বন্ধুরা, ভালো আছো নিশ্চয়ই। হ্যাঁ, আমি, তুমি, আমরা সবাই ভালোই আছি। কিন্তু ভালো নেই সারাবিশ্বের অসংখ্য শিশু। বিশেষ করে ফিলিস্তিনের গৃহহারা শিশুরা। একবার চিন্তা করে দেখো তো, ফিলিস্তিনের গাজার শিশুটির কথা, যার দিনের প্রতিটি মুহূর্ত কাটে যে কোনো সময় বোমার আঘাতে মারা যাবার আশঙ্কা নিয়ে, সে কি ভালো আছে? কিংবা যে শিশুটির পরিবারের সকল সদস্য মারা গিয়েছে, শরণার্থী শিবিরে সে কেমন আছে?
আজকে বলবো এমনই এক প্রতীকী শিশুর কথা, যে সকল ভয়, বিভীষিকার মধ্যেও দাঁড়িয়ে থাকে দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে, প্রতিরোধের বার্তা নিয়ে। একদিন হয়তো দশ বছর বয়সী হানজালার প্রতিরোধ বিজয়ের মুখ দেখবে, গৃহহীন হানজালারা ফিরে পাবে তাদের গৃহ। আমরাও সে দিনেরই অপেক্ষায়।

ফিলিস্তিনের আল শাজারা গ্রামে ১৯৩৮ সালে জন্মগ্রহণ করে একটি শিশু, নাম তার নাজি সালিম হুসাইন আল আলী। ১৯৪৮ সালে শিশুটির বয়স যখন ১০ বছর, তখন তার গ্রাম থেকে তাদের পরিবারসহ সকলকে উচ্ছেদ করা হয়। কারণ? কারণ, তাদের গ্রামটি আর ফিলিস্তিনের নয়; তাদের গ্রামের মাটি এখন ইজরাইল রাষ্ট্রের। দশ বছরের নাজি পরিবারের সাথে চলে যায় লেবাননের আইন আল হিলওয়াহ শরণার্থী শিবিরে। সেখানেই বড় হতে থাকে নাজি। বলাবাহুল্য, সে আর কোনোদিন তার প্রিয় গ্রামে ফিরে যেতে পারেনি। ছোট্ট নাজি বড় হয়ে চারুকলায় পড়াশোনা করে কার্টুনিস্ট হবার স্বপ্ন দেখে। কিন্তু রাজনৈতিক কারণেই সে লেবাননে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেনি। ১৯৬৩ সালে সে কুয়েত চলে যায় আর্ট নিয়ে উচ্চতর পড়াশোনার জন্য। সেখানে গিয়ে সে বিভিন্ন পত্রিকায় কার্টুনিস্ট ও ডিজাইনার হিসেবে কাজ করতে থাকে। ১৯৬৮ সালে আল-সিয়াসা পত্রিকার জন্য নাজি একটি কার্টুন আঁকে হানজালা নামে। এ কার্টুনটিই তাঁকে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি এনে দেয়। কার্টুন চরিত্র হানজালা দুনিয়াজুড়ে হয়ে ওঠে ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধের প্রতীক।
হানজালা একটি দশবছর বয়সী শিশুর ছবি, যে খালি পায়ে থাকে, চুলগুলো উশকো-খুশকো, ঠিক যেন সজারুর কাঁটার মতো। তার পোশাক দেখেই বোঝা যায়, দীর্ঘদিন যত্নের ছোঁয়া পায়নি শিশুটি। হাতদুটো সবসময় সে পেছনে বেঁধে রাখে। তার দাঁড়িয়ে থাকার মধ্যে একটা দৃঢ়তা দেখা যায়, যেন সে যে কোনো বিপর্যয়, যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে প্রস্তুত। যার চেহারা কখনো দেখা যায় না। কিন্তু বোঝা যায়, সে দৃঢ়ভাবে তাকিয়ে আছে কোনোকিছুর দিকে। হ্যাঁ, হানজালা কিছু করে না। সে শুধুই তাকিয়ে থাকে, তাকিয়ে দেখতে থাকে ঘটনাপ্রবাহ। কিন্তু তার একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকাটাই ক্রমাগত প্রশ্ন করে যায় বিশ্ববিবেককে।

হানজালা সবসময় উল্টোদিকে ঘুরে থাকে। কার্টুনিস্ট নাজি হানজালা চরিত্রটি সবসময়ই এঁকেছেন পেছন থেকে। ১৯৬৭ সালে ফিলিস্তিনের মানচিত্র ভেঙে যে দুইটি দেশের মানচিত্র তৈরি করা হয়, তার থেকেই মূলত সে মুখ ফিরিয়ে রেখেছে। হানজালা বিশ্বমোড়লদের বলতে চায়, আমার মাতৃভূমির মানচিত্র দ্বিখণ্ডিত করে চাপিয়ে দেয়া সমাধান তোমার কাছেই রাখো, আমার এ সমাধানের প্রয়োজন নেই।
হানজালা চরিত্রটিকে আর্টিস্ট প্রথমবার এঁকেছিলেন ১৯৬৮ সালে। এরপর বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন সময় তিনি অনেকবার এঁকেছেন চরিত্রটি। সর্বশেষ এঁকেছেন ১৯৮৭ সালে, তাঁর মৃত্যুর আগে। কিন্তু হানজালার বয়স কখনো বাড়েনি। হানজালার বয়স সবসময় ১০বছরই ছিলো। এমনকি যতদিন না ফিলিস্তিন স্বাধীন হবে, যতদিন না গৃহহীন শিশুরা ফিরে যাবে তাদের গৃহে, ততদিন হানজালার বয়স দশবছরই থাকবে।
আচ্ছা বন্ধুরা, তোমরা কি মনে করতে পারো কার্টুনিস্ট নাজি আল আলীকে কত বছর বয়সে গৃহ ত্যাগ করতে হয়েছিলো? হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছো, দশ বছর বয়সে- যখন তিনি হানজালার বয়সী ছিলেন। আসলে কার্টুনিস্ট নাজি হানজালা চরিত্রের মাধ্যমে তাঁর নিজের শৈশবের গৃহত্যাগের বেদনায় ফুটিয়ে তুলেছেন।
বর্তমানে হানজালা চরিত্রটি বিশ্বব্যাপী ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধের অন্যতম প্রতীক হয়ে উঠেছে। দুনিয়াজুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভে, মিছিলে দেখা যায় হানজালার কার্টুনের উপস্থিতি।
যুগ যুগ ধরে হানজালা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় ফিলিস্তিনের গৃহহীন শিশুদের কথা, ফিলিস্তিনিদের প্রতি হওয়া অবিচারের কথা, ফিলিস্তিনিদের কেড়ে নেয়া শৈশবের কথা। আমরা প্রার্থনা করি সকল হানজালার জন্য, যেন মুক্ত ফিলিস্তিনে তারা ফিরে যেতে পারে তাদের নিজেদের গৃহে। তাদের বসতি হয়ে উঠুক তাদের নিরাপদ আশ্রয়, এইই আমাদের প্রত্যাশা। ০