
একটা ছোট্ট নদী। কলকল ছলছল সুর তুলে বয়ে গেছে। নদীর গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে নিমতলি হাট। আর ছোট্ট এক গ্রাম। সেই গ্রামে বাস করে এক জেলে। নাম তার হারিস। জেলে ছিল খুবই গরিব। তবে বুদ্ধিমান। মানুষ তাকে অনেক ভালোবাসে। তার সততা ও বুদ্ধির প্রশংসা করে।
হারিস ছোট্ট নদীতে ছোট ছোট মাছ ধরে। সেই মাছ বাজারে বেচে চাল-ডাল কেনে। তারপর মনের সুখে গান গেয়ে বাড়ির পথ ধরে।
সব দিন যে মাছ পায়, তা নয়। প্রায়শই খালি ঝুড়ি নিয়ে বাড়ি ফিরতে হয়।
যেদিন মাছ পায়, সেদিন তো ভালো। জেলের বউয়ের মুখে হাসি ফুটে। খুশি মনে চুলোয় হাঁড়ি চড়ায়। ছেলেমেয়েদের পাতে দু’মুঠো খাবার তুলে দেয়।
আর যেদিন মাছ ধরতে পারে না, সেদিন জেলের উনুনে আগুন জ্বলে না। না খেয়েই বউ বাচ্চাদের নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
ছেলেমেয়েরা কি আর সহজে ঘুমোয়? পেটের ক্ষুধায় খুব কাঁদে।
রোজকার মতো সেদিনও হারিস মাছ ধরতে যায়। নদীতে জাল ফেলে ঝিম মেরে বসে থাকে। আর মনে মনে বলে- আল্লাহ, কালকেও মাছ পাইনি। ছেলেমেয়েগুলো না খেয়ে আছে। আজ কিছু মাছ দাও।
তখনই হারিসের জালে টান পড়লো। সে বুঝতে পারে- জালে মাছ পড়েছে।
হারিস তাড়াতাড়ি জাল গুটিয়ে নেয়। জল থেকে জাল তুলতেই দেখে, অনেক বড় একটা মাছ। হারিসের দিকে তাকিয়ে যেন মিটমিটিয়ে হাসছে।
মাছটা যেমনি বড়, তেমনি সুন্দর। আপেলের মতো লাল। পিঠের দিকে হলুদ ডোরাকাটা। হারিস ঠিক করলো, এই মাছটা সে বাজারে বেচবে না। এই মাছ নিয়ে যাবে রাজার কাছে। এত সুন্দর মাছ দেখে, রাজা নিশ্চয় খুশি হবেন।
তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল।
রাজমহলের আঙিনায় রাজা-রানি চা খাচ্ছেন। খোশ গল্প করছেন। এমন সময় প্রহরী খবর নিয়ে এলো- মহারাজ, জেলে হারিস এসেছে। সে খুব সুন্দর একটা মাছ এনেছে। তাকে এখানে নিয়ে আসবো?
রাজা বললেন- সুন্দর মাছ? বেশ, নিয়ে আসো।
প্রহরী যথা আজ্ঞা বলে চলে গেলো। তখনই রানি বিরক্তি নিয়ে বললো- সুন্দর মাছ না ছাই! আসলে এসব টাকা হাতানোর ফন্দি। আপনি রাজা, মাছ কি আর এমনিতে নেবেন? কম করে হলেও তো হাজার টাকা দেবেন। সে জন্যেই এই অবেলায় মাছ নিয়ে এসেছে। আপনার আর বুদ্ধি হলো না।
রাজার মন খারাপ হয়। ভাবেন, আমার কি সত্যিই বুদ্ধি নেই?
আচমকা রাজা মুচকি হাসলেন। মনে মনে বললেন, শুনেছি জেলে হারিস খুবই বুদ্ধিমান। তার বুদ্ধি দিয়েই রানিকে হারাতে হবে।
এই ভেবে রাজা রানিকে বললেন, তা নাহয় বুঝলাম। কিন্তু আমি যে ওকে আসতে বলেছি। এখন কী করে ফিরাবো?
রানি বললো, খুবই সহজ। আপনি জেলের কাছে জানতে চাইবেন, ওই মাছটা মেয়ে নাকি ছেলে? জেলে যদি বলে মাছটা ছেলে। তাহলে বলবেন, মাছটা ছেলে বলে নিয়ে এলে। মেয়ে হলে তো আনতে না। তুমি তো খুবই খারাপ লোক। মেয়েদের একদমই পছন্দ করো না। যাও যাও, তোমার থেকে মাছই নেবো না।
রানির বুদ্ধি দেখে রাজা হতবাক। মনে মনে ভাবলো, এমন কুবুদ্ধির রানির সাথে হারিস জিতবে তো?
রাজা এবার রানিকে বললো- কিন্তু জেলে যদি বলে, মাছটা মেয়ে। তখন কী করবো?
রানি মুচকি হেসে বললো- তাহলে বলবেন, একটা অবলা অসহায় মেয়ে মাছকে ধরতে পারলে? নারী জাতির প্রতি তোমার একটুও মায়া নেই? এতো ঘোর অপরাধ! যাও যাও; প্রাণে বাঁচতে চাইলে পালাও।
রাজা বললেন, তাহলে এক কাজ করো। আজকে জেলের সাথে তুমিই কথা বলো। আর আমি তোমার বুদ্ধির প্রশংসা করে বাহবা দেবো।
রানি রাজি হলো। বললো, বেশ।
তখনই প্রহরী হারিসকে নিয়ে হাজির। হারিসের হাতে থাকা সুন্দর মাছ দেখে রাজা অনেক খুশি হলেন। তবে প্রকাশ করলেন না। রানি হারিসকে জিজ্ঞেস করে- বলো তো জেলে, তোমার হাতের মাছটা ছেলে মাছ, নাকি মেয়ে মাছ?
রানির এমন উদ্ভট কথা শুনে হারিস মুচকি হাসলো। তারপর বললো, মহারানি! মাছটা ছেলেও না, মেয়েও না। এটা আসলে হিজড়া মাছ।
হিজড়া মাছ!
রানির মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। মনে মনে ভাবলো, এখন কী হবে?
তখন জেলে হারিস রানিকে বললো, মহারানি! আপনি মাছটাকে গ্রহণ করুন। তাহলে মানুষ আপনার প্রশংসা করবে। বলবে, আমাদের রানি কত্ত মহান! একটা হিজড়া মাছকে এক লাখ টাকা দিয়ে কিনেছেন। আসলে রানি হিজড়া জাতির প্রতি সম্মান দেখিয়েছেন। এমন রানির দীর্ঘায়ু হোক।
হারিসের বুদ্ধি দেখে রাজা খুবই খুশি হলেন। তিনি চুপি চুপি হাসলেন। তবে মুখ খুলে কিছুই বললেন না। তখন রানি হারিসকে বললো, আর যদি গ্রহণ না করি?
জেলে হারিস বললো, তাহলে প্রজারা আপনার নিন্দা করবে। বলবে, রানি তো খুবই খারাপ। মাছটা তো নিজ থেকে হিজড়া হয়নি। সৃষ্টিকর্তাই তাকে এভাবে সৃষ্টি করেছেন। রানি আসলে সৃষ্টিকর্তার অবমাননা করেছেন। তার অকল্যাণ হোক।
রানি এবার রাজার দিকে তাকালো। তার কানের কাছে ফিসফিস করে বললো, এখন কী করি?
রাজার মুখে উত্তর নেই। বললো, আমি কিছু বলতে পারবো না। মান বাঁচাতে চাইলে এক লাখ টাকা দিয়ে দাও।
রানি তাই করলো। জেলে হারিসকে বললো- তোমার বুদ্ধির কাছে আমি পরাজিত। তার জন্যে আমি অখুশি নই। তোমার বুদ্ধি যে আমার মিথ্যে অহংকার ভাঙতে পেরেছে, তার জন্যে তোমাকে এক লাখ টাকা উপহার দেওয়া হলো। ০