হোসনা বানুর অ্যাডভেঞ্চার । পর্ব-৪

আহমাদ স্বাধীন

0
9

হিমশীতল বরফের পাহাড় হিমালয় পর্বত। যেখানে গেলে কনকনে ঠান্ডায় আইসক্রিম এর মতো জমে যায় শরীর। হিমালয় পর্বত ডিঙিয়ে তিনশো ক্রোশ দূরে আছে একটা জঙ্গল। ওটাকে বলে ডাইনোসর এর জঙ্গল। জঙ্গলটা ঘন কুয়াশায় ঢাকা। সেই জঙ্গলে এতোই অন্ধকার যে দিনের বেলাতেও কিছু দেখা যায় না। জঙ্গলের ভেতরে আছে নানা রকম হিংস্র জন্তু জানোয়ার। সব থেকে বেশি ভয় হলো ডাইনোসরের ভয়। সেই জঙ্গলে আছে আগুনমুখো ডাইনোসর।

কোনো মানুষের দেখা পেলেই আগুন দিয়ে ঝলসে খেয়ে ফেলে সেই আগুনমুখো ডাইনোসর। ডাইনোসর এর জঙ্গলের ওপাশেই আছে রক্ত নদী। নদী ভরা অসংখ্য দানবের মতো বড়ো বড়ো কুমির। নদীর রং রক্তের মতো টকটকে লাল। সেই নদী পার হতে গেলেই দানব কুমির ছিড়েখুঁড়ে খেয়ে ফেলে। হাড়-মাংস সব খেয়ে ফেলে কুমিরের দল। ক্ষুধার্ত কুমিরগুলোর একজন মানুষ খেয়ে ফেলতে সময় লাগে মাত্র দুই মিনিট। রক্ত নদীর ওপারে গেলেই দেখা যাবে সাপের গুহা। সাপের গুহায় গিজগিজ করছে অসংখ্য বিষাক্ত সাপ। লাল সাপ, নীল সাপ, হলুদ সাপ, কালো সাপ। নানা রঙের কতশত প্রজাতির বিষধর সাপ যে সেখানে আছে তার হিসেব নেই। সাপের গুহার ওই প্রান্তে যেতে পারলেই দেখা যাবে জাদুর পাহাড়। সেই জাদুর পাহাড়েই আছে সোনালি পানির মধু ঝরনা। জাদুর পাহাড়ের মধু ঝরনার পানিতে আছে জাদুকরী গুণ। সেই পানি কোনো অন্ধ মানুষের চোখে দিলে চোখ ভালো হয়ে যায়। বোবা মানুষ মুখে দিলে সে কথা বলতে পারে। বয়রা কোনো মানুষ কানে দিলে সে শুনতে পায়। খোঁড়া মানুষ পায়ে দিলে পা ভালো হয়ে যায়।

আরো যত রোগ-ব্যাধি আছে, সব ভালো হয় মধু ঝরনার পানিতে। সেই মধু ঝরনার পানি আনতে পারলেই ভালো হয়ে যাবেন হোসনা বানুর মা। তিনি আবারও চোখে দেখতে পারবেন আগের মতো। ভালো হয়ে যাবে এই গ্রামের অন্য সব অন্ধ মানুষও।

এই কথাগুলো হোসনা বানুকে বললেন বদ্যি দাদু। বদ্যি দাদু লুলুশিয়া গ্রামের একজন সম্মানিত প্রবীণ কবিরাজ। বেশ জ্ঞানী একজন ব্যক্তি তিনি। গ্রামের কারো কোনো রোগ-ব্যাধি হলে তারা বদ্যি দাদুর কাছে ছুটে যান। তিনি তাঁর সাধ্যমতো সেবা ও চিকিৎসা দিয়ে তাদেরকে সারিয়ে তোলেন। তাঁর কাছে হোসনা বানু মাকে নিয়ে এসেছে চিকিৎসার জন্য। বদ্যি দাদু ওর মাকে দেখেই এই কথাগুলো বললেন হোসনা বানুকে। হোসনা বানু সব কথা শুনে বললো, আমি যাবো সেই জাদুর পাহাড়ে। সেখান থেকে নিয়ে আসবো মধু ঝরনাার পানি।  আর তা দিয়ে সুস্থ করে তুলবো আমার মাকেসহ এই গ্রামের সবাইকে। তুমি আমাকে রাস্তা বলে দাও দাদু। বদ্যি দাদু বললেন, সে তো অনেক দূরের পথ। আর সেখানে গেলে অনেক বিপদের সম্মুখীন হতে হবে। তুমি ছোট্ট মেয়ে। তুমি কি পারবে সেই দুর্গম পথ পেরিয়ে ওখানে যেতে? হোসনা বানুর এক কথা। জাদুর পাহাড়ে সে যাবেই। মধু ঝরনার পানি এনে সে ওর মায়ের চোখ ভালো করে তুলবেই। তাই বদ্যি দাদু বলে দিলেন পথ। হোসনা বানু মা ও গাঁয়ের সবার দোয়া নিয়ে রওনা হয়ে গেলো। সাথে নিয়ে নিলো একটা পোঁটলা। পোঁটলায় বেঁধে নিলো একটা ছোট ছোরা, একটা দড়ি, কিছু শুকনো খাবার, এক কৌটা পানি।

মায়ের অন্ধ চোখ ভালো করার জন্য দুর্গম পথে হেঁটে চললো হোসনা বানু। যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। রাত দিন সমানে হেঁটে চলছে। যেতে যেতে যেতে হোসনা বানু ক্লান্ত হয়ে থামলো একটা গাছের নিচে। একটু জিরিয়ে না নিলে আর হচ্ছে না। খুব ক্ষিধেও পেয়েছে তার। হোসনা বানু গাছের নিচে বসে পোঁটলাটা খুলে দুটো শুকনো রুটি আর লবণ দেয়া মাংস বের করলো। বের করে যেই খেতে যাবে, তখন দুটো কাক ডেকে উঠলো। ওরা ডেকে বললো,

“দিন চলে যায় রাত চলে যায়/পাই না খেতে হায়/

কত মানুষ সামনে বসে/খাবার খেয়ে যায়/

একটু খাবার খেতে পেলে/বেঁচে যেতাম আজ/

বিনিময়ে করে দিতাম/কঠিন কোনো কাজ।”

কাক দুটোর কথা শুনে হোসনা বানুর মায়া হলো। নিজে রুটি না খেয়ে বললো, তোমাদের ক্ষুধা লেগেছে বুঝি? আসো তো আমার কাছে। আমার রুটি তোমাদের সাথে ভাগ করে খাবো। বিনিময়ে আমার কোনো কাজ করতে হবে না। তোমাদের পেট ভরলেই আমি খুশি। হোসনা বানুর ডাকে কাক দুটো নেমে এলো ওর কাছে। হোসনা বানুর সাথে ওরা মিলেমিশে খেলো রুটি আর সেদ্ধ করা মাংসের টুকরো।

খাওয়া শেষে জানতে চাইলো কোথায় যাবে হোসনা বানু। হোসনা বানু ওদেরকে জানালো, সে যেতে চায় জাদুর পাহাড়ে। তার প্রয়োজন সেখানকার মধু ঝরনার পানি। ‘সে তো অনেক কঠিন পথ বাপু; হিমালয় পর্বত ডিঙিয়ে যাওয়া সহজ নয়। আমাদেরকে তুমি খাবার দিয়ে বাঁচিয়েছো। তাই আমরা তোমায় একটা উপকার করবো’, বললো কাক দুটো। ‘তোমরা দুটি কাক পাখি। আমাকে কী এমন উপকার করতে পারবে?  আমার তো লম্বা দুর্গম পথ একাই পেরোতে হবে’, বললো হোসনা বানু। কাক দুটো তখন উড়ে গিয়ে বসলো গাছের উপর। সেখানেই ওদের বাসা। নিজেদের বাসা থেকে ঠোঁটে করে নিয়ে আসলো একটা রসুন আর একটা বনফুলের পাপড়ি। হোসনা বানুর হাতে দিয়ে বললো,

“এই রসুনের কোয়া যদি থাকে কারো কাছে

হিমালয় পর্বতের শীতেও উষ্ণ হয়ে বাঁচে।

এই পাপড়ি থাকলে চুলে ওজন কমে তার

হাওয়ার সাথে মিশে যাওয়া আহা চমৎকার।

হাওয়ায় মিশে ভেসে ভেসে দ্রুত যাওয়া যায়

যে মেয়েটা অনেক ভালো সেই এগুলো পায়।”

এইভাবে ছড়া কেটে হোসনা বানুকে রসুন ও পাপড়ি উপহার দিলো কাকেরা। বললো, এই রসুন তোমার সাথে থাকলে তোমার শরীর এতোই গরম থাকবে যে হিমালয় পর্বতের ঠান্ডায় তোমার কোনো ক্ষতিই হবে না। এই রসুন সাথে থাকলে তুমি যে কোনো শীতল পরিবেশে যেতে পারবে। আর এই বিশেষ ফুলের পাপড়ি তুমি চুলের ভাঁজে গেঁথে রাখলে তোমার ওজন হবে বাতাসের মতো হালকা। তখন তুমি বাতাসের সাথে ভেসে ভেসে চলে যেতে পারবে দ্রুত।

‘তোমার ইচ্ছে পূরণ হোক’-এই বলে উড়ে গেলো কাক দুটো। হোসনা বানু ওদেরকে ধন্যবা জানিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করলো। হাঁটতে হাঁটতে বিকেল গড়িয়ে রাত হলো, সকাল হলো, আবার দিন পেরিয়ে রাত হলো। ক্লান্তি এসে আবার ভর করলো হোসনা বানুর শরীরে। হোসনা বানু কাকেদের দেয়া ফুলের পাপড়িটা বের করে মাথার চুলে গুঁজে নেয়। তারপর সাথে সাথেই সে হয়ে যায় বাতাসের মতো হালকা। আহ্, কী আরাম! হোসনা বানুর নিজের শরীরের ওজন এতোটাই কমে যায় যে আরামে চোখ বন্ধ হয়ে আসে। পাখির মতো দুটি হাত মেলে দেয় শূন্যে।

হোসনা বানুকে উড়িয়ে নেয় বাতাস। বাতাসে ভেসে ভেসে খুব অল্প সময়েই হোসনা বানু ওর গন্তব্যের প্রথম ধাপের কাছে এসে যায়। ধীরে ধীরে অনুভব করতে থাকে শীতল একটা অনুভূতি। হিমালয় পর্বতের খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেলো হোসনা বানু। সামনেই দেখতে পেলো সাদা বরফে ঢাকা হিমালয় পর্বত। বিশাল উঁচুতে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে হিমালয়। হোসনা বানু হিমালয়ের যত কাছে যায়, ততই ঠান্ডা লাগে ওর। একটা সময় অসহ্য মনে হলে সে দাঁড়িয়ে পড়ে হিমালয় পর্বতের পাদদেশে। বাতাস তখনো ওকে উড়িয়ে নিতে চায়। পাহাড়ের বরফের সাথে একটা ধাক্কা লাগে ওর। হোসনা বানু তখন মাথা থেকে খুলে নেয় ফুলের পাপড়ি। প্রচণ্ড ঠান্ডায় আইসক্রিম-এর মতো জমে যেতে থাকে হোসনা বানু। এসময় ওর মনে পড়ে কাকদের দেয়া রসুনের কথা। পোঁটলা থেকে রসুনের একটা কোয়া বের করে হাতের মুঠোয় নেয় হোসনা বানু। তখন অবাক হয়ে অনুভব করে ওর শরীরটা কেমন যেন উষ্ণ আর চাঙা হয়ে উঠেছে। ক্লান্তিও ূর হয়ে গেছে। হিমালয়ের বরফ শীতল পরিবেশে কোনো ঠান্ডাই আর কাবু করতে পারে না হোসনা বানুকে। এবার হিমালয় পর্বত ডিঙিয়ে পার হতে পারলেই ওপারে ডাইনোসর-এর জঙ্গল। কিন্তু এখানে বাতাসে উড়ে চলা খুব বিপজ্জনক। কাচের মতো বরফের সাথে ধাক্কা লেগে কেটে যেতে পারে হাত-পা। তাই খালি হাতেই হিমালয় পর্বত ডিঙিয়ে যাবার চেষ্টা করতে হবে। খুব সাবধানে! কিন্তু এতো বড় হিমালয় পর্বত ডিঙিয়ে যাওয়া কেমন করে সম্ভব! হোসনা বানু ক্ষুধায় কাতর হয়ে ওর পোঁটলা বাঁধা শুকনো রুটি বের করে খাওয়ার জন্য। সাদা সমুদ্রের মতো বিশাল হিমালয় অঞ্চলের চারপাশে বরফ আর বরফ। একটা লম্বা বরফের চাঁইয়ের উপর বসে রুটি খেতে লাগলো হোসনা বানু। এসময় হঠাৎ যেন বরফটা নড়ে উঠলো। কী ব্যাপার, এতো বড়ো বরফের টুকরো তো বাতাসে নড়ার কথা না। ভাবতে ভাবতে আবার নড়ে উঠলো বরফ খণ্ডটা। হোসনা বানু তড়িঘড়ি করে রুটি খেয়ে দৌড়ে নেমে পড়লো বরফখণ্ডটা থেকে। তারপর অবাক হয়ে দেখলো লম্বা বরফ খণ্ডটা তুমুলভাবে কাঁপছে। কাঁপতে কাঁপতে উপরের বরফের আস্তরণটা সরে গেলো। দেখা গেলো, ওটা কোনো বরফের টুকরো নয়; ওটা একটা বিশাল শ্বেত ভালুক। শ্বেত ভালুকটা বরফের ভেতর জমে ছিলো। এখন প্রচণ্ড কাঁপছে। উঠে দাঁড়াতেই পারছে না। হোসনা বানু ওর কাছে এগিয়ে গিয়ে দেখলো ভালুকটা জ্বরে কাঁপছে। ভীষণ জ্বরে আক্রান্ত এই বরফ অঞ্চলের বিশাল শ্বেত ভালুক।

হোসনা বানুর মায়া হলো খুব। কী করা যায় ভাবতে ভাবতে মনে হলো ওর রসুনের কথা। কাকেদের দেয়া রসুনের থেকে এক কোয়া রসুন খুলে রেখে দিলো শ্বেত ভালুকের কানের ফুটোয়। কিছুক্ষণ পরেই উঠে দাঁড়ালো শ্বেত ভালুকটি। জ্বর সেরে একদম সুস্থ হয়ে গেলো ভালুকটা। সুস্থ হয়ে হোসনা বানুর দিকে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকালো। হোসনা বানুর কাছে জানতে চাইলো কোথায় যাবে সে। হোসনা বানু বললো সে যেতে চায় জাদুর পাহাড়ে। মধু ঝরনার সোনালি পানি দরকার তার মায়ের চোখ সারাতে। সব শুনে শ্বেত ভালুক বললো, ‘দাঁড়া মেয়ে, আসছি আমি’। এই বলে সে দৌড়ে গেলো নিজের গুহায়। গিয়ে ফিরেও আসলো খুব তাড়াতাড়ি। এসে হোসনা বানুর হাতে দিলো একটা সবুজ পাথর আর একটা ছোট লাঠি। এরপর বললো,

“ছোট্টো মেয়ে তুই তো ভীষণ ভালো,

দিচ্ছি তোকে অন্ধকারের আলো।

দিচ্ছি আরও পাহাড় নদী

ডিঙিয়ে চলার লাঠি,

তাদের বিজয় হবেই যাদের

মনটা থাকে খাঁটি।”

‘শোন্ মেয়ে, তুই আমাকে সুস্থ করে তুলেছিস। তাই তোকে দিলাম আমি এই দুটো উপহার। এই লাঠি তোকে হিমালয় পর্বত ডিঙিয়ে যেতে সাহায্য করবে। তুই নদীও পেরোতে পারবি এই লাঠি দিয়ে। আর এই ছোট্ট সবুজ পাথর অন্ধকার পথ আলোকিত করবে। এগিয়ে যা তুই। তোর বিজয় হবেই। শ্বেত ভালুকের কাছ থেকে খুব প্রয়োজনীয় উপহারদুটো পেয়ে অনেক খুশি হলো হোসনা বানু। তারপর ভালুকটাকে ধন্যবাদ জানিয়ে রওনা হলো আবার। কাঁধে পোঁটলা, একহাতে রসুনের কোয়া আর অন্য হাতে ভালুকের দেওয়া লাঠি নিয়ে এগোতে থাকলো সামনে। ডিঙিয়ে যেতে লাগলো পাহাড়। হিমালয় পর্বত ডিঙিয়ে যেতে এবার আর কোনো কষ্ট হলো না ওর। খুব সহজেই যেতে পারলো হিমালয় পর্বতের ওপারে। ভালুকের দেয়া এই লাঠিটা বেশ কাজের। বরফের পাহাড় ডিঙিয়ে আরো অনেকটা পথ পার হওয়ার পর শেষ হলো বরফের সমুদ্রের মতো বিশাল হিমাঞ্চল। তখন রসুনের কোয়ার রকার পড়লো না আর। রসুনের কোয়া পোঁটলায় রেখে পথে এবার একটু জিরিয়ে নিতে বসলো হোসনা বানু। এখান থেকে তিনশো ক্রোশ দূরে আছে ডাইনোসর-এর জঙ্গল। অনেক লম্বা পথ। এখন তাকে ভরসা করতে হবে বাতাসের ওপর। বাতাস যখন জঙ্গলমুখী হয়ে বইবে তখন কাকেদের দেয়া ফুলের পাপড়ি মাথায় গুঁজে বাতাসের সাথে ভেসে ভেসে আগাতে হবে পথ। তবেই যাওয়া সহজ হবে ডাইনোসর-এর জঙ্গলে। হোসনা বানু বাতাসের অপেক্ষায় বসে থাকলো পথের ধারে। সামনে হয়তো আছে ওর আরো বিপদ। সে বিপদ মোকাবেলা করে কেমন করে পৌঁছবে ডাইনোসর-এর জঙ্গলে? সেখানে কত বিপদের মুখোমুখি হতে হবে হোসনা বানুকে?

সেটা তো জানবোই আমরা। তবে সেটা জানতে হলে আমাদের যেতে হবে পরের পর্বে। চলবে..