চাঁদের সাথে কত কথায় না বলতেন এই কবি। ফুলপরিদের সাথে ভাব জমাতেন। তার তখন কী ইচ্ছা হতো-
‘আমি হবো সকাল বেলার পাখি
সবার আগে কুসুম বাগে
উঠবো আমি ডাকি।
সূর্যিমামা জাগার আগে
উঠবো আমি জেগে
হয়নি সকাল ঘুমো এখন
মা বলবেন রেগে।’
মাকে তিনি কী বলতেন জানো?
‘হয়নি সকাল তাই বলে কি
সকাল হবে নাকো?
আমরা যদি না জাগি মা
কেমনে সকাল হবে
তোমার ছেলে উঠলে গো মা
রাত পোহাবে তবে।’
বাহ! কী সুন্দর কথা দেখেছো?
কবির ছেলেবেলা কেটেছে অনেক দুঃখ-কষ্টে। পেট ভরে খেতে পাননি। ভাােল জামাকাপড় পরতে পারেননি। তোমাদের তো সে কথা আগেই বলেছি। যে বয়সে ছেলেরা খেলাধূলা আর পড়াশুনা করে সময় কাটায়, সেই বয়সে তাঁকে আয়-রোজগার করতে হয়েছে। অন্যের দোকানে কাজ করতে হয়েছে। ফলে স্কুলের ধরাবাঁধা লেখাপড়া তিনি বেশি করতে পারেননি। তাই বলে তিনি কমও করেননি। অনেক অনেক বই পড়েছেন তিনি। অনেক ভাষাজ্ঞানও ছিলো তার। অনেক ভাষাই রপ্ত করেছিলেন তিনি। পড়লেই বুঝা যায় তিনি কত ভাষার শব্দ ব্যবহার করেছেন তার কবিতায়। আর তার কবি প্রতিভা? সে তো সমুদ্রের মতো বিশাল। তিনি যতদিন সুস্থ ছিলেন, ততোদিন লিখেছেন। প্রচুর লিখেছেন। কবিতা তো ছিলোই। আরও ছিলো গান, গজল, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ ইত্যাদি। তাই বলে তোমরা যারা ছোট তাদের কথাও ভুলেননি, ভুলবেন কেমন করে? তিনি তো অনেক বড় কবি। অনেক বড় ছিলো তাঁর হৃদয়। সে হৃদয়ে ছিল ভালোবাসার সমুদ্র। তিনি ভালোবাসতেন দেশ, প্রকৃতি ও নিজ ধর্ম ইসলামকে। ছোটরা ছিলো তার বড় আপন। আপন বলেই তোমাদের জন্য তিনি লিখেছেন প্রচুর গান, কবিতা, নাটক। কবির লিচু চোর, খুকু ও কাঠবিড়ালী, ঝিঙেফুল- এ ধরনের মাত্র কয়েকটি ছড়ার সাথে পরিচিত থাকলেও তার সাগরের মতো ভাণ্ডারের সাথে আমরা মোটেও পরিচিত নই। কারণ তার শিশু যাদুকর, সংলাপ, সওদাগর- এর মতো মজার কবিতাগুলো আজকাল আর পাঠ করা হয় না। তার লেখা ছোটদের বইগুলো এখন বাজারে পাওয়া যায় না। ফলে আমরা তার বইয়ের সাথে পরিচিত নয়। তিনি তোমাদের মতো ছোট বন্ধুদের জন্যে তেরোখানা বই লিখেছিলেন। ঝিঙেফুল, সঞ্চয়ন, পুতুলের বিয়ে, ঘুম জাগানো পাখি, সাত ভাই চম্পা, ঘুমপাড়ানী মাসি পিসী, ফুলে ও ফসলে, ভোরের পাখি, তরুণের অভিযান, মুকুট মাইতি, জাগো সুন্দর, চির কিশোর ইত্যাদি।
পুতুলের বিয়ে নামক একখানা নাটিকা তিনি লিখেছিলেন। প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৩৩ সালে। যেন বসন্তের বাতাস হৃদয়ে ঢেউ খেলে যায়। আবার কখনো বা সাহস ও দিগবিজয়ের ঘোড়া টগবগিয়ে ছুটে যায়। আর তার ছন্দ ও শব্দের দোলা তো কখনোই ভুলবার নয়। যেন যাদুর বাঁশী। নিচের ঝিঙেফুল কবিতাটির ছন্দের দোলার কথাই ধরা যাক না! তার তুলনা হয় না।
‘ঝিঙে ফুল। ঝিঙে ফুল!
সবুজ পাতার দেশে
ফিরোজিয়া ফিঙেকুল
ঝিঙে ফুল।’
কবি নজরুল ইসলাম অনেক বিশাল কবি। এতো বড় কবি- যিনি সবকিছুকে প্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছিলেন। তার মাত্র হাতেগোনা কয়েকটি কবিতা পড়ে কি তৃপ্তি পাওয়া যায় ?
আহ! কতই না ভালো হতো, যদি কবির সব ছোটদের বই আবার বাজারে পাওয়া যেতো।
এই দরদি ও প্রেমিক কবি দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর ইন্তেকাল করেন ১৯৭৬ সালে, ঢাকার পিজি হাসপাতালে। তোমরা কী বলো, তিনি মরে গেছেন? না কবিরা কখনো মরে না। এইতো তিনি বেঁচে আছেন। জেগে আছেন আমাদের মধ্যে। মানুষের হৃদয়ে, তার কবিতার ছন্দে ছন্দে ইথারে ইথারে ভেসে বেড়ায় কবির গান-
‘মসজিদেরই পাশে আমার
কবর দিও ভাই
যেন গোরে থেকেও মোয়াজ্জিনের
আজান শুনতে পাই।’