ভ্রমণ পিপাসু ইবনে বতুতা

আবু সালেহ মুনির আহমদ

0
99

ইবনে বতুতা ছিলেন একজন মুসলিম চিন্তাবিদ, সুবিচারক এবং পর্যটক। তাঁর পূর্ণ নাম ‘আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে বতুতা’। তিনি ১৩০৪ খ্রিষ্টাব্দে (৭০৩ হিজরি) মরক্কোর তাঞ্জিয়ারে জন্মগ্রহণ করেন। ‘ইবনে বতুতা’ মধ্যযুগীয় মুসলিম ভ্রমণকারীদের মধ্যে অন্যতম। তিনি প্রাক-আধুনিক ইতিহাসে অন্য যেকোনো অভিযাত্রীর চেয়ে বেশি দেশ ও পথ ভ্রমণ করেছেন। তিনি প্রায় এক লক্ষ বিশ হাজার কি.মি. পথ ভ্রমণ করেছিলেন। তাঁর লেখা ভ্রমণ কাহিনির বই ‘রিহলাহ’ অন্যতম।

ইবনে বতুতা যে পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছেন তাঁরা ছিলেন সে যুগের বিচারক। তিনি তাঁর জন্ম শহর তাঞ্জিয়ারে ঐতিহ্যগত আইন ও সাহিত্য শিক্ষালাভ করেন। তিনি ১৩২৫ সালে ২১ বছর বয়সে মক্কায় হজ্জ পালন করেন। হজ্জ করার মাধ্যমেই তাঁর ভ্রমণ শুরু হয়। প্রথমে তাঁর উদ্দেশ্য ছিল ধর্মীয় দায়িত্ব পালন করা। তিনি মিসর, সিরিয়া ও হেজাজের বিখ্যাত পণ্ডিতদের অধীনে অধ্যয়ন করে তাঁর শিক্ষার প্রসার ঘটান। তিনি যে শিক্ষাগ্রহণ করে পাণ্ডিত্য অর্জন করেছেন সে যুগের সুফি সাধকদের দ্বারা তা প্রমাণিত হয়েছিল। এই অধ্যয়নগুলো তাকে বিচার বিভাগীয় পদে দায়িত্বের জন্য যোগ্য করে তুলেছে। এছাড়া ঐতিহ্যগত ইসলামিক বিজ্ঞানের অসামান্য ছাত্র হওয়ায় দায়িত্বভার গ্রহণ করার সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে তোলে। তাই অনেক আদালত সম্মানিত অতিথি হিসেবে তাঁকে গ্রহণ করেছিলেন।

ইবনে বতুতা ছিলেন ভ্রমণ পিপাসু। ভ্রমণের জন্য একটি অপ্রতিরোধ্য আবেগ তার আত্মায় জন্ম নিয়েছিল। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যতটা সম্ভব বিশ্বের অনেক জায়গায় পরিদর্শন করবেন। তাঁর সমসাময়িকরা বাণিজ্য বা তীর্থযাত্রার জন্যই ভ্রমণ করেছিলেন। ইবনে বতুতা নতুন দেশ, নতুন মানুষ, সংস্কৃতি, রাষ্ট্র কাঠামো ইত্যাদি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন সর্বপরি আনন্দ উপভোগের জন্য বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছেন। তাঁর ভ্রমণের মাধ্যমেই তিনি জীবিকা নির্বাহের পথ খুঁজে পেয়েছিলেন। তিনি তাঁর পাণ্ডিত্য এবং ভ্রমণকারী হিসেবে তাঁর ক্রমবর্ধমান খ্যাতি থেকেই উপকৃত হয়েছেন। তিনি যেসব দেশ ভ্রমণ করেছিলেন সেখানে অসংখ্য সুলতান, শাসক, গভর্নর এবং উচ্চ মর্যাদাবান ব্যক্তিদের উদারতা এবং অনুগ্রহ উপভোগ করেছিলেন। এভাবেই তিনি তাঁর আয় নিশ্চিত করে ভ্রমণ চালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন।
ভ্রমণের প্রথম দিকে ইবনে বতুতা স্থলপথে তিউনিসিয়া হয়ে মিসরের কায়রোতে পৌঁছান। সেখান থেকে তিনি সিরিয়া সফর করেন। সিরিয়া থেকে মক্কার উদ্দেশ্যে একটি কাফেলায় যোগ দেন। ১৩২৬ সালে তিনি তীর্থযাত্রা শেষ করেন। সেখান থেকে তিনি আবার মরুভূমি অতিক্রম করে ইরাক, দক্ষিণ ইরান, আজারবাইজান এবং বাগদাদে যান। সেখানে তিনি ইরানের শেষ প্রান্ত মঙ্গোলখান যান। তারপর মক্কায় ফিরে আসেন। ইবনে বতুতা ১৩২৭ থেকে ১৩৩০ সালের মধ্যে মক্কা ও মদিনার একজন ভক্তের ন্যায় শান্তিতে জীবনযাপন করেছেন। কিন্তু এত দীর্ঘ অবস্থান এই ভ্রমণ পিপাসুর মেজাজের সাথে খাপ খায়নি। তাই তিনি জিদ্দা থেকে তাঁর অনুরাগীদের একটি দল নিয়ে নৌকায় চড়ে লোহিত সাগরের তীরে যান। লোহিত সাগরের তীর দিয়ে স্থলপথে তিনি ইয়েমেনের দিকে যাত্রা করেন। ১৩৩২ সালে তিনি দক্ষিণ আরব, ওমান, হরমুজ, দক্ষিণ পারস্য এবং পারস্য উপসাগর পেরিয়ে পুনরায় মক্কায় ফিরে আসেন। এসময় তাঁর মনে এক পরিকল্পনা পরিপক্ক হয়। মুসলিম পণ্ডিতদের প্রতি তার অসাধারণ উদারতায় তাদের দরবারে তাঁর ভাগ্য পরীক্ষার সিদ্বান্ত নেন। তাই তিনি আবারও মিসর এবং সিরিয়া অতিক্রম করে আনাতোলিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। তখন আনাতোলিয়ায় অসংখ্য ক্ষুদ্র সুলতানিতে বিভক্ত ছিল। তাই তিনি অনেক কষ্টে তুর্কিদের দেশ আনাতোলিয়ায় পৌঁছান। সেখানে ইবনে বতুতাকে সকল স্থানীয় শাসক এবং ধর্মীয় ভ্রাতৃত্বের প্রধানগণ আন্তরিকভাবে ও উদারমনে গ্রহণ করেছিলেন। এখানে কয়েক বছর অবস্থান করেন। এরপর তিনি তাঁর কাফেলা নিয়ে মধ্য এশিয়া ভ্রমণ করেন। তিনি বুখারা ও সমরকন্দসহ প্রাচীন শহর পরিদর্শন করেন। তিনি খোরাসান ও আফগানিস্তানের মধ্যে দিয়ে জটিল রাস্তা হিন্দুকুশ পর্বতমালা অতিক্রম করেন। অতঃপর ১৩৩৬ খ্রিষ্টাব্দে সেপ্টেম্বর মাসে তিনি সিন্ধু নদীর তীর দিয়ে ভারতে পৌঁছান। ইতোমধ্যেই ইবনে বতুতা একজন গুরুত্বপূর্ণ ও খ্যাতিমান ব্যক্তি হিসেবে বিভিন্ন দেশে পরিচিতি লাভ করেছেন। তাঁর অনুসারীদের একটি বিশাল অংশসহ তিনি ভারতে অবস্থান করেন। শাসক ‘মুহাম্মদ ইবনে তুঘলক’ ইবনে বতুতার সম্পদ এবং উদারতার প্রত্যাশায় তাঁকে সম্মান ও উপহার দিয়ে গ্রহণ করেছিলেন। তিনি তাঁকে গ্রান্ড কাদি নিযুক্ত করেন। ইবনে বতুতা দিল্লির কাদি বা বিচারক হিসেবে কয়েক বছর অধিষ্ঠিত ছিলেন। যদিও তিনি সেখানে দৃশ্যত একটি সহজ জীবনযাপন করেছিলেন তবুও শীঘ্রই স্পষ্ট হয়ে যায় যে তাঁর নতুন অবস্থান বিপদমুক্ত ছিল না। উদারতা ও নিষ্ঠুরতার এক অসাধারণ মিশ্রণ ভারতের বৃহত্তর অংশের উপর লোহার হাতের আধিপত্য বিস্তার করেছিল। যেখানে নির্বিচারে উঁচু-নিচু, মুসলিম, হিন্দু সবার উপরই এই আধিপত্যের প্রভাব পড়েছিল। ইবনে বতুতা সুলতান এবং তাঁর শাসনের সমস্ত বিপত্তি প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তিনি তাঁর জীবনের জন্য ভয় পেয়েছিলেন। কারণ তিনি তাঁর অনেক বন্ধুকে স্বৈরশাসকের শিকার হতে দেখেছেন। তাঁর সতর্কতা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত তিনিও অপমানিত হয়েছেন। পরিশেষে সৌভাগ্যই তার জীবন রক্ষা করেছে। তিনি কোনো অনুশোচনা ছাড়াই দিল্লি ত্যাগ করেছিলেন।
তার যাত্রা ছিল বিপদে পরিপূর্ণ। দিল্লির কাছাকাছি তিনি হিন্দু বিদ্রোহীদের দ্বারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। ভ্রমণকারীদের মধ্যে খুব কমই জীবন নিয়ে ফিরে যেতে সক্ষম হয়েছিল। তিনি দিল্লি ত্যাগ করার পূর্বে চীনা সম্রাটের দূত হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। চীন ভ্রমণের পথে দক্ষিণ-পশ্চিম ভারতের মালাবার উপকূলে তিনি স্থানীয় যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। সেখানে তাঁর জাহাজও ভেঙে ফেলা হয়েছিল। তাঁর সকল সম্পত্তি এবং চীনা সম্রাটের জন্য নেয়া উপহারও হারিয়ে ফেলেন। পরিস্থিতি খুব বিপজ্জনক দেখে তিনি শ্রীলংকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। সেখান থেকে তিনি মালদ্বীপে যান। তারপর আসাম, সেখানে তিনি চীনে তাঁর মিশন পুনরায় শুরু করার সিদ্ধান্ত নেন। অতঃপর সুমাত্রার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। সেখানে ইন্দোনেশিয়ার মুসলিম সুলতান তাকে একটি জাহাজ উপহার দেন। তিনি সেই জাহাজেই চীনের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। তারপর অভ্যন্তরীণ জলপথে তিনি বেইজিং পৌঁছান। কয়েকবছর সততার সাথে দায়িত্ব পালন করে চীনে অবস্থান করেন। অতঃপর স্বেচ্ছায় ১৩৪৮ সালে বাগদাদ হয়ে সিরিয়ায় চলে যান। সেখান থেকে আবার মিসরে, একই বছরে পুনরায় মক্কায় ফিরে আসেন। মক্কা থেকে তিনি নিজ দেশে ফিরে আসার সিদ্বান্ত নেন। এরপর ১৩৫২ সালে তিনি পশ্চিম সুদানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। সেখান থেকে সাহারা অতিক্রম করে মালির সম্রাজ্যে যান। অতঃপর ১৩৫৩ সালে ইবনে বতুতা জন্মভূমি মরক্কো ফিরে আসেন। মরক্কোর সুলতানের অনুরোধে একজন লেখক ‘ইবনে জুজাই’-এর কাছে তাঁর ভ্রমণের স্মৃতিচারণ করেন। যিনি ইবনে বতুতার সরল গদ্যকে একটি শৈলী এবং কবিতার টুকরো দিয়ে অলংকৃত করেছিলেন। এর কয়েক বছর পর তিনি দৃষ্টির আড়ালে চলে যান। ধারণা করা হয়েছিল ১৩৬৮ সালে এই ভ্রমণপিপাসু পণ্ডিত মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে তার জন্মস্থান তাঞ্জিয়ারে সমাহিত করা হয়েছিল।

বন্ধুরা, ইবনে বতুতার ভ্রমণ কাহিনি পড়ে তোমাদের মনেও নিশ্চয় ভ্রমণের আগ্রহ উদয় হয়েছে। নিশ্চয় তোমরাও বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করে আনন্দ উপভোগ করার সাথে সাথে নানা দেশ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করবে। তবে ভীনদেশ ভ্রমণের পূর্বে গৌরবোজ্জ্বল নানান সংস্কৃতির এই দেশ, সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা, ফুল, পাখি, পাহাড়-পর্বত, ঝরনা ও বিশাল বনভূমিতে ঘেরা, হাওড়-বাওড়, লেক, নদী, সাগর ও বিশাল সমুদ্রসৈকতের এই সোনার বাংলাদেশ ভ্রমণ করবে। নিজ দেশ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি নিজ জন্মভূমির সৌন্দর্য উপভোগ করবে।
দেখবে, কত সুন্দর আমাদের এই বাংলাদেশ। ০