
প্রখ্যাত ভাষা সৈনিক আবদুল গফুর মারা গিয়েছেন। গত ২১ সেপ্টেম্বর দুপুর ২টা ৪৩মিনিটে তিনি ঢাকার আজগর আলী হসপিটালে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিলো ৯৫বছর।
অধ্যাপক আবদুল গফুর ১৯৪৫ সালে স্থানীয় মইজুদ্দিন হাই মাদরাসা থেকে মাধ্যমিক ও ১৯৪৭ সালে বর্তমান কবি নজরুল সরকারি কলেজ (সাবেক ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজ) থেকে উচ্চমাধ্যমিক সম্পন্ন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৭২ সালে কলেজের নামকরণ হয় কবি নজরুল ইসলাম সরকারি কলেজ। এটি দেশের একটি প্রাচীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে তখন ছাত্র সংখ্যা কম ছিল। অবশ্য তখন লেখাপড়ার হারও কম ছিল। তিনিসহ এ বিভাগে তখন মাত্র তিনজন শিক্ষার্থী ছিলেন। অন্য দু’জন হলেন নুরুল ইসলাম পাটোয়ারী ও মমতাজ বেগম।
ভাষা আন্দোলন শুরু হলে আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে তিনি অংশ নেওয়ার ফলে লেখাপড়ায় কিছুটা ব্যাঘাত ঘটলেও ১৯৬২ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
অধ্যাপক আবদুল গফুর ছিলেন সাংবাদিক। তিনি এই পেশার সাথে যুক্ত ছিলেন মৃত্যুর মাত্র কয়েক বছর আগে পর্যন্ত।
ছাত্র হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। ১৯৪৫ সালে প্রবেশিকা মানের পরীক্ষায় তিনি বাংলা ও আসামের মধ্যে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। ১৯৪৭ সালে ঢাকার গভর্নমেন্ট ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় নবম স্থান অধিকার করেন। এরপর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার এক মাসের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক আবুল কাসেমের নেতৃত্বে তমদ্দুন মজলিস নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। মহান ভাষা আন্দোলনের স্থপতি হিসেবে এই সংগঠনের সঙ্গে তিনি সংযুক্ত হয়ে পড়েন তখনই। সংগঠনে আরো যারা ছিলেন, তাদের মধ্যে অধ্যক্ষ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, শাহেদ আলী, সানাউল্লাহ নূরী, আসকার ইবনে শাইখ প্রমুখ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ পর্যন্ত ভাষা আন্দোলনকে বলা হয় ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার সূচক আন্দোলন। বলা হয়, এই আন্দোলনের অনুপ্রেরণায় ৬২, ৬৯-এর আন্দোলন অতিক্রম করেই আসে ৭১-এর স্বাধীনতা সংগ্রাম। এরই পরিণতি স্বাধীন বাংলাদেশ। অধ্যাপক আবদুল গফুর শুধু ভাষা আন্দোলনের সংগঠক ও নেতাই ছিলেন না; বরং ভাষা আন্দোলনের মুখপাত্র তমদ্দুন মজলিস থেকে প্রকাশিত ‘সৈনিক’ পত্রিকার সহকারী সম্পাদক ও পরবর্তীতে সম্পাদকও ছিলেন। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৬ পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন। আবদুল গফুর ছাত্রাবস্থাতেই ১৯৪৭ সালে পাক্ষিক জিন্দেগিতে সাংবাদিক হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৫৭ সালে দৈনিক মিল্লাত ও ১৯৫৮ সালে দৈনিক নাজাত পত্রিকায় সহকারী সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭১ সালের মে থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত তিনি দৈনিক আজাদ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। এরপর ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত ইংরেজি দৈনিক পিপল, ১৯৭৯ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত দৈনিক দেশ পত্রিকার সহকারী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৬ সালে দৈনিক ইনকিলাব প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি তখন থেকে পত্রিকাটির ফিচার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। অসুস্থ হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি সেখানেই কাজ করেন।
অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুল গফুর ১৯৫৯ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের দারুল উলুম (ইসলামিক একাডেমি)-এর সুপারিন্টেন্ডেন্ট হিসেবে কাজ করেন। পরবর্তীতে এক বছর চট্টগ্রামে জেলা যুব কল্যাণ অফিসার হিসেবে কাজ করেন। ১৯৬৩ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ফরিদপুরের সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ এবং ১৯৭২ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত আবু জর গিফারী কলেজে শিক্ষকতা করেন। ১৯৮০ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের প্রকাশনা পরিচালক ছিলেন।
পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠন তমদ্দুন মজলিস পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর প্রথম বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার দাবি তোলেন। এসময় এর প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবুল কাসেমের সাথে অগ্রণী সহযোগীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আবদুল গফুর। ১৯৪৮ সালের ১৪ নভেম্বর তমদ্দুন মজলিসের বাংলা মুখপত্র সাপ্তাহিক সৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হলে অধ্যাপক আবদুল গফুর প্রথমে এর সহ-সম্পাদক ও পরে সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৫১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সৈনিক পত্রিকার বিশেষ সংখ্যার শিরোনাম ছিল ‘শহীদ ছাত্রদের তাজা রক্তে ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত, মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলে ছাত্র সমাবেশে পুলিশের নির্বিচারে গুলিবর্ষণ’। ফলশ্রুতিতে ২৩ ফেব্রুয়ারি পুলিশ পত্রিকাটির অফিস অবরোধ করে সম্পাদক অধ্যাপক আবদুল গফুর ও প্রকাশক আবুল কাসেমকে গ্রেফতার করে। ভাষা আন্দোলন ছাড়াও তিনি পাকিস্তান আন্দোলন ও স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন।
অধ্যাপক আবদুল গফুর একজন লেখক হিসেবেও নাম করেছেন। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হচ্ছে- ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও ইসলাম, বিপ্লবী উমর, কর্মবীর সোলায়মান, কোরআনী সমাজের রূপরেখা, খোদার রাজ্য, ইসলাম কী এ যুগে অচল, সমাজকল্যাণ পরিক্রমা, ইসলামের জীবন দৃষ্টি, রমজানের সাধনা, ইসলামের রাষ্ট্রীয় ঐতিহ্য, আসমান জমিনের মালিক, শাশ্বত নবী, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম, বাংলাদেশ আমার স্বাধীনতা, স্বাধীনতার গল্প শোনো, আমার কালের কথা (স্মৃতিচারণমূলক, ২০০০)। আলোর দিশারী এই মানুষটি ভাষা আন্দোলনে অবিস্মরণীয় ভূমিকা রাখায় ২০০৫ সালে রাষ্ট্রীয় সম্মান একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন। ০