লেখাপড়ায় মন বসাতে পারছে না খেয়ালি ছেলেটি। তবু পড়ার টেবিলে। আনমনা হয়ে বসে আছে। সামনে পর্দা তোলা, জানালা খোলা।
মধ্যরাত। দূরে জোছনার মায়া মুগ্ধতা। নিজের কৈশোরের স্মৃতি মনে করে কবি লিখলেন-
সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে কর্ণফুলীর কূলটায়
দুধ ভরা ঐ চাঁদের বাতি ফেরেশতারা উল্টায়!
চাঁদটা যেন এক বাটি তরল আলো। উপুড় করে ঢেলে দিতেই মিশমিশে কালো অমাবস্যায় আবৃত নদীর দুকূল ফিনফিনে সাদা আলোয় প্লাবিত হয়ে গেল। কর্ণফুলী নদী আর তার আশপাশের ঘুমিয়ে পড়া গ্রামে কী অপরূপ
মোহ-মুগ্ধতায় জোসনা নামে তার বর্ণনা এমন করে এর আগে কেউ কি এঁকেছেন! এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছো আমরা কার কথা বলছি। তিনি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি, শিশুসাহিত্যিক, কথাসাহিত্যিক এবং ঔপন্যাসিক কবি আল মাহমুদ।
কবিরা প্রকৃতির বন্ধু হয়। ফুলের বন্ধু, পাখির বন্ধু, গাছপালার বন্ধু। কিন্তু কবি আল মাহমুদের বন্ধুত্ব ছিল পৃথিবী নামক গ্রহটির সাথে। নগরায়নের ফলে কিংবা শিল্পায়নের প্রভাবে কলকারখানার বর্জ্য এবং কার্বন নিঃসরণের
মাধ্যমে মানুষ পৃথিবীর যে ক্ষতি করছে তা তাকে সবচেয়ে বেশি আহত করেছে। ছড়ায়-কবিতায় প্রতিনিয়তই প্রতিবাদ করতে চেয়েছেন। দূষণের হাত থেকে বাঁচাতে চেয়েছেন মানুষের অকৃত্রিম বন্ধু গাছপালাকে, সবুজ প্রকৃ
তিকে। কখনোবা অভিমান করে চলে যেতে চেয়েছেন অন্য কোথাও । তিনি লিখেছেন-
চতুর্দিকে কেবল দ্যাখো ইট পাথরের বাড়ি
গাড়ির ধোঁয়ার অন্ধকারে উল্টে আসে নাড়ি
এর মাঝে কি ছড়ার ছন্দ লিখতে পারে কেউ?
চতুর্দিকে নিষেধ মানা আহাজারীর ঢেউ।
ছড়ার জন্য চলো আমরা অন্য কোথাও যাই
অন্য কোথাও, শস্যভরা প্রান্তরে হারাই।
এমন শস্য ভরা প্রান্তরে হারিয়ে যাওয়ার বাসনা কবির শৈশব থেকেই। তিনি জন্মেছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মোড়াইল গ্রামে। সময়টা ১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার ওপর দিয়ে বয়ে চলা তিতাস নদীর রূপ সৌন্দর্য কবিকে প্রকৃতির প্রতি মোহাগ্রস্ত করেছে। শাখা নদীর শান্ত জলে শাপলা ফুলের বড় বড় পাতার ওপর ঘুমিয়ে পড়ার স্বপ্ন নিয়ে কবি লিখেছেন-
মেঘনা নদীর শান্ত মেয়ে তিতাসে
মেঘের মতো পাল উড়িয়ে কি ভাসে
শাপলা ফুলের শীতল সবুজ পালিশে
থাকবে খোকন ঘুমিয়ে ফুলের বালিশে।
দুধে আলতা গায়ের রং আর টুকটুকে ফর্সা মুখাবয়বের ওপর ঝাঁকড়া চুলের ছোট্ট খোকাটির শৈশব ছিল স্বপ্নের মতন সুন্দর। ছেলেবেলার কথা যখন এসেই গেল, একটি না হয় গল্প শোনা যাক। কবির তখন হাতেখড়ি নেবার সময় এসেছে। পাঠশালার পাশাপাশি মক্তবেও যেতে হবে। কিন্তু বাঁধ সেঁধেছে তার মাথার বড় বড় ঝাঁকড়া চুল। এত বড় বড় চুল নিয়ে কেউ মক্তবে পড়তে যায়? হুজুরের চোখে পড়লে নির্ঘাত বেতের বাড়ি খেতে হবে। মা বললেন, কেটে ফেলতে। অনেকদিনের শখের চুল। চেহারার সাথে মানিয়ে যাওয়া ঝাঁকড়া চুল। সেটি ফেলে দিলে তাকে কেমন দেখাবে এই চিন্তায় কবির চোখে পানি এসে গেল। যথাসময়ে পারিবারিক নাপিত মধু কাকা এলেন চুল কাটতে। মধু কাকাকে বাড়ির ছোটরা খুব সমীহ করে, ভয় পায়। কবি তবু সাহস করে মধু কাকার কানে কানে বললেন, কাকা, চুলটা একটু বড় করে কাটবেন। মধু কাকা জলদগম্ভীর স্বরে বলেন, ও নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। চুল কাটা শুরু হলো। কাঁচির খসখস আওয়াজ কবির অন্তরাত্মাকে যেন বিদ্ধ করছিলো বারবার। পুরোটা সময় চোখ বন্ধ করে রইলেন কবি। মধু কাকা যখন বললেন, শেষ হয়েছে, এবার চোখ খোল। চোখ খুলে কবি নিজেকেই চিনতে পারছেন না। কেমন আতাফলের মতন গোলগাল একটি মুখ। এটি কার মুখ? কবি ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। মধু কাকা বললেন, খবরদার তোর মা’র সামনে যাবি না। তাহলে বলবে এত বড় বড় করে কেন কাটা হয়েছে। এবারে আমি বটি দিয়ে কাটবো। কবি যখন তার মায়ের কাছে গেলেন, মা তার চেহারা দেখে ফিক করে হেসে ফেললেন। অভিমানে কাঁদো কাঁদো খোকাকে বুকে টেনে নিয়ে কপালে চুমু এঁকে বললেন, এই চাঁদ মুখটা তো এতদিন দেখতেই পাইনি বড় বড় চুলের কারণে। কী সুন্দর রাজপুত্রের মতন দেখতে আমার ছেলেটা! পরদিন সকালে মক্তবে যাওয়ার আগে কবি ভাবলেন, একটা টুপি মাথায় দিয়ে যাই। একটা বড়সড় টুপিতে পুরোটা মাথা ঢেকে মক্তবে গেলেন তিনি। পড়ানো শেষ করে কবিকে কাছে ডাকলেন মৌলভি সাহেব। মাথা থেকে টুপিটা খুলে চুলের এই অবস্থা দেখে জিজ্ঞেস করলেন, কে করেছে তোমার এই দশা? মাথা নিচু করে আছেন কবি। মৌলভী সাহেব মুখ থেকে কেবল একটি শব্দই উচ্চারণ করেছিলেন। বেরহম। অর্থাৎ তোমার ওপর রহম করা হয়নি। তোমার ওপর অন্যায় করা হয়েছে। যার ভয়ে মাথার চুল এভাবে ছোট করে ফেলা, তিনি যখন ব্যাপারটাকে সঠিক কাজ হয়নি বলে রায় দিলেন, কবির অন্তরে বুদবুদ হয়ে থাকা অভিমানগুলো তখন চোখের পানির বড় বড় ফোঁটা হয়ে বের হয়ে আসলো। নরম মনের ফুটফুটে সুন্দর এই ছেলেটির কেবল নিজের মাথার চুল নয়, গাছের পাতা কিংবা ফুলের পাপড়ি ছেঁড়ার প্রতিও ছিল চরম অনীহা। তিনি লিখেছেন-
যে ছেলেটা বৃক্ষ কাটে
পুষ্প ছেঁড়ে
ভাঙ্গে পাখির বাসা;
সে তো কেবল ফড়িং ধরা
বৃক্ষে চড়া
ভাবে খেল্-তামাশা।
তার সাথে দাও আড়ি
ফুল পাখিকে কাঁদায় যারা
যেও না তার বাড়ি।
রসায়নের রান্না কবিতায় পৃথিবীর প্রতি মানুষের অত্যাচারকে তিনি সবচেয়ে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। যাদের বোধ আছে, বিবেক আছে, নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে যারা চিন্তিত, পৃথিবীকে মানুষের বসবাস উপযোগী করে রাখতে যারা বদ্ধপরিকর, এই কবিতা যেন তাদের প্রকাশ না করতে পারা অন্তরের আকুতি-
গ্লোবের পেটে কান লাগিয়ে খোকন শোনে কান্না
বিশ্ব গোলোক ফুঁপিয়ে ওঠে আর পারিনা আর না
মানুষ নামের বিজ্ঞানীরা আমায় নিয়ে খেলছে
আমার সাগর পাহাড় নদী রোলার দিয়ে বেলছে
ক্লোরোফিলের সবুজ ভরা ছিল আমার গাত্র
সাগর ভরা ছিল আমার লবণ জনের পাত্র
সব বিষিয়ে দিচ্ছে মানুষ ধোঁয়ায় আকাশ অন্ধ
কলের বিষে তলিয়ে গেছে গোলাপ ফুলের গন্ধ
শস্য ছিলো শ্যামল ছিলো, ছিলো সুখের পার্বণ
শান্তিটাকে পুড়িয়ে মানুষ করলো কালো কার্বন
পক্ষী কাঁদে পুষ্প কাঁদে রসায়নের রান্না
বন্ধ করো বন্ধ করো আর পারিনা আর না।
বন্ধুর সাথে মাঝে মাঝে মানুষ অভিমান করে।
মাঝে মাঝে দূরে সরে যেতে চায়। পৃথিবীর সাথে
অভিমান করেও একবার কবি অনেক দূরে চলে
যেতে চেয়েছিলেন। অন্য কোন তারায়, অন্য
কোন গ্রহে আমারও ভাই ইচ্ছে জাগে আকাশে কান পাতি
বিশ্ব ছেড়ে গ্রহান্তরের তারায় তারায় মাতি।
আবার ভাবি এই পৃথিবী সেও তো এক তারা
লক্ষ তারার ঘূর্ণিপাকে ঘুরছে পাগল পারা।
সব গ্রহকে শুকলো মানুষ নিষ্প্রাণ নির্জল
কেবল আমার জগতটাতেই মায়াবি কম্বল
বাতাস বায়ু বৃষ্টিধারা চির হরিৎ ঘাস
পাখির উড়াল প্রাণের কাঁপন মানুষের নিঃশ্বাস।
অন্য তারায় আছে কি ভাই এমন মাটির টান
কোথাও নেই ঋতুর বাহার দোয়েল পাখির গান
শুক্র বলো শনি বলো কিংবা বৃহস্পতি
কোথাও নেই প্রাণের আরাম কিংবা বায়ুর গতি
আমাদের সেই মহান প্রভু আল্লাহ দয়াময়
এই গ্রহকে দিলেন দয়া সবুজের আশ্রয়।
অতি সাদাসিধে সরল মনের এই মানুষটির পৃথিবীর কাছে তেমন কিছুই চাওয়ার ছিলো না। কেবল মৃত্যু নিয়ে তার একটি আকাঙ্ক্ষা ছিলো। মহান প্রভুর কাছেই তিনি সেটি খুলে বলেছিলেন-
কোন এক ভোরবেলা, রাত্রি শেষে শুভ শুক্রবারে
মৃত্যুর ফেরেস্তা এসে যদি দেয় যাওয়ার তাকিদ
অপ্রস্তুত এলোমেলো এ গৃহের আলো অন্ধকারে
ভালোমন্দ যা ঘটুক মেনে নেবো এ আমার ঈদ।
কী সুন্দর চাওয়া! কত মহিমান্বিত মোনাজাত!
মহান প্রভু তার এই দোয়া কবুল করেছিলেন। তাঁর পরপারে যাত্রার জন্য নির্ধারণ করেছিলেন মহিমান্বিত জুমাবারের প্রথম প্রভাতটিকেই। ২০১৯ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি জুমাবার খুব সকালে কবি আমাদের সবাইকে কাঁদিয়ে, তাঁর অকৃত্রিম বন্ধু পৃথিবীকে কাঁদিয়ে চলে গেছেন অন্য আরেক জগতে; বৃক্ষের ছায়া, পাখিদের গান আর ফুলে ফুলে সুশোভিত জান্নাতে।