গল্পটা আবেদীন পরিবারের। এই পরিবারের যে বংশ-বৃক্ষ তাতে আছে শাখা-প্রশাখা। বাবা-মা সংসারের ঘানি টানায় ব্যস্ত। কথা বলেন কম। ঘরটা মাতিয়ে রাখে কিশোর আবরার। স্কুলের গলি পেরুবার অপেক্ষায় আছে ও। মাথায় তার হাজারো প্রশ্ন। সকাল-সন্ধ্যায় প্রশ্ন আর প্রশ্ন। প্রশ্নবানে বাবা-মা ত্যক্ত বিরক্ত। আবরারকে বকুনি থেকে রক্ষা করতে মাঝে মাঝে এগিয়ে আসে ভার্সিটি পড়ুয়া বড় ভাই ইয়ামিন আবেদীন। ইয়ামিন জেনারেশান গ্যাপটা বুঝতে পারে। তাই মৃদু হেসে বলে, বাবা আবরার তো অন্যায় কিছু করছে না, শুধু প্রশ্নটা একটু বেশি করে। বাবা শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন, ওর কি কোনো সময় জ্ঞান থাকতে নেই? ও তো এখন বড় হচ্ছে, কখন কী বলতে হয় তা তো ওকে জানতে হবে। আজকের ঘটনাটাই দেখো, অফিস থেকে ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে বাসায় ঢুকেছি মাত্র, কই এক গ্লাস ঠান্ডা পানি দেবে, ব্যাগটা হাত থেকে নেবে- না, ওসবের কোনো খবর নেই। কি করলো জানো, চড়া গলায় বললো- বাবা এসব কী হচ্ছে? পাকিস্তানের মাটিতে পাকিস্তানকে হারিয়ে এসে এখন এটা কী করলো বাংলাদেশ ক্রিকেট দল? আমি ওর এভাবে রেগে যাওয়ার কারণটা ঠিক বুঝতে পারলাম না। ইয়ামিন শান্ত গলায় বললো- বাবা তুমি তো ক্রিকেট দেখার সময় পাও না; বাংলাদেশ আজ ভারতের মাটিতে ভারতের কাছে বাজেভাবে হেরেছে। এটা সহ্য করতে পারছে না আবরার। কিশোর মন তো, দেশের প্রতি ওর আবেগটা একটু বেশিই। আমায় দেখো পরাজয়টা কীভাবে হজম করে নিয়েছি। আমি উপলব্ধি করেছি যে, যোগ্যতার কোনো বিকল্প নেই। আবেগ দিয়ে নয়, ভালো খেলেই ভারতকে হারাতে হবে।
ইয়ামিনের কথা শুনে বাবা মৃদু হাসেন এবং বললেন, তাহলে তো বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের আগ পর্যন্ত আমাকে আবরারের জ্বালাতন সহ্য করেই যেতে হবে? এছাড়া তো অন্য কোনো উপায় নেই বাবা, স্কুলে থাকতে আমি কি কম জ্বালিয়েছি তোমাকে? কতশত প্রশ্ন করেছি। হুম… বলে আবারও মৃদু হাসলেন বাবা।
আবেদীন পরিবারের কথামালা আপাতত শেষ হলো। তবে এর রেশ বোধহয় সহজেই কাটবে না। কারণ পাশের কক্ষ থেকে দাদা আফতাব আবেদীন নাতিদের কথাবার্তা ঠিকই শ্রবণ করেছেন। তিনি মোক্ষম সময়ের অপেক্ষায় আছেন। স্বল্প সময়ে ইতিহাসমনষ্ক দাদার কথা শেষ হবার নয়। ডিনারের পর রাতের আসরটা আজকে তিনিই শুরু করবেন বলে স্থির করে নিয়েছেন। আসরের শুরুতেই একটা ভূমিকা টানলেন আবেদীন পরিবারের সিনিয়র সদস্য আফতাব আবেদীন। বললেন, তোমাদের ক্রিকেট আলাপের বর্ণমালা কর্ণে প্রবেশ করেছে। তোমাদের আলাপটা ছিল খণ্ডিত। আবেগ দিয়ে নয়, ভালো খেলেই ভারতকে হারাতে হবে। এখানে ভুল নেই। কিন্তু বাংলাদেশ কি ভারতকে হারায়নি? কয়েকবারই হারিয়েছে। তবে পরিসংখ্যানই সব নয়, বিবেচনা করে দেখার মতো আরও অনেক বিষয় রয়েছে। অধ্যাপক দাদুর কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছিল আবরার ও ইয়ামিন। দাদু বললেন, ভারতের জনসংখ্যা কত জানো- প্রায় দেড়শ কোটি। বাংলাদেশে প্রায় ২০ কোটি। ভারতের রয়েছে নানা বর্ণ, ভাষা ও নৃতাত্তি¡ক বৈশিষ্ট্য। ভারতে দেড়শ কোটি মানুষের বিশাল জনগোষ্ঠী থেকে গড়ে তোলা হয় ক্রিকেট টিম।
সেই তুলনায় খুবই সীমিত পরিসর থেকে টিম বাছাই করার সুযোগ পায় বাংলাদেশ। এ তো গেলো বাছাইয়ের কথা। ক্রিকেটে আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে, যেমন- প্রশিক্ষণ, খেলোয়াড়দের বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধা, উন্নত ব্যবস্থাপনা, অর্থনৈতিক সামর্থ্য; এসব ব্যাপারে ভারত বাংলাদেশ থেকে অনেক এগিয়ে আছে।
তাই বলা চলে ভারতের সাথে বাংলাদেশের ক্রিকেট ম্যাচ অনেকটা অসম যুদ্ধের মতোই। বিশ্লেষণে গেলে বলতে হয়, বাংলাদেশ ভালোই খেলছে। আর বলে রাখা ভালো যে, ক্রিকেটেও ‘মারেফাত’ আছে, ড্রেসিংরুমের রহস্য আছে। আসলে আমি বলতে চাইছি, ক্রিকেট খেলার সবকিছুই দৃশ্যমান নয়, আছে অদৃশ্য নানা বিষয়ও। সেসব বোঝার বয়স এখনও তোমাদের হয়নি। বল তো পাকিস্তানের মাটিতে যে পাকিস্তানকে হারিয়ে আসলো বাংলাদেশ, সেই পাকিস্তানই বিশ্বকাপে ভারতকে ১০ উইকেটে হারালো কেমন করে, এর ব্যাখ্যা কী? এখনই জবাব দেওয়ার প্রয়োজন নেই, মাথা গরম হয়ে যাবে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে যদি জ্ঞানও বাড়ে তাহলে এসব বিষয়ের ব্যাখ্যা নিজেরাই দিতে পারবে। আবরার ও ইয়ামিন দাদুর খুবই ফ্যান। বলেন চমৎকার তথ্য ও তত্ত্বের যৌক্তিক রসায়ন। অবসর নিলেও অধ্যাপনার অভ্যাসটা দাদুর এখনও রয়ে গেছে।
আসরে কথা বললেও দাদু চোখ রাখেন সবার ওপর। লক্ষ করলেন বারবার ফোন আসলেও রিসিভ করছে না ইয়ামিন। কেমন যেন উশখুশ করছে। এমন তো কখনও হয়নি। ব্যাপারটা বেশ রহস্যজনক। দাদু মনে মনে ভেবেছিলেন ক্রিকেটের পর আজ ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, পাকিস্তান আন্দোলন ও ভাষা আন্দোলন নিয়ে কথা বলবেন। কারণ, দাদু আফতাব আবেদীন বিশ্বাস করেন, ইতিহাসের ভিতটা পোক্ত না হলে জাতির বড় ইমারত গড়ে তোলা যায় না। কিন্তু ইয়ামিনের উশখুশ ভাব দেখে উপলব্ধি করলেন, আজ আসর আর জমবে না। অতএব এখন আসর ভঙ্গ করাই উত্তম। তবে ওঠার আগে ফোঁড়ন কেটে বললেন, আমাদের ইয়ামিন কিন্তু এখন বেশ বড় হয়ে গেছে, আমাদের সামনে ফোন ধরতে লজ্জা পায়। কী দাদু, ওপারে কে ছিল? ইয়ামিন লজ্জা পেয়ে মৃদু কণ্ঠে বললো, সেরকম কিছু না। দাদু ভাবতে লাগলেন সেরকম কিছু না তবে কীরকম কী?
ইয়ামিনকে কে ফোন করলো, বিশ্ববিদ্যালয়ে ও সারাদিন কী নিয়ে ব্যস্ত থাকে, তা তেমন স্পষ্ট নয় আবেদীন পরিবারের কাছে। মা-বাবা তো কিছুই জানেন না, এমনকি দাদুও নন। তবে ইয়ামিনের অন্যমনষ্কতা ও কিছুটা লুকোচুরিভাব দাদুর নজর এড়ায়নি। আফতাব আবেদীন সরাসরি প্রশ্ন করতে চাননি ইয়ামিন আবেদীনকে। কারণ আবেদীন পরিবারের থটফুল পরিবেশে সবাই মুক্ত। স্বাধীনভাবে নিজের মতামত প্রকাশ করতে পারে সবাই। ফ্যাসিবাদী সমাজের মতো এখানে দমন-অবদমনের কোনো বালাই নেই। তবুও ইয়ামিন এমন করছে কেন? ওর চোখ যেন কিছু বলতে চাইছে, কিন্তু মুখে কথা নেই। মাথার চুলগুলোও পরিপাটি নয়, এলোমেলো আজকাল। এমন ভাবনার মধ্যে এশার নামাজটা সেরে টিভি অন করলেন দাদু। খবর দেখে তো বিস্মিত দাদু।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে ছাত্র-ছাত্রীদের কোটাবিরোধী আন্দোলন। আন্দোলন দমনে নেমেছে সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠন ও পুলিশ প্রশাসন। ওদের হাতে অস্ত্র। চলছে গুলি ও টিয়ার গ্যাস। নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের ওপর বেপরোয়া হামলায় ক্ষোভে ফেটে পড়েছে সারাদেশের ছাত্র-জনতা। খবর দেখতে দেখতেই দাদু উচ্চস্বরে জিজ্ঞেস করলেন, ইয়ামিন কোথায়, ও বাসায় আছে তো? আবরার কাছে এসে বললো, ভাইয়া তো বাসায় আসেনি। এতো রাতেও বাসায় আসেনি? রাত গভীর হলো, অপেক্ষা দীর্ঘ হলো, কিন্তু রাতে আর বাসায় ফিরলো না ইয়ামিন। সে রাতে আবেদীন পরিবারের কারো চোখেই ঘুম নেই। যথারীতি পূবের আকাশে উদিত হলো লাল সূর্য, পাখির কণ্ঠে কিচির-মিচির শব্দ। আবেদীনরা অপেক্ষায় আছে, হয়তো এখনই বেজে উঠবে কলিং বেলটা। না, কলিং বেলটা আর বেজে উঠলো না। তবে মোবাইল বেজে উঠলো। ওপাশ থেকে ছাত্রনেতার কণ্ঠ- সালাম জানিয়ে বললো- গুলিতে আহত ইয়ামিন একটি ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন আছে। কোথায়? পরে জানাবো বলেই লাইনটা কেটে দিলো। নিরাপত্তার কারণে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা এখন গোপনীয়তা রক্ষা করছে। সব কুয়াশাই এখন কেটে গেল। ইয়ামিনের গত কয়েকদিনের আচরণটাও এখন দাদুর কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠলো। মনে মনে ভাবলেন, ইয়ামিন আসলেই বড় হয়ে গেছে। ও আমাদের সাথে সময় কাটালো, গল্প করলো, কিন্তু আমাদের কাউকে বুঝতেই দিলো না যে ও ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের একজন সৈনিক। বিপ্লবীরা এমনই হয়, নিরবে কাজ করে যায়। মায়ের প্রশ্ন, ও বেঁচে আছে তো? দাদুর চোখে তখন অশ্রু, মুখে কোনো কথা নেই। অধ্যাপক আফতাব আবেদীন মনে মনে প্রস্তুত ছিলেন। সকালেই ফোনে বলা হলো, আহত আরও অনেকের সাথে ইন্তেকাল করেছেন ইয়ামিনও। বেলা বারোটায় শহিদদের জানাজা হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। আবেদীন পরিবার আজ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। জানাজার আগে আবেদীন বংশ-বৃক্ষের প্রধান আফতাব আবেদীন বললেন, আমাদের বংশ-বৃক্ষের একটি ফুল ঝরে গেল, একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামেও ঝরে গেছে এই বংশের বহু ফুল। পতাকা হাতে আমরা তখন অনেক খুশি হয়েছিলাম। ১৬ ডিসেম্বর পালন করেছিলাম মহান বিজয় দিবস। কিন্তু আমাদের বিজয়ের লক্ষ্যে পৌঁছতে দেয়নি ফ্যাসিবাদী শাসন। তাই আমরা আবার লক্ষ করলাম ছাত্র-জনতার নতুন গণ-অভূত্থান। নাতি-পুতিদের নতুন বাংলাদেশে বিজয়ের স্বপ্ন পূরণ হলে স্বার্থক হবে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম। জানাজা শেষে ঘরের দিকে পা বাড়ালো আবেদীন পরিবার। পেছনে রয়ে গেল ইয়ামিনের স্মৃতিঘেরা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। ০