ছোট্ট আবিরা এঘর ওঘর করছিল। নানু এলো হঠাৎ বাইরে থেকে।
: ‘কী নানু ভাই? তুমি ব্যস্ত মনে হয়?’ সে বলল।
: ‘হ্যাঁ, একটু তো ব্যস্ত আছিই। কোরবানির ঈদ সামনে। গরু কিনতে হবে। তা, বলে ফেলো তোমার পেটের কথা।’ হেসে বললেন নানাভাই।
: ‘তেমন কিছু না। এলো ঈদ, সেমাই কোরমা পোলাও খাব। নতুন জামা কিনব। তা না, তুমি আছ গরু নিয়ে।’
ওহহো, বলে জোরে হেসে দিলেন নানাভাই। বললেন, এসো তবে সে কথাই বলি।
আসলে কোরবানি ঈদ এলে অনেক শিশুই এরকম কথা বলে। ফুলকুঁড়ি বন্ধুরা, আজ তোমাদের এই কোরবানির ঈদের কথাই বলব।
সব ভালো কাজের একটা উদ্দেশ্য থাকে। শুরু করি কোরবানির ঈদের মূল উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য নিয়ে।
আল্লাহর বন্ধু বা খলিলুল্লাহ হজরত ইব্রাহিম আ. আল্লাহর আদেশে নিজ পুত্র ইসমাঈল আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আল্লাহর রাহে কুরবানি করতে চেয়েছিলেন। হজরত ইব্রাহিম আ. এর ইচ্ছা ও ত্যাগের কথা স্মরণ করেই এই ঈদ পালন করা হয়।
ঈদুল আজহা, ঈদুল আজহা বা ঈদুল আদহা নানাভাবে এটাকে উচ্চারণ করা হয়। আরবি: এর বাংলা অর্থ হচ্ছে ‘ত্যাগের উৎসব’।
ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের জন্য আল্লাহ সবচেয়ে বড় দুটো ধর্মীয় উৎসব নির্ধারণ করে দিয়েছেন। প্রথমটি ঈদুল ফিতর। দ্বিতীয়টি এই ঈদুল আজহা। ঈদুল আজহা কুরবানির ঈদ নামেও পরিচিত, তা আগেই বলেছি। এই উৎসবকে ঈদুজ্জোহাও বলা হয়। ঈদুল আজহা মূলত আরবি বাক্যাংশ। এর অর্থ হলো ‘ত্যাগের উৎসব’। এই উৎসবের মূল বিষয় হলো ত্যাগ করা, কোরবানি করা। কোরবানি মানে কিন্তু শুধু পশু জবাই নয়, ত্যাগ ও কোরবানি।
কীভাবে দিনটি উদযাপিত হয়? এ দিনটিতে মুসলমানেরা ফজর নামাজের পর ঈদগাহে গিয়ে দুই রাক্বাত ঈদুল আজহার নামাজ আদায় করেন। এর পরপরই নিজ নিজ আর্থিক সামর্থ্য অনুযায়ী গরু, ছাগল, ভেড়া, মহিষ ও উট আল্লাহর নামে কোরবানি করেন।
চাঁদ দেখার পরদিন রোজার ঈদ হলেও কেরবানির ঈদ কিন্তু তেমন নয়। ইসলামী চান্দ্র পঞ্জিকায় ঈদুল আজহা জ্বিলহজ্জ মাসের ১০ তারিখে পড়ে। আন্তর্জাতিক (গ্রেগরিয়) পঞ্জিকায় তারিখ প্রতি বছর ভিন্ন হয়, সাধারণত এক বছর থেকে আরেক বছর ১০ বা ১১ দিন করে কমতে থাকে। ঈদের তারিখ স্থানীয়ভাবে জিলহজ্জ মাসের চাঁদ দেখার ওপর নির্ভর করে।
আর কী কী নাম আছে এর: এই নামটি প্রায়ই স্থানীয় ভাষায় বলা হয়ে থাকে, যেমন বাংলায় কোরবানি ঈদ, জার্মান ভাষায় Opferfest, ওলন্দাজ ভাষায় Offerfeest, রোমানীয় ভাষায় Sărbătoarea Sacrificiului, ও হাঙ্গেরীয় ভাষায় Áldozati ünnep। একই উৎসব নানা ধরনের নাম, বিষয়টা চমৎকার তাই না?
স্পেনীয় ভাষায় এটি Fiesta del Cordero বা Fiesta del Borrego. দুটিরই অর্থ ‘মেষশাবকের উৎসব’। মিসর, সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যে এটি عید البقرة ʿĪফ ধষ-ইধয়ধৎধয নামে, ইরানে عید قربان ঈদে কোরবান নামে, তুরস্কে Kurban Bayramı (ত্যাগের দিন) নামে পরিচিত। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং ফিলিপাইন Iduladha, Hari Raya Aiduladha, Hari Raya Haji বা কুরবান নামে পরিচিত।
কীভাবে এল নামটি, চলো এবার তা দেখা যাক।
আরবি عيد ঈদ শব্দটির অর্থ ‘উৎসব’, ‘উদ্যাপন’, ‘ভোজের দিন’, বা ‘ছুটির দিন’। ًأضحى আদহা শব্দটির অর্থ ‘ত্যাগ’। সেখান থেকেই এর উৎপত্তি।
এই ঈদের ছোট্ট একটি ইতিহাস আছে। বা ঘটনাও বলতে পারো। মহান আল্লাহ তা’আলা নবী হজরত ইব্রাহীম (আ.) কে স্বপ্নযোগে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় বস্তুটি কুরবানি করার নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, ‘তুমি তোমার প্রিয় বস্তু আল্লাহর নামে কোরবানি করো’।
ইব্রাহীম (আ.) স্বপ্নে এই আদেশ পেয়ে ১০টি উট কোরবানি করলেন। কয়েক দিন পর তিনি আবারও একই স্বপ্ন দেখলেন। এরপর ইব্রাহীম (আ.) ১০০টি উট কোরবানি করেন। এরপরেও তিনি একই স্বপ্ন দেখেন। এর পর ভাবলেন, আমার কাছে তো এ মুহূর্তে প্রিয় পুত্র ইসমাঈল ছাড়া আর কোনো প্রিয় বস্তু নেই। তখন তিনি পুত্রকে কোরবানির উদ্দেশ্যে প্রস্তুতিসহ আরাফাতের ময়দানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। এ সময় শয়তান আল্লাহর আদেশ পালন করা থেকে বিরত করার জন্য ইব্রাহীম (আ.) ও তাঁর পরিবারকে প্রলুব্ধ করেছিল, এবং ইসমাঈল শয়তানকে পাথর ছুঁড়ে মেরেছিলেন। শয়তানকে তার প্রত্যাখ্যানের কথা স্মরণে হজ্জের সময় শয়তানের অবস্থানের চিহ্নস্বরূপ নির্মিত ৩টি স্তম্ভে প্রতীকী পাথর নিক্ষেপ করা হয়। আর তোমরা তো জানোই, পবিত্র হজ ও ঈদুল আজহা একই সময়ে পালিত হয়।
যখন ইব্রাহীম (আ.) আরাফাত পর্বতের উপর তার পুত্রকে কোরবানি দেয়ার জন্য গলদেশে ছুরি চালানোর চেষ্টা করেন, তখন তিনি বিস্মিত হয়ে দেখেন যে তার পুত্রের পরিবর্তে একটি প্রাণী কোরবানি হয়েছে এবং তার পুত্রের কোনো ক্ষতি হয়নি। ইব্রাহীম (আ.) আল্লাহর আদেশ পালন করার দ্বারা কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এতে সন্তুষ্ট হয়ে আল্লাহ ইব্রাহীম (আ.) কে তার খলিল (বন্ধু) হিসেবে গ্রহণ করেন।
পবিত্র কোরআনে ইব্রাহিম (আ.) এর পুত্রের কুরবানির ঘটনা উল্লেখিত হয়েছে,
“হে আমার পরওয়ারদেগার! আমাকে এক সৎপুত্র দান করো।
সুতরাং আমি তাকে এক সহনশীল পুত্রের সুসংবাদ দান করলাম।
অতঃপর সে যখন পিতার সাথে চলাফেরা করার বয়সে উপনীত হলো, তখন ইব্রাহীম তাকে বলল- বৎস! আমি স্বপ্নে দেখি যে, তোমাকে যবেহ করছি; এখন তোমার অভিমত কী? সে বলল, পিতা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, তাই করুন। আল্লাহ চাহে তো আপনি আমাকে সবরকারী পাবেন।
যখন পিতা-পুত্র উভয়েই আনুগত্য প্রকাশ করল এবং ইব্রাহীম তাকে যবেহ করার জন্যে শায়িত করল।
তখন আমি তাকে ডেকে বললাম, হে ইব্রাহীম,
তুমি তো স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখালে! আমি এভাবেই সৎকর্মশীলদের প্রতিদান দিয়ে থাকি।
নিশ্চয় এটা এক সুস্পষ্ট পরীক্ষা।
আমি তার পরিবর্তে দিলাম যবেহ করার জন্যে এক মহান জন্তু। (সাফফাত : ১০০-১০৭)
আশা করি বুঝতে পেরেছ।
এই ঘটনাকে স্মরণ করে সারা বিশ্বের মুসলিমরা আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য প্রতি বছর এই দিবসটি উদ্যাপন করে। হিজরি বর্ষপঞ্জি হিসাবে জিলহজ্জ্ব মাসের ১০ তারিখ থেকে শুরু করে ১২ তারিখ পর্যন্ত ৩ দিন ধরে ঈদুল আজহার কুরবানি চলে। মনের পশুকে জবাই করা, সমাজে ত্যাগের আদর্শ প্রতিষ্ঠা করা ঈদুল আজহার প্রকৃত শিক্ষা। আর ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আজহার মাঝে ২ মাস ১০ দিন ব্যবধান থাকে। ফলে একটি ঈদ শেষ হতে না হতে আরেকটি ঈদ চলে আসে। এটাই আল্লাহর বিধান। এভাবেই মুসলমানরা পালন করে দুটি উৎসব।
আবিরা বলেছিলো, কোরবানির ঈদে জামা কাপড়ের কিছু দেখা যাচ্ছে না। জামা কাপড়ের বিষয়টা ঈদুল ফিতরের সময়ই প্রধান হয়ে ওঠে। ঈদুল আজহায় প্রধান হয়ে ওঠে পশু কোরবানি। তবে সেমাই কোরমা পোলাও এই ঈদেও খাওয়া হয়। সবচেয়ে বেশি খাওয়া হয় গরু বা খাসি/ছাগল, তথা যা কোরবানি করা হয় তার গোশত। শুধু নিজেরা খেলেই হবে না, গরিবদের মধ্যে এর একটি অংশ বিলিয়ে দিতে হবে। যাতে তারাও ঈদে গোশত খেতে পারে।
আর একটা কথা। গোশত খাওয়ার নিয়তে কোরবানি দিলে কিন্তু তা সঠিক হবে না। আল্লাহর উদ্দেশ্যেই কোরবানি করতে হবে।
তোমরাও গরিবদের মধ্যে কোরবানির গোশত বিলিয়ে ত্যাগের মহিমা প্রকাশ করতে পারো। ০