তোমরা নিশ্চয়ই জানো, গেমিং-এর জন্য বর্তমানে অন্যতম সেরা কনসোল হলো প্লে স্টেশন। প্লে স্টেশন বাজারে আসে ১৯৯৪ সালে। তখন বাজারে গেমিং কনসোল হিসেবে জনপ্রিয় ছিল নিনটেন্ডো এবং সেগা স্যাটার্ন। নিনটেন্ডো কোম্পানির সাথে প্রতিযোগিতা করে বাজারে গেমিং কনসোল আনে টেকনোলজির ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠান- সনি কর্পোরেশন। সনির প্রতিষ্ঠাতা আকিও মরিটা জন্মগ্রহণ করেন ১৯২১ সালে জাপানের নাগোয়া শহরে। শৈশব থেকেই টেকনোলজির প্রতি প্রবল আগ্রহ তাকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ পড়তে উদ্বুদ্ধ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৬ সালে তিনি বন্ধু মাশারু ইবুকাকে সাথে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ToKzo Tsushin Kogyo K.K নামের একটি ইলেক্ট্রনিক্স কোম্পানি। পরবর্তীতে এই কোম্পানি পরিচিতি পায় সনি কর্পোরেশন নামে। প্রযুক্তি বাজারে সনি নতুন দিগন্ত নিয়ে আসে ট্রানজিস্টর, ওয়াকম্যান, ক্যামেরা, টিভিসহ নানান আইটেম সরবরাহের মাধ্যমে। আকিও মরিটা ১৯৯৯ সালে মারা যান। কিন্তু তার হাতে গড়া সনি এখনো ক্রেতাদের পছন্দ অনুযায়ী ইলেকট্রনিক সামগ্রী সরবরাহ করে যাচ্ছে। সনি সফল হয়েছে আকিও মরিটার দুর্দমনীয় আগ্রহের ফলে। তাঁর জীবনের উদ্দেশ্যই ছিল উদ্ভাবনী প্রযুক্তির মাধ্যমে মানুষকে সেবাদান করা। এই যে জীবনে উদ্দেশ্য ধারণ করার ব্যপারটি- এটিকে জাপানিজ ভাষায় বলে ইকিগাই।
ইকিগাই ধারণাটি বেশি পরিচিতি পায় ২০১৬ সালে প্রকাশিত `Ikigai: The Japanese Secret to a Long and Happy Life’ বইয়ের মাধ্যমে। এই বইয়ের লেখক হেক্টর গার্সিয়া এবং ফ্রান্সেস্ক মিরালেস ইকিগাইয়ের দার্শনিক দিক এবং এর ব্যবহারিক প্রয়োগ নিয়ে আলোচনা করেছেন। তাঁরা এ বইয়ে জাপানী দ্বীপ ওকিনাওয়া’র বাসিন্দাদের দীর্ঘজীবনের রহস্য উদঘাটন করেছেন। তারা সেখানকার ১০০ জন বয়ষ্ক মানুষের সাক্ষাৎকার নেন। তাদের সবারই আনন্দময় জীবনের পেছনে ছিল কয়েকটি মূল সূত্র। প্রথমত তারা বেঁচে থাকাকে অনর্থক মনে করতেন না। তাদের প্রত্যেকের বেঁচে থাকার একটি অর্থ ছিল বা কারণ ছিল। কারো কাছে বন্ধুত্বই জীবনে বেঁচে থাকার কারণ। কেউ ভাবতেন তিনি বাগান করা, গাছ লাগানোর জন্যই বেঁচে আছেন। কেউ মনে করতেন শিল্পকর্ম করাই তাঁর জীবনকে অর্থবহ করে তুলেছে। এছাড়া তারা কাজের মধ্যে ব্যস্ত থাকতেন, স্বাস্থ্যকর ও পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার খেতেন এবং সামাজিকভাবে একত্রে কাজকর্ম করা, আনন্দ বিনোদন করতে পছন্দ করতেন। হেক্টর গার্সিয়ার মতে এগুলোই তাদের করেছে দীর্ঘজীবনের অধিকারী।
আসলেই কি ইকিগাইয়ের কোনো প্রয়োজন আছে? অথবা তোমার কি কোনো ইকিগাই অলরেডি আছে, যা তুমি ভেবেও দেখোনি? সহজভাবে বলতে গেলে আগামীকাল সকালে তুমি ঘুম থেকে উঠতে চাও অন্তত যে একটা কাজ করার জন্য সেটি হচ্ছে ইকিগাই। হতে পারে তুমি আগামীকাল শুধু তোমার দাদুর সাথে সময় কাটাতে চাও, কিংবা বন্ধুর সাথে; এটিই তোমার ইকিগাই। অথবা হতে পারে তুমি তোমার পোষা পাখি, বিড়াল কিংবা কুকুরের সাথে সময় কাটাতে চাও, সেটিই তোমার ইকিগাই। অথবা তুমি শুধু গেম খেলতে চাও, কম্পিউটারে কোডিং করতে চাও, বই পড়তে চাও; এগুলোই ইকিগাই। হতে পারে সাইক্লিং হচ্ছে তোমার ইকিগাই। কারণ এটি তোমাকে আনন্দ দেয়, প্রাণ সঞ্চার করে।
ইকিগাই নির্ধারণে ৪ টি মূল প্রশ্ন করতে হয় নিজেকে।
১. তুমি কোন কাজটি করতে পছন্দ করো?
২. তুমি কোন কাজটি ভালো পারো?
৩. তুমি কোন কাজ করে অর্থ উপার্জন করতে চাও?
৪. পৃথিবীর জন্য কোন কাজটি করা দরকার?
তুমি কোন কাজটি করতে পছন্দ করো এবং কোন কাজটি ভালো পারো এই দুটি প্রশ্নের উত্তর যদি একটি হয় সেটি হতে পারে তোমার জন্য প্যাশন (Passion)। যেমন ধরো তুমি গণিত করতে পছন্দ করো এবং এটি তুমি বেশ ভালো পারো, তাহলে এটি তোমার প্যাশন বা অনুরাগের জায়গা।
তুমি যে কাজটি ভালো পারো এবং যে কাজটি করে অর্থ উপার্জন করতে চাও -দুটো যদি একই কাজ হয় তাহলে সেটি হলো তোমার পেশা বা Profession. যদি তুমি গণিত ভালো পারো এবং গণিত পড়িয়ে তুমি অর্থ উপার্জন করতে চাও তাহলে এটি তোমার জন্য পেশা হিসেবে নিতে পারো।
তুমি যে কাজটি করে অর্থ উপার্জন করতে চাও, যদি পৃথিবীর জন্য সে কাজটি দরকারি হয়ে থাকে তাহলে সেটি তোমার জন্য ভকেশন (Vocation)। অর্থাৎ যদি তুমি পেশা হিসেবে গণিতকে নিয়ে থাকো, আর গণিত শেখানো কাজটা অবশ্যই দরকারি এবং উপকারী কাজ ভেবে নিয়ে তুমি কিছু ছাত্রছাত্রীকে বিনে পয়সায় গণিত শেখালে কিংবা গণিতের উচ্চতর গবেষণায় নিজের সময় ব্যয় করলে, তাহলে এটি তোমার জন্য ভকেশন।
আর পৃথিবীর জন্য দরকারি এবং সে কাজটিকে যদি তুমি পছন্দ করো, তাহলে সেটি তোমার জন্য মিশন। যেমন গণিতকে তুমি ভকেশন হিসেবে মানুষের উপকারে কাজে লাগানোর কাজটাকে নিজের অনুরাগের জায়গা হিসেবেও নিয়েছ, তখন এটি জীবনের মিশন (Mission) বা মহৎ উদ্দেশ্য।
প্যাশন, প্রফেশন, ভকেশন এবং মিশনের সমন্বয়েই তৈরি হয় ইকিগাই। তবে একই কাজ যে চারটি ক্রাইটেরিয়ায় উত্তীর্ণ হবে, সেটি নাও হতে পারে। হতে পারে তোমার প্যাশন এবং ভকেশন এক, কিন্তু প্রফেশন আলাদা। কারণ একজনের ভালোলাগার বিষয় বা কাজ অনেক হতে পারে। পারদর্শিতার জায়গাও কয়েকটি হতে পারে।
ইলন মাস্ক কিছুদিন আগেই রকেট বুস্টার পৃথিবীতে ফিরিয়ে এনে সাড়া ফেলে দিয়েছেন। মঙ্গলে জনবসতি গড়ার ঘোষণা দিয়ে তো আলোচনায় আছেন বহুদিন ধরেই। ইলন মাস্ক কিন্তু ছোটবেলা থেকেই মহাশূন্য নিয়ে আগ্রহী ছিলেন। ১৯৮৪ সালে মাত্র ১২ বছর বয়সে ইলন মাস্ক একটি কম্পিউটার গেম তৈরি করেন, সেটি বিক্রি করে সেই বয়সেই ৫০০ ডলার উপার্জন করেছিলেন তিনি। ব্লাস্ট নামের গেমটি ছিল মহাকাশ নিয়েই, যেখানে বাইরের গ্রহের আক্রমণকারীরা আসে, তাদের প্রতিরোধ করতে হয় গেমারকে। ইলন মাস্কের শৈশবের সেই প্যাশনকে তিনি প্রফেশন, ভকেশন এবং মিশনের জায়গায় নিয়ে গেছেন।
কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার কামরুল ইসলাম পেশায় এবং নেশায় একজন চিকিৎসক। ডাক্তারি তার অর্থ উপার্জনের মাধ্যম বা প্রফেশন। কিন্তু তিনি এটিকে ভকেশন হিসেবে নিয়েছেন। মানুষের উপকারে তিনি বিনা পয়সায় কিডনি প্রতিস্থাপনের কাজ শুরু করেন। দেড় হাজারের বেশি মানুষের কিডনি প্রতিস্থাপনের কাজ তিনি বিনামূল্যে করেছেন। দেশের মানুষকে কিডনির রোগ থেকে মুক্ত করার জন্য তিনি কাজ করে যাচ্ছেন। এটি তার জীবনের মিশন। তিনি এ কাজকে ইবাদাত হিসেবে নিয়েছেন, আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার মাধ্যম হিসেবে নিয়েছেন।
সুতরাং নিজেকে প্রশ্নগুলো করো- কোন কাজ ভালোবাসো? কোন কাজ ভালো পারো? কোন কাজটার মাধ্যমে টাকা কামাতে চাও এবং পৃথিবীর জন্য কোন কাজটা দরকারি? যদি প্রশ্নগুলোর উত্তর বের করে কাজ করতে পারো, দেখবে কাজটা আরো বেশি মনোযোগ দিয়ে করতে পারছো, কাজে আরো বেশি সফলতা আসছে। ০