সাফিরের অদম্য ইচ্ছা

- মীম মিজান

0
48

হরতলির একটি বাসায় বাস করেন নীরব ও মেহেনাজ দম্পতি। নীরব পেশায় একজন সাংবাদিক। আর হেনাজ কলেজের প্রভাষক। এই দম্পতির একমাত্র সন্তান সাফির সাদিক। ১২ বছর বয়স তার। কেজি ফাইভের ফার্স্টবয়। সাফির তাদের টিনশেড বাসার দক্ষিণা জানালা খুললেই একটি আমবাগান দেখতে পায়। দোয়েল পাখি শিষ দেয় বাগানে। কয়েকটি ময়না পাখি ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ করে উড়ে গিয়ে এ ডালে ও ডালে বসে। বাগানের গাছগুলো খুব বড় নয়। তবে যখন আম ধরে ছোট ছোট এই গাছগুলো ভরে যায় আমে। আর আমের ভারে প্রায় মাটি ছুঁইছুঁই করে গাছের ডালগুলি। আমগাছগুলোর উত্তর পাশ ঘেঁষে এক চিলতে ফাঁকা জায়গা আছে। বাগানের মালিক আব্দুল খালেক। বেশ শৌখিন মানুষ। তার শখ বাগানের পাশাপাশি সবজির চাষ করার। তাই সেই চিলতে ফাঁকা জায়গায় ঝিঙে, কুমড়ো ও শসা চাষ করা শুরু করেছেন তিনি।
ঝিঙে, কুমড়ো ও শসার জন্য তিনি সেখানে একটি মাচান করেছেন। সাদা রঙের ঝিঙে ফুল ও হলদে রঙের কুমড়ো ফুলে ভরে যায় চিলতে জায়গার মাচানটি। ফুল ফোঁটার পর মাচানটিতে ঝুলতে থাকে ঝিঙে ও কুমড়ো। ঝিঙেগুলো তেমন ভারি নয়। কিন্তু কুমড়োগুলো ভারি। আর সেই কুমড়োর ভারে মাচানটি ভগড়বপ্রায়। আব্দুল খালেক ভালো মনের মানুষ। তিনি ঝিঙে ও কুমড়োগুলো মাচান থেকে তুলে নিজেদের জন্য কিছু রেখে অবশিষ্টাংশ প্রতিবেশীদের মাঝে বিলিয়ে দেন।
ঝিঙে ও কুমড়োর মওসুম শেষে শসার লকলকে ডাল ও কচিপাতায় ভরে যায় মাচানটি। শসার সাদা সাদা কচি ফুল আর সবুজের সমারোহে মাচানটি মনোহর রূপ ধারণ করে। সাফির বার বার জানালা খুলে সেই দৃশ্য দেখে আর আপ্লুত হয়। ‘আম্মু দেখো, কত সুন্দর সাদা সাদা শসাফুল!’ ‘জি বাবা, শসাফুলগুলো অনেক সুন্দর! সুবহানাল্লাহ!
সাফির, তুমি কি ভুলে গেছো যে সুন্দর কোনো কিছু দেখলে সুবহানাল্লাহ বলতে হয়?’
‘ওহহো! আম্মু, আমি তো ভুলেই গেছিলাম। আল্লাহ এত সুন্দর শসাফুল সৃষ্টি করেছেন! সুবহানাল্লাহ!’
‘সাফির, এই শসাফুলগুলোর আগেও তো এখানে কুমড়ো ও ঝিঙেফুল ফুটেছিল। কেন, সেগুলো কি সুন্দর ছিল না?’
‘আম্মু, ওই ফুলগুলোও তো অনেক সুন্দর ছিল। আসলে আল্লাহ তায়ালার প্রত্যেকটি সৃষ্টিই অনেক সুন্দর ও নিখুঁত।’ বিকেলবেলা বাসার সামনে ফাঁকা জায়গায় সাফির তার বন্ধু বুলেট ও অন্যদের সাথে খেলছিল। পাশের বাসার রানা হাতে কিছু আমড়া নিয়ে আসে। রানা সেই আমড়াগুলো সবাইকে খেতে দেয়। ‘কিরে রানা, এই আমড়া কই পেলি? তোদের তো কোনো আমড়াগাছ নেই।’ বুলেটের জিজ্ঞাসা। ‘আমি এই আমড়াগুলো হানিফদের গাছ থেকে চুপ করে ছিঁড়েছি। ওরা কেউই টের পায়নি।’ রানার উত্তর। রানার কথা শুনে সবাই হো হো করে হেসে ওঠে। পরদিন বিকেলবেলা সাফির স্কুল থেকে ফেরার পর বাসার সামনের সেই ফাঁকা জায়গায় রানা ও অন্য বন্ধুদের সাথে খেলতে থাকে।
বুলেট পলিথিনে করে অনেকগুলো পেয়ারা নিয়ে আসে। সাফির, রানাসহ অন্যদেরকে সেই পেয়ারা ভাগ করে দেয়। সবাই মজা করে পেয়ারা খাচ্ছিল। বুলেট একটু গর্বের সুরে বলে ওঠে, ‘নুহুরা কেউ বাসায় নেই। ওরা নানাবাড়ি বেড়াতে গেছে। আমি এই সুযোগে ওদের গাছ থেকে পেয়ারাগুলো চুরি করে আনলাম।’ সবাই হাসিতে মেতে ওঠে আর পেয়ারা চিবোয়। পেয়ারা চিবোতে চিবোতে সাফির বলে ওঠে, ‘আমাদের জানালার পাশে আব্দুল খালেক আঙ্কেল শসা লাগিয়েছেন। শসার মাচানে এখন অনেকগুলো ছোট ছোট শসা এসেছে। তোমাদের আমড়া আর পেয়ারা চুরি করা দেখে আমারো মনে অনেক ইচ্ছে হয় শসাগুলো চুরি করে আনি।’
‘শুধু কি আমরাই চুরি করে খাওয়াব? তুই আনবি না। তা হবে না। তুইও শসা চুরি করে এনে আমাদের খাওয়াবি।’ রানার জোর দাবি।
‘আচ্ছা, আগামীকাল আমি তোদের শসা চুরি করে খাওয়াব।’ সাফির তার বন্ধুদের কাছে এই প্রত্যয় ব্যক্ত করে মনের মধ্যে শসা চুরির এক অদম্য ইচ্ছা লালন করে রাত অতিবাহিত করে। পরদিন স্কুলেও সে অনেক ভেবেছে শসা চুরির পরিকল্পনা নিয়ে। স্কুল থেকে বাসায় ফেরে সাফির। রানা, বুলেটসহ অন্য বন্ধুদের বাসার সামনের ফাঁকা জায়গায় অপেক্ষায় রেখে শসা চুরি করার জন্য চলে যায় সে। হাতে একটি শপিং ব্যাগ। শসার মাচানের কাছে গিয়ে সাইজে বড় ধরনের একটি শসা ছিঁড়তে যাবে সাফির।
আচমকা কী যেন মনে পড়ে তার। শসাটি না ছিঁড়ে ভগড়বপ্রায় মাচানটির মাটিতে পড়ে থাকা দুটো খুঁটি ঠিক করে দিয়ে ফিরে আসে। অধীর আগ্রহে অপেক্ষমাণ রানা, বুলেটসহ অন্য বন্ধুদের কাছে যখন সাফির খালি হাতে ফেরত আসে তখন সবাই মন খারাপ করে। রানা কিছুটা রাগত ও বিস্ময়ের স্বরে জিজ্ঞেস করে, ‘কিরে তুই গেলি শসা চুরি করতে! আর আসলি খালি হাতে! কী ব্যাপার?’ সাফির রানার প্রশেড়বর উত্তরে বলছে, ‘শোন রানা, আমি যখন শসা ছিঁড়তে যাব তখনি আমার আম্মুর একটা কথা মনে পড়ে। আম্মু আমাকে বলেছিল, কারো কোনো কিছু না বলে নেয়া হচ্ছে চুরি। আর চুরি করা অনেক বড় খারাপ কাজ। চুরি করা খাদ্য খেয়ে ইবাদত করলে ইবাদত কবুল হয় না। আর আমি তো নামাজ পড়ি। আল্লাহ তায়ালা তো আমার নামাজ কবুল করবেন না যদি এমন চুরি করা খাবার খাই। আগে যা করেছি ভাই আর আমি এ ধরনের কাজ করব না। আম্মু আরো বলেছেন, কারো উপকার করতে না পারলে যেন ক্ষতি না করি। তাই আমি মাচানের মাটিতে পড়ে থাকা দুটো খুঁটি ঠিক করে দিয়ে এসেছি।’