চৌধুরী মঞ্জিল

আবু নেসার শাহীন

0
31

ভোর বেলা। জাগজুর গ্রামে পুরুষ মানুষ নেই বললেই চলে। একটা থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে। গ্রামে ঢোকার মুখে এবং বের হওয়ার পথে চেক পোস্ট বসানো হয়েছে। একটার পর একটা ঘরে তল্লাশি চলছে। ভয়ে কেউ মুখ খুলছে না। পুলিশও নাছোড়বান্দা। আসামি খুঁজে বের করবেই। কিন্তু চব্বিশ ঘণ্টা পার হয়ে গেলেও রহস্যের কোনো ক‚ল কিনারা করতে পারেনি। এক রকম বাধ্য হয়ে তপুকে ডাকা হয়েছে।
চৌধুরী মঞ্জিল বেশ পুরনো একটা বাড়ি। বাড়ির চারদিকে উঁচু দেয়াল। ভেতরে বেশ কিছু পুকুর আছে। একপাশে ঝোপঝাড় বনজঙ্গল। গেইটে সারাক্ষণ একজন দারোয়ান বসে থাকে। তার চোখকে ফাঁকি দিয়ে ভেতরে ঢ়োকা প্রায় অসম্ভব। তাদের ধারণা গ্রামের কেউ চৌধুরী সাহেবকে খুন করেছে। তপু মন দিয়ে সব শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল- ‘তা রমিজ কাকু, এ বাড়িতে কে কে আসত ?’
‘জ্বি কেউ আসত না। এক বছর আগে একজন উকিল সাহেব এসেছিলেন। সারাদিন থেকে রাতের খাবার খেয়ে চলে যান। চৌধুরী সাহেব নিজেই নিজের খাবার পাক করতেন। নিজের ঘর নিজেই গোছগাছ করতেন। রোজ রাতে বাড়ির ভেতর হাঁটাহাঁটি করতেন। কিন্তু কাল রাতে…’
‘কিন্তু কাল রাতে কী? একটু খুলে বল।’
‘কাল রাতে উনি বাইরে বের হয়নি। ঘরেই ছিলেন। রাতের খাবারও খেয়েছিলেন।’
‘তার মানে তুমি কিছুই জানো না।’
‘আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না?’
‘এক্ষুণি কিছু বলতে পারছি না। তবে তুমি সন্দেহের তালিকায় আছো। কী, ভয়ে হাত পা কাঁপছে না?’
রমিজ হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে মাটি খোঁড়ে। এস আই জমির বললেন, ‘তপু কোনো ক্লু পেলে? ’ নো, ‘আপাতত না। সন্দেহ এক- উনি খুন হয়েছেন। আর সন্দেহ দুই…
‘সন্দেহ দুই!’ জমির দুই চোখ কপালে তুলে বললেন।
‘উনি কিডন্যাপ হয়েছেন।’
‘হোয়াট? এসব কি বলছ? তুমি তো বিষয়টা জটিল করে তুলছ! না না, আমার মনে হয় এটা খুন।’
তপু উপুড় হয়ে বসে মেঝেতে পড়ে থাকা রক্ত হাতে নিয়ে পরীক্ষা করে দেখে। এ সময় দূর থেকে একজন কনস্টেবল চেঁচিয়ে বলল, ‘স্যার একটু এদিকে আসেন।’
জমির ও তপু প্রায় দৌড়ে এসে দেখে একটা ঝোপের মধ্যে ছড়ানো ছিটানো রক্ত। তপু জমিরের দিকে তাকিয়ে বলল, কি বুঝলেন?
‘আমি বুঝলে তো আর তোমাকে ডেকে আনা হত না। তুমিই বল তুমি কি বুঝলে।’
‘বুঝলাম এটা মানুষের রক্ত না। বিশ্বাস না হলে ল্যাবে নিয়ে পরীক্ষা করে দেখতে পারেন।’
তপুর কথা শুনে রমিজ চিৎকার করে কাঁদে।
‘এই তুমি চুপ কর।’ জমির ধমকিয়ে ওঠেন। রমিজ চুপ মেরে গেলেও মাঝেমধ্যে ফুঁপিয়ে ওঠে।
‘স্যার প্রায় একদিন পার হয়ে গেল। এখনও রহস্য উন্মোচন হলো না। একটা কেস নিয়ে পড়ে থাকলে হবে? আমাদের তো আরও কাজ আছে নাকি?’ আরেকজন কনস্টেবল বলল।
কথা সত্য। কিন্তু কিছু করার নেই। তপু চেষ্টা চালিয়ে যাও। উনার ছেলে মেয়ে স্ত্রী’কে খবর দেওয়া হয়েছে। গত দশ ঘণ্টা আগে প্লেনে উঠেছে। আপনারা থাকুন। আমি থানা থেকে ঘুরে আসছি। সবাই চোখ কান খোলা রাখবেন। এস আই জমির চলে যান।
তপু আরও কিছুক্ষণ থেকে বাড়ি ফেরে। তার বাড়ি থেকে কয়েক বিঘা জমির পর রেল লাইন। মাঝেমধ্যে হুইসেল দিতে দিতে ট্রেন আসা যাওয়া করে। আকাশে পূর্ণিমা চাঁদ। পুরো গ্রাম জোছনায় প্লাবিত। সে কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করে বিছানায় উঠে বসে। তার ঘুম আসছে না। মা বাবাও বাড়িতে নেই। ডাক্তার দেখাতে শহরে গেছেন। আজ বাড়ি ফিরবে বলে মনে হয় না।
সকাল হতেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে তপু। গ্রামের মাঝখানে বেলালের টং দোকান। দ্রুত চা রুটি খেয়ে চৌধুরী মঞ্জিলের দিকে হাঁটতে থাকে। পথে ক্লাসমেট রবিউলের সাথে দেখা। রবিউল বলল, ‘লন্ডন থেকে চৌধুরী সাহেবের ছেলে মেয়ে স্ত্রী এসেছে। চৌধুরী মঞ্জিলে শোকের মাতম। মাদ্রাসা থেকে হুজুর নিয়ে এসে কুরআন খতম পড়াচ্ছেন। যোহর নামাজের পর গায়বেনা জানাজা পড়ানো হবে।’
‘কিন্তু কেন?’
‘কেন আবার কী? চৌধুরী সাহেব মারা গেছেন আর তার জানাজা পড়ানো হবে না। তা কী করে হয়?’
‘উনি মারা গেছেন এটা নিশ্চিত? আর কে নিশ্চিত করেছে?’
‘কে আবার? পুলিশ। এই প্রথম তুই ফেল মারলি। রহস্য উন্মোচন করতে পারলি না। যা বাড়ি ফিরে যা। শুধু শুধু সময় নষ্ট করে কী লাভ। তারচে বরং পড়ালেখায় মন দে। কাজে দিবে।’ রবিউল চলে যায়।
ঝোপের আড়াল থেকে কয়েকটা কুকুর বেরিয়ে আসে। একটা কুকুরের মুখে ইঁদুর। ইঁদুরটা ছটফট করছে।
চৌধুরী মঞ্জিলে ঢ়ুকে দেখে এখনও পুলিশ আছে। তাকে দেখে জমির ছুটে এসে বললেন, ‘ল্যাবে রক্ত পরীক্ষা করে দেখেছি এগুলো মানুষের রক্ত না।’
‘তাহলে?’ তার কপালে চিন্তার ভাঁজ।
‘তাহলে আবার কী? উনার পরিবারের লোকজন ধরে নিয়েছেন উনি মারা গেছেন। এখানে আমাদের কী করার আছে?’
‘তা ঠিক। কিন্তু রবিউল যে বলল পুলিশ চৌধুরী সাহেবের মৃত্যু নিশ্চিত করেছে।’
‘সে পুরোপুরি মিথ্যে বলেনি। চৌধুরী সাহেবের ছেলে মেয়ে আর স্ত্রী’র জেরার মুখে এক রকম রাগ করে বলেছি।’
‘ও, তাহলে গ্রামে পুরুষ মানুষ ফিরতে আর বাঁধা নেই।’
‘না।’
এ সময় রমিজ চিৎকার করে ওঠে। তপু দেখে রমিজ একটা পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে চিৎকার করছে। হাতে কিছু কাপড়। সেদিক থেকে চোখ ফেরাতেই দেখে গেইট দিয়ে একজন উকিল ঢুকে।
‘কী ব্যাপার বলুনতো?’ দীপু নিচু গলায় বলল।
‘উনার পরিবার মনে হচ্ছে সব সম্পত্তি বিক্রি করে দিয়ে চলে যাবে।’
‘এই প্ল্যান?’
‘হুঁ। পৃথিবীটা বড় রহস্যজনক। যে ছেলে মেয়ে স্ত্রী গত বিশ বছর দেশে আসেনি। চৌধুরী সাহেব কেমন আছেন? কীভাবে তার দিন কাটছে? একবারের জন্যও খবর নেয়নি। অথচ চৌধুরী সাহেবের মৃত্যুর ত্রিশ ঘণ্টার মধ্যে দেশে চলে এসেছেন সম্পত্তি বিক্রি করতে।’
‘কই আপনারা আসছেন না কেন?’ রমিজ আবারও চিৎকার করে ওঠে।
‘চলুন তো একবার গিয়ে দেখে আসি।’
‘হ্যাঁ চলুন।’
পুকুরের এ পাশটায় কেউ আসে না। ছোট ছোট গাছপালা ভরা। এখানে সেখানে ইঁদুরের গর্ত। তীব্র গন্ধ। তপু ও জমির নাক চেপে ধরে। তপু বলল, ‘কী ব্যাপার?’
‘এই দেখেন চৌধুরী সাহেবের কাপড়। কাপড় ভেজা। মনে হচ্ছে কিছুক্ষণ আগে শুকাতে দেওয়া হয়েছে।’ রমিজ বলল।
‘আর বলতে হবে না। সব বুঝতে পেরেছি।’ তপুর মুখে হাসি।
‘কী বুঝতে পেরেছ? খুলে বল।’ এস আই জমির ভ্রু-কুঁচকে বললেন।
‘চৌধুরী সাহেব জীবিত। এবং এই বাড়িতেই আছেন। উনি খুব ভোরে গোসল ও করেছেন।’
‘কী সাংঘাতিক!’ তারা ধীরে ধীরে সামনে এগুতে থাকে। রুটির খালি প্যাকেট। ডিমের খোসা। কলার ছোকলা। টি ব্যাগ। ঔষধের খালি প্যাকেট। এসবও খুঁজে পায়।
‘আপনার ফোর্সকে কাজে লাগান। সারা বাড়ি তন্নতন্ন করে খোঁজা হোক।’ এ সময় কারও নাক ডাকার শব্দ শুনতে পায় তারা।
‘চৌধুরী সাহেব ঘুমের ঘোরে নাক ডাকেন?’ জমির রমিজের দিকে তাকিয়ে বললেন।
‘জ্বি। বিকট শব্দে নাক ডাকেন।’
জমির তার ফোর্সকে খবর দিয়ে নিয়ে আসে। নাক ডাকার শব্দ খুব ক্ষীণ। ভালো করে খেয়াল না করলে বুঝার উপায় নেই। জমির বললেন, ‘ডগ স্কোয়াড লাগবে?’
‘না না। বিশ গজের ভেতর আছেন। এটা কনফার্ম। চৌধুরী সাহেব গর্ত করে লুকিয়ে আছেন। গর্ত করেছেন দুই থেকে তিন মাস আগে।’
‘হতে পারে। উনি প্রায়ই এদিকে আসতেন। জিজ্ঞেস করলে কিছু বলতেন না।’ রমিজ বলল।
তপু হাঁটু গেড়ে বসে ঘাসে কান পাতে। তারপর সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ায়। তপু বলল, ‘সম্ভবত এখানে।’
‘ঠিক আছে। মাটি খুঁড়ে দেখি। একজন দৌড়ে যাও। কোদাল বা শাবল নিয়ে আসো।’ জমিরের কথা শেষ না হতেই রমিজ দৌড়ে গিয়ে শাবল কোদাল নিয়ে এসে মাটি খোঁড়া শুরু করে। খুব বেশি কষ্ট করতে হলো না। অল্পতেই পেয়ে গেল গর্তের মুখ। গর্তে ঢুকে দেখে এলাহি কাণ্ড। একজনের একটা খাট। ফ্যান চালিয়ে আরাম করে ঘুমোচ্ছেন চৌধুরী সাহেব। তপু তার চুলে বিলি কেটে বলল, ‘আর কত ঘুমাবেন? এবার উঠুন।’
‘সবাইকে পেরেশানির মধ্যে ফেলে আরাম করে ঘুমাচ্ছেন।’ রমিজের গলায় অভিমানের সুর।
কথাবার্তার শব্দ শুনে চোখ মেলে চৌধুরী সাহেব। সবাই তার মুখের উপর ঝুঁকে আছে। তিনি অবাক হয়ে বিছানায় উঠে বসেন। হাই তুলতে তুলতে বললেন, ‘আপনারা এখানে কীভাবে এলেন?’
‘সে কথা পরে হবে। আগে বলুন আপনার সমস্যা কী?’
‘কোনো সমস্যা না। একটু কবরের পরিস্থিতি উপলব্ধি করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সেটা আর হলো কোথায়? সবাই এসে সব ভেস্তে গেল।’
‘তাড়াতাড়ি এখান থেকে চলুন। এতক্ষণে মনে হয় আপনার গায়েবানা জানাজা পড়া শেষ।’ তপু বলল।
‘কী বলছ এসব?’
‘আপনার ছেলে মেয়ে স্ত্রী এসেছেন। বাড়ি বিক্রির জন্য কাগজপত্র ঠিক করছেন।’ রমিজ বলল।
‘বলছিস কী?’ চৌধুরী সাহেব গর্ত থেকে বেরিয়ে সোজা হাঁটতে থাকেন। সবাই তাকে অনুসরণ করে।
বাড়ির ভেতর বিশাল উঠোন। তার জানাজা পড়ার জন্য কয়েকশ মানুষ এসেছে। সবাই লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তার ছেলে সবার উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখছে। ঠিক এ সময় চৌধুরী সাহেব ছেলের পাশে এসে দাঁড়ান। সবাই তাকে দেখে অবাক হয়। পরস্পর পরস্পরের সাথে কথা বলে। বিশাল হট্টগোল সৃষ্টি হয়।
‘বাবা আপনি?’ ছেলে খুব অবাক হয়। কিছুটা লজ্জাও পায়।
চৌধুরী সাহেব হাত উঁচিয়ে সবাইকে থামতে বললেন, ‘আমি এখনও জীবিত। আপনারা সবাই চলে যান। সত্যি সত্যি যদি কোনোদিন মারা যাই তাহলে খবর পাবেন। আর মিথ্যে জানাজা পড়তে এসেছেন বলে দুঃখিত।’
‘আমিও তাহলে যাই। আজ আর স্কুলে যাওয়া হবে না।’ তপু বলল।
‘যাও তপু। ভালো থেকো। তোমার জন্য আমার সবকিছু রক্ষা পেল।’
‘সবকিছু তপু করেছে। আর আমরা…
‘আরে না না। আপনারাও অনেক খেটেছেন।’
‘আচ্ছা চৌধুরী সাহেব, রক্ত কোথায় পেলেন?’ রমিজ প্রশ্ন করে।
‘এটা পরে বলব।’
‘বাবা আমি, আমরা ভুল করেছি। নেক্সট টাইম আর এ রকম ভুল হবে না। আমাদের ক্ষমা করবেন।’
চৌধুরী সাহেব কোনো কথা বলেন না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকেন। এক সময় সবাই চলে যায়।
গভীর রাত। তপু শব্দ করে পড়ছে। সামনে পরীক্ষা। এ সময় মোবাইল বাজে। ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে এস আই জমিরের কণ্ঠ, ‘সর্বনাশ তপু।’
‘কী হয়েছে জমির সাহেব?’ সে চমকে ওঠে।
‘এবার সত্যি সত্যি চৌধুরী সাহেব মারা গেছেন। কাল বাদ-যোহর তার জানাজা।’
‘কীভাবে মারা গেলেন?’
‘রাতে বউ ছেলে মেয়ের সাথে প্রচণ্ড ঝগড়া হয়। ঝগড়ার এক পর্যায়ে হার্ট অ্যাটাক হয়। সাথে সাথে শেষ।’
‘আমি ব্যাপারটা দেখব?’
‘না। এ ব্যাপারে তোমার আর গোয়েন্দাগিরি করার দরকার নেই। তবে কাল জানাজা পড়তে আসবে কিন্তু। দেখা হবে।’
‘ঠিক আছে।’ লাইন কেটে যায়।
তপু পড়া শেষ করে লাইট বন্ধ করে শুয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করে যখন গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়। তখন ফজরের আযান পড়ে। ০