সরপুঁটির ছোটাছুটি

সেলিম মোশাররফ খান

0
50

ড় নদী থেকে ছোট খালে এসে খুশিতে লাফালাফি করছে সরল। ও বন্ধুদের সাথে ঝাঁক বেঁধে চলে। ছোট বলে সবাই ওকে বেশ আদর করে। সবাই ওর যতœ নেয়। নদীতে ভালো খাবার নেই বলে ওরা এসেছে খালে। ছোটখালে খাবারের অভাব নেই। নানান রকম মজার মজার খাবার রয়েছে এখানে। পোকামাকড়, রেণুমাছ, ছোটপোনা ও গাছের পাতার মিষ্টিরস। আরো কত কী! সরল বন্ধুদের সাথে আজ সারা দিন খেলবে আর মজার মজার খাবার খাবে। ইশ! বড় নদীতে ঘুরতে ঘুরতে তাদের কত দিন অভুক্ত থাকতে হয়েছে, সে সবের হিসেব নেই। দু’এক দিন পর বাবা অথবা মা এক টুকরো খাবার এনে দিয়েছে বৈকি! কিন্তু তাতে কি আর সরলের পেট ভরে, সে এখন আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে না? এখানে সরল নিজেই নিজের খাবার খুঁজে খেতে পারছে। বাবা মাকে কোনো কষ্ট করতে হচ্ছে না। সরল মজা করে এটা ওটা খায় আর বন্ধুদের সাথে ছোটাছুটি করে। মা বলেছে, ছোট খালে খাবার বেশি, কিন্তু বিপদও বেশি। মজার মজার খাবার খাও, ছোটাছুটি করো। কিন্তু সাবধান! পাড়ের দিকে যেও না। গ্রামের লোকজন জাল মেরে তুলে নেবে। শুনেছি, মানুষদের মধ্যে নাকি ভারি অভাব! তারা ছোটমাছও ছাড়ছে না। বটিতে কুটনা কুটে সরাসরি উনুনে তরকারির হাঁড়িতে নিয়ে ফেলছে। উফ! ভাবতেও কি যে ভয় লাগে! সাবধান বাছা আমার! তাছাড়া বড়শীবাজরাও আছে তক্কে-তক্কে! বড়শীতে আটার গোলা, বোলতার ছানা, কেঁচো, চিংড়িমাছ ও নানান ধরনের টোপ দিয়ে খালের পাড়ে বসে থাকে! মজার খাবার-দাবার মনে করে মুখে দিয়েছ তো সর্বনাশ! গলায় বড়শী যাবে গেঁথে আর বড়শীবাজ তোমায় নিয়ে যাবে বাড়ি। বটিতে কুটনা কুটে সোজা যাবে হাঁড়ি। সাবধান বাছা সাবধান!
সরল মন দিয়ে মায়ের সাবধান বাণী শোনে। আর শপথ করে কখনো সে খালের পাড়ে যাবে না। মায়ের কথার অবাধ্য হয়ে নিজের বিপদ নিজেই ডেকে আনবে না। মা-টা বেশি সাবধানী। সব সময় সরলকে চোখে চোখে রাখে। সবার চেয়ে ছোট বলে অন্য ভাইদের থেকে তার কদর বেশি। বাবাটা মায়ের একদম বিপরীত! সারাদিন হাসি আনন্দে মেতে থাকে। একবার এদিকে ছোটে তো আরেকবার ওদিকে! সরলকে পিঠে নিয়ে ঘোরাঘুরি করে। কী যে মজা হয়! বাবার পিঠে চড়ে নীল আকাশ দেখতে সরলের বেশি ভালো লাগে। মা জলের ওপর উঠতে বারণ করেন। কিন্তু বাবার পিঠে থাকলে তিনি নিশ্চিন্তবোধ করেন। তাই বাবা পিঠে নিলেই কেবল সরল আকাশ দেখতে পায়। আহ্ কী সুন্দর! সাদা সাদা মেঘদের ওড়াউড়ি। ঝাঁক বেঁধে পাখিদের ছুটে যাওয়া। সরল উড়ন্ত পাখির কণ্ঠে মিষ্টি গানও শুনতে পায়। সে সবুজ মাঠ দেখে। গরু-বাছুরের ঘাস খাওয়া দেখে। আহা! মনটা আনন্দে ভরে যায় সরলের।
বন্ধুমহলে সরল বেশ সাদাসিধে বলে পরিচিত। তাই সকলে মিলে তার নাম দিয়েছে সরল। বন্ধুরা তাকে খুব ভালোবাসে। সরল পাখিদের গান শুনে একটু-আধটু শিখেছে। বন্ধুরা বায়না ধরলে সে একটু গেয়ে শোনায়। এতে তারা বেশ মজা পায়! খুদে গায়ক হিসেবেও ঝাঁকে তার বেশ সুনাম আছে। সরল ঠোঁট নেড়ে নেড়ে গুনগুন করে গান গায়। আর মাথা ও পাখনা দুলিয়ে নাচে। সরলের গান শুনে বড়রাও পাখনাতালি দেয়। সবাই সরলের মিষ্টিগানের গলার প্রশংসা করে। ঝাঁকের কোনো অনুষ্ঠান হলে, গানের কারণে সরল হয় তার মধ্যমণি। বড়দের আলাপ আলোচনায় সবাই সরলের গান শুনতে বায়না ধরে। সরলের গাওয়া গান ছাড়া অনুষ্ঠান অপূর্ণই মনে হয়। ঝাঁকের সর্দার বলেছেন, বিপদ কেটে সুদিন আসায় দু’দিন পর বড় একটা আনন্দ-উৎসব হবে। খালের সবচেয়ে প্রশস্ত অংশ, হিজলতলায়। অনুষ্ঠান হবে রাতে। কারণ এসময় শিকারি জেলেরা জাল ফেলতে আসে না। তাই রাতেই আনন্দ-উৎসব নিরাপদ।
সরল বাবার কাছে বায়না ধরেছে, বাবা দু’দিন পর অনুষ্ঠান। আমি একটা নতুন গান শিখব। আমাকে পিঠে নিয়ে পাখির গান শুনতে দাও। ছেলের বায়নাক্কায় বাবা সরলকে পিঠে নিয়েছেন কি! অমনি সরল ঝুপ করে বাবার পিঠ থেকে নেমে গেল! কী হলো, কী হলো? চারদিকে রব উঠল। সরলের চোখে শঙ্কা দেখে বাবা বললেন, কি হলো সরল? তুমি তো কখনো এমন করো না! পিঠ থেকে নেমে গেলে যে! সরল ভয়ে কাঁচুমাচু! সর্দারও কারণ জিজ্ঞেস করলে একটু-আধটু সাহস সঞ্চার করে বলল, সর্বনাশ! পালাও পালাও! তোমার পিঠে উঠতেই দেখলাম, কিছু লোক জাল নিয়ে এদিকে আসছে। সরলের সাবধান বাণী শুনে সরপুঁটির ঝাঁক নিমেষেই খালের অপর দিকে ছুটে গেল। সরলের বুদ্ধিমত্তায় বাঁচল ঝাঁকের সব সরপুঁটি। সরল সাবধান না করলে তো এখনই সবাই জালে আটকা পড়ত। তারপর ঢুলায় ভরে সোজা বাড়ি। কুটনাকুটা শেষে চুলার উনুনে, তরকারির হাঁড়িতে। সর্দার সরলের বুদ্ধির প্রশংসা করলেন। ছোট হলেও সে বেশ সাহসী। সে আজ আমাদের সবাইকে বাঁচিয়ে দিলো। সামনের আনন্দ অনুষ্ঠানে এজন্য তাকে বছরের সেরা সরপুঁটির পুরস্কার দেয়া হবে। এত কম বয়সে এ পুরস্কার আগে কেউ পায়নি। সরলই প্রথম এত কম বয়সে এই উপাধি অর্জন করতে চলেছে। সর্দারের ঘোষণা শুনে বন্ধুরা সকলে সরলকে পিঠে নিয়ে আনন্দে হইচই শুরু করে দিলো। এর মধ্যে সরল দেখল, লোকগুলো ওপাড়ে কিছু টেংরা আর চিংড়ির পোনা পেয়ে হতাশ মনে চলে যাচ্ছে। সরলের মা বাবাও তার কৃতিত্বে খুশি হয়ে তাকে বুকে চেপে ধরে আদর করতে থাকে।