১৪ মার্চ রোববার এবারের পাই দিবস

মো: সা’দাদ রহমান

0
73

বৃত্ত আমাদের সবারই চেনা।
বৃত্তের একদম মাঝখানে থাকে এর কেন্দ্র। আর কেন্দ্র থেকে সমান দূরত্বে থেকে এর চারপাশের যে পথরেখা, সেটি হচ্ছে বৃত্তের পরিধি বা সারকামফারেন্স। অপরদিকে কেন্দ্র থেকে পরিধি পর্যন্ত বিস্তৃত সরল রেখার নাম ব্যাসার্ধ বা রেডিয়াস।
আমরা ছোট বা বড় যেকোনো আকারের একটি বৃত্ত নিয়ে এর পরিধির পরিমাপকে এর ব্যাসার্ধের পরিমাপ দিয়ে ভাগ করলে সব সময়েই দেখা যায়, এর মান দাঁড়ায় ২২/৭। এর অর্থ, আমরা যদি ৭ সেন্টিমিটার দীর্ঘ একটি ব্যাসার্ধ নিয়ে একটি বৃত্ত আঁকি, তবে এর পরিধির দৈর্ঘ্য হবে ২২ সেন্টিমিটার। একইভাবে ৭ ইঞ্চি দীর্ঘ ব্যাসার্ধের বৃত্তের পরিধি হবে ২২ ইঞ্চি। আরো বড় আকারের ব্যাসার্ধ, ধরা যাক ৭ মাইল দীর্ঘ ব্যাসার্ধ নিয়ে বৃত্ত আঁকলে এর পরিধির দৈর্ঘ্য হবে ২২ মাইল। ছোট বড় সব বৃত্তের ক্ষেত্রে পরিধিকে এর ব্যাসার্ধ দিয়ে ভাগ করলে মান সব সময় এই ২২/৭ হবে। এ মানের কোনো পরিবর্তন হবে না। অর্থাৎ এটি একটি ধ্রুব সংখ্যা বা কনস্ট্যান্ট নাম্বার। এর নাম দেয়া হয়েছে ‘পাই’ (π)। আর এই π হচ্ছে গ্রিক বর্ণমালার ষোলতম অক্ষর।

এই π-এর মান ২২/৭ কে দশমিক ভগ্নাংশ আকারে প্রকাশ করতে চাইলে আমাদেরকে ২২ কে ৭ দিয়ে ভাগ করতে হবে। তখন আমরা দেখতে পাব মজার এক ঘটনা: দশমিকের পর যত ঘর পর্যন্তই
আমরা ভাগ করতে যাই না কেনো,
এর কোনো শেষ পাওয়া যায় না।
দশমিক ভগ্নাশে এর মান দাঁড়ায় ৩.১৪১৫৯২৬৫৩৫…………….। সাধারণত দুই দশমিক স্থান পর্যন্ত এর মান হচ্ছে ৩.১৪। শিক্ষার্থীরা এই মান ব্যবহার করেই বিজ্ঞানের নানা হিসাব নিকাশ করে থাকে।
সে যা-ই হোক বিজ্ঞান জগতের এই অবাক করা ধ্রুব সংখ্যাটি আবিষ্কার হয় প্রায় ৪ হাজার বছর আগে। আর এর প্রথম ক্যালকুলেশন করেন গণিতবিদ আর্কিমিডিস (২৮৭Ñ২১২ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ)।
০২.
বিজ্ঞানের ছাত্রমাত্রই জানে, এই ২২/৯ বা ৩.১৪ হচ্ছে গণিতের এক অবাক করা সংখ্যা। একটু আগেই জেনেছি, এই সংখ্যাটিকে প্রকাশ করা হয় গ্রিক বর্ণমালার ষোলতম অক্ষর π দিয়ে। তাই ‘পাই’ বলতে আমরা ২২/৯ বা ৩.১৪ সংখ্যাটিকেই বুঝি। আর এ-ও জেনেছিÑ এটি একটি ধ্রুব সংখ্যা, যার মান সব সময় একই, এর ভিন্ন কোনো মান নেই।
এই অবাক করা ধ্রুবসংখ্যাটির সদর্প উপস্থিতি রয়েছে গণিতের বা বিজ্ঞানের বহু সূত্রে। জ্যামিতির কয়েকটি সূত্রে এর ব্যবহারের উদাহরণ হচ্ছে :
বৃত্তের ক্ষেত্রফল = π দ্ধ (ব্যাসার্ধ) ২ বর্গ একক
গোলকের তলের ক্ষেত্রফল = ৪ π দ্ধ (ব্যাসার্ধ) ২ বর্গ একক
কোণকের বক্রতলের ক্ষেত্রফল = π দ্ধ (ব্যাসার্ধ) ২ দ্ধ দৈর্ঘ্য বর্গ একক
কোণকের সমগ্রতলের ক্ষেত্রফল = π দ্ধ ব্যাসার্ধ (দৈর্ঘ্য + ব্যাসার্ধ) বর্গ একক
গোলকের আয়তন = ৪/৩ π দ্ধ (ব্যাসার্ধ) ৩ ঘন একক
কোণকের আয়তন = ১/৩ π দ্ধ (ব্যাসার্ধ) ২ দ্ধ উচ্চতা ঘন একক
এবং এমনি আরো অনেক সূত্র।
এ ছাড়ও পদার্থ বিজ্ঞান ও উচ্চতর গণিতের অসংখ্য সূত্রে এই π-এর উপস্থিতি সত্যিই আমাদের অবাক করে। এ নিয়ে অব্যাহতভাবে চলছে নানামাত্রিক গবেষণা। সেই সূত্রে আমরা জানতে পারছি এর নতুন নতুন মজার তথ্য। একই সাথে প্রকৃতিও সময়ে সময়ে উদঘাটন করে চলেছে তেমনি কিছু মজার তথ্য। এই তো ২০২০ সালে গবেষক জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা আমাদের সৌরজগতের বাইরে আবিষ্কার করেছেন পৃথিবীর সমান আকারের নতুন একটি গ্রহ। এই গ্রহ প্রতি ৩,১৪ দিনে একটি তারাকে প্রদক্ষিণ করে চলেছে। এই গ্রহটির আনুষ্ঠানিক নাম ক২-৩১৫ন হলেও এটি এখন সমধিক পরিচিতি পেয়েছে ‘পাই আর্থ’ নামে।

০৩.
এভাবে গণিতের ‘পাই’ নামের এই সংখ্যাটি হয়ে উঠেছে বিশ্বব্যাপী গণিতপ্রেমীদের অন্যতম আকর্ষণীয় এক বিষয়। এদের আগ্রহ পাই-এর নতুন নতুন মজার তথ্য এবং এর বৈজ্ঞানিক, বিশেষত এর গাণিতিক সৌন্দর্য উদঘাটনের ব্যাপারে। এখন বিশ্বের প্রায় সবখানে ঘটা করে প্রতিবছর পালন করা হচ্ছে ‘পাই দিবস’। প্রতিবছর ১৪ মার্চে পালন করা হয় এই দিবস। যেমন: এবার সারা বিশ্বে ১৪ মার্চ রোববার পালিত হতে যাচ্ছে এই পাই দিবস।
প্রতি বছর ১৪ মার্চকে কেনো বেছে নেয়া হলো ‘পাই দিবস’ হিসেবে? আমরা জানি দুই দশমিক স্থান পর্যন্ত পাই-এর মান ৩.১৪। এখানে দশমিকের আগের সংখ্যা ৩-কে বিবেচনা করা হয় মাস নির্দেশক সংখ্যা। যেহেতু বছরের ৩ নম্বর মাস হচ্ছে মার্চ, তাই মার্চ মাসেই এই দিবস পালনের সিদ্ধান্ত হয়। আর দশমিকের ডানের সংখ্যা ১৪ থাকায়, প্রতিবছর মার্চ মাসের ১৪ তারিখে ‘পাই দিবস’ পালনের নিয়মটা চালু হয়ে গেছে।
০৪.
ইতিহাস থেকে জানা যায়Ñ আনুষ্ঠানিকভাবে বড় আকারে বিশ্বে প্রথম পাই দিবস পালিত হয় ১৯৮৮ সালে। আর এর আয়োজনে ছিলেন ল্যারি শ’। তিনি তা আয়েজন করেন স্যানফ্রানিসকো এক্সপ্লোরেটরিয়ামে। তখন তিনি সেখানে কর্মরত ছিলেন একজন পদার্থবিদ হিসেবে। সেদিন তিনি ও তার স্টাফেরা এই এক্সপ্লোরেটরিয়ামের চারপাশের বৃত্তাকাার পথে একটি জনমিছিল বের করেছিলেন। সেদিন সেখানে ‘ফ্রুট পাই’ খাওয়ার আয়োজনও ছিল। সেই এক্সপ্লোরেটরিয়াম আজো প্রতিবছর এই পাই দিবস পালন অব্যাহত রেখেছে।
২০০৯ সালের ১২ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের ‘প্রতিনিধি পরিষদে’ পাস হয় একটি ‘নন-বাইন্ডিং রেজুলেশন’। এই প্রস্তাবে সে দেশে ১৪ মার্চকে ‘জাতীয় পাই দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। ২০১৯ সালের নভেম্বরে জাতিসঙ্ঘের ৪০তম সাধারণ সম্মেলনে পাই দিবসকে ‘আন্তর্জাতিক গণিত দিবস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত হয়।
২০১৪ সালে পুরো মার্চ মাসটি পালিত হয় ‘পাই মাস’ হিসেবে। আর ২০১৫ সালে ১৪ মার্চ পালিত হয় ‘সুপার পাই ডে’। এই দিবসটি পালনের একটি গুরুত্ব ছিল। সেবার এই তারিখটি লেখা হয় মাস/দিন/বছর ফরম্যাটে এভাবে: ৩/১৪/১৫। তারিখের এই সংখ্যাগুলোর সাথে সেদিনের সকাল ৯টা ২৬ মিনিট ৫৩ সেকেন্ডের সংখ্যাগুলো পাশাপাশি বসিয়ে আমরা পাই ৩১৪১৫৯২৬৫৩। এখানে প্রথমে থাকা ৩-এর পর একটি দশমিক বিন্দু বসালে দাঁড়ায় ৩.১৪১৫৯২৬৫৩, যা আসলে ৯ দশমিক স্থান পর্যন্ত π-এর মান।
অপরদিকে সাধারণ ভগ্নাংশে π-এর মান যেহেতু ২২/৭. তাই ৭-কে মাসসংখ্যা ও ২২-কে তারিখ সংখ্যা বিবেচনা করে প্রতিবছর ২২ জুলাই পালিত হয় ‘পাই অ্যাপ্রক্সিমেশন ডে’।
০৫.
আমাদের দেশে আমরাও ‘পাই দিবস’ সহজেই পালন করতে পারি। শিশুকিশোর সংগঠনগুলো এই দিবস আয়োজনের মাধ্যমে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে π সম্পর্কে নানা তথ্য জানার সুযোগ করে দিতে পারে। আলোচনার মাধ্যমে π-এর পরিচয় ও এর প্রয়োগ ক্ষেত্রগুলো তুলে ধরা যেতে পারে। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মাঝে π সম্পর্কে জানার আগ্রহ বাড়িয়ে তোলা সম্ভব। এ লক্ষ্যে আয়োজন করা যেতে পারে আলোচনা অনুষ্ঠান। আয়োজন করা যেতে পারে π-এর তথ্যভিত্তিক শিশুকিশোর প্রতিযোগিতা। π সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে ‘পাই পদযাত্রা’ করা যায়। আয়োজক সংগঠনগুলো ওই দিনে π-সংশ্লিষ্ট নানা তথ্য তুল ধরে বিভিন্ন উপহারসামগ্রী, যেমন মগ, গেঞ্জি, ব্যাগ ও শিক্ষাসামগ্রী বিক্রির ব্যবস্থা করতে পারে। এখন π নাম বহন করে এমন অনেক খাবার সমাজে চালু আছে। পাই দিবসে এসব খাবারের আয়োজন করে খাবারের মাধ্যমে π সম্পর্কে সাধারণ মানুষের কাছে নানা মজার মজার তথ্য পৌঁছে দেয়া সম্ভব। সারা বিশ্বে আজ কিভাবে কারা এই পাই দিবস পালন করছে, তা থেকে ধারণা নিয়ে আমরাও আমাদের মতো করে পাই দিবস পালনের কর্মসূচি তৈরি করতে পারি। গণিতপ্রেমী মানুষের মাঝে ‘পাই দিবস’ পালন সে এক অন্য রকম মজা।