বন্ধুরা, তোমাদের মধ্যে অনেকেই হয়তো বয়ঃসন্ধি সম্পর্কে ধারণা রাখ না। অথচ এই সময়ে ছেলে মেয়ে উভয়ের ক্ষেত্রে শারীরিক পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। এই পরিবর্তনটা ঠিকঠাক না হলে অনেকেই উদ্বেগ-উৎকন্ঠার মধ্যে পড়ে যায়। তাই আমরা এখানে তোমাদেরকে সে বিষয়ে ধারণা দেয়ার চেষ্টা করবো।

সাধারণত ৯-১০ বছর বয়সে শিশুদের মধ্যে কৈশোরের লক্ষণগুলো ফুটে উঠতে শুরু করে। আর ১২ থেকে ১৪ বছর বয়সে গিয়ে তা পুরোপুরি প্রস্ফুটিত হয়। কিন্তু কারও কারও ক্ষেত্রে স্বাভাবিক সময়ের দু-তিন বছর পরও বয়ঃপ্রাপ্তির শারীরিক কোনো লক্ষণ ফুটে ওঠে না। একে বিলম্বিত বয়ঃপ্রাপ্তি বা ডিলেইড পিউবারটি বলে।

বয়ঃসন্ধিকাল কোনো কোনো শিশুর মধ্যে একটু দেরিতেই শুরু হতে পারে। তবে পরে তা স্বাভাবিকভাবেই গড়ে ওঠে। এ ছাড়া অপুষ্টি, দীর্ঘমেয়াদি নানা রোগ যেমন, থ্যালাসেমিয়া, কিডনি রোগ, টারনার সিনড্রোমের মতো জেনেটিক সমস্যা বা হরমোনজনিত সমস্যার (প্রজনন হরমোনের অভাব বা অকার্যকারিতা) কারণে বয়ঃসন্ধিকাল বিলম্বিত হতে পারে।

অনেক অভিভাবক বিষয়টা খেয়াল করেন না বা গুরুত্ব দেন না। ফলে রোগ শনাক্ত ও চিকিৎসা শুরু করতে দেরি হয়ে যায়। তাই শিশুর বয়ঃসন্ধিকাল সময়মতো শুরু হচ্ছে কি না এবং এর লক্ষণগুলো কী, তা জানা উচিত।

বন্ধুরা, মেয়েদের ক্ষেত্রে ১৩ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও শারীরিক (স্তনের) বিকাশ না ঘটলে আর ১৬ বছর বয়সেও মাসিক শুরু না হলে এবং ছেলেদের ক্ষেত্রে ১৪ বছর বয়সেও প্রজনন অঙ্গের (অন্ডকোষের) বৃদ্ধি না ঘটলে তাকে বিলম্বিত বয়ঃসন্ধি বলে।

শিশুর শারীরিক ও স্বাভাবিক এসব পরিবর্তনে অসামঞ্জস্যতা দেখা গেলে কিংবা পরিবর্তন বিলম্বিত হলে সংকোচ না করে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করা উচিৎ। কৈশোরে সন্তানদের সঙ্গে এসব বিষয়ে আন্তরিকতার সঙ্গে কিছুটা খোলামেলা কথা বললে তারাও সংকোচ না করে সমস্যার কথা খুলে বলবে।

বন্ধুরা, এবার এসো আমরা জানার চেষ্টা করি বিলম্বিত বয়ঃসন্ধির কারণ কি? সমাজে লক্ষ্য করা যায়, কিছু কিশোর-কিশোরী বিলম্বে বিকশিত হয়ে থাকে। যাদের ঘটনাμমে তাদের সমবয়সী অধিকাংশ ছেলেমেয়েদের তুলনায় দেরিতে বয়ঃসন্ধি শুরু হয়। বিলম্বে বিকশিত হওয়াই হচ্ছে বিলম্বিত বয়ঃসন্ধির সবচেয়ে সাধারণ কারণ। এটা কোন মেডিকেল সমস্যার কারণে হয় না এবং এর জন্যে চিকিৎসারও দরকার হয় না। বিলম্বে বিকশিত হওয়া ছেলেমেয়েরা পরিশেষে তাদের নিজস্ব গতিতেই বয়ঃসন্ধি শুরু করে এবং তাদের বন্ধু-বান্ধবদের সমকক্ষতা অর্জন করে।

বিলম্বিত বয়ঃসন্ধির অন্যান্য কারণ হতে পারে কালমান সিনড্রোম। এই অবস্থাকে ঘ্রাণ অনুভুতির অভাব এবং কম লিউটিনাইজিং ও ফলিকল-স্টিমুলেটিং হরমোন নিঃসরণ বলে বর্ণনা করা হয়ে থাকে।

কখনও কখনও কিছু মেয়ের মাসিক হওয়া শুরু হয় না, কারণ তাদের জরায়ু ও য্যোনি যথাযথভাবে বিকশিত হয় না। অথবা তাদের প্রোল্যাকটিন নামক হরমোন বেশি থাকে অথবা পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোমের (পিসিওএস) মতো সমস্যা থাকে।

বন্ধুরা, এখন হয়তো তোমাদের মাথায় প্রশড়ব আসছে, ছেলে বা মেয়ের বিলম্বিত বয়ঃসন্ধি হলে তাকে কি ডাক্তার দেখানো দরকার? বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শিশুর বিলম্বিত বয়সন্ধির জন্য চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু শিশু যদি বিকশিত হতে শুরু করে হঠাৎ করে থেমে যায় এবং শিশু ও তার অভিভাবক উদ্বিগড়ব হয়ে পড়েন তাহলে এ ক্ষেত্রে ডাক্তার দেখানোই ভাল। তখন ডাক্তারই (শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ) বলে দেবেন তার মেডিকেল সমস্যার জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে কিনা। তবে এসময় কিশোর-কিশোরীদের সবচেয়ে বড় যে জিনিস প্রয়োজন সেটা হলো তাদের এইমর্মে পুনঃআশ্বস্ত করা যে, তারা শীঘ্রই তাদের বন্ধু-বান্ধবদের সমতা অর্জন করবে।

বিলম্বিত বয়ঃসন্ধির ব্যাপারে ডাক্তার কিভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবেন? ডাক্তার শিশুর স্বাস্থ্য ও ওষুধপত্র সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেবেন। তিনি জানতে চাইবেন শিশুটি বয়ঃসন্ধির কোন উপসর্গ লক্ষ্য করেছে কিনা, অথবা বিলম্বিত বয়ঃসন্ধির কোনো পারিবারিক ইতিহাস আছে কিনা। ডাক্তার শিশুটির শারীরিক পরীক্ষা-নিরিক্ষা করবেন এবং হরমোনের মাত্রা দেখার জন্য রক্ত পরীক্ষা করাবেন। ডাক্তার তার উচ্চতা ও ওজন পরিমাপ করে শিশুটির বৃদ্ধি পরীক্ষা করবেন এবং হাতের এক্স-রে করিয়ে দেখবেন শিশুটির স্বাভাবিকের তুলনায় ধীর গতিতে বৃদ্ধি হচ্ছে কিনা। কখনও কখনও ডাক্তার বয়ঃসন্ধির লক্ষণ দেখতে পান যা শিশু বা তার অভিভাবক লক্ষ্য করেননি। পিটুইটারি গ্রন্থির সমস্যা দেখার জন্য কিছু শিশুর মস্তিস্কের স্ক্যান (যেমন এমআরআই) করার প্রয়োজন হয়। জরায়ু ও ডিম্বাশয়ের যথাযথ বৃদ্ধি হচ্ছে কিনা তা দেখার জন্য মেয়েদের সোনোগ্রাম করানোর প্রয়োজন হতে পারে।

বন্ধুরা, পরিশেষে, এসো আমরা জেনে নিই, বিলম্বিত বয়ঃসন্ধির চিকিৎসা কি? ডাক্তার যদি কোনো মেডিকেল সমস্যা দেখতে না পান তাহলে শিশুর কোনো চিকিৎসার প্রয়োজন নেই, সেক্ষেত্রে শিশুটি এক পর্যয়ে নিজে থেকেই বিকশিত হতে শুরু করবে। ডাক্তার শিশুটির বয়ঃসন্ধির দিকে অগ্রসর হওয়ার ধারা পর্যবেক্ষণ করতে চাইতে পারেন।

শিশুটির যদি কোনো মেডিকেল সমস্যা থাকে তাহলে ডাক্তার বৃদ্ধি ও বয়ঃসন্ধি বিশেষজ্ঞ একজন পেডিয়াট্রিক এন্ডোμাইনোলজিস্টের কাছে তাকে রেফার করতে পারেন। কখনও কখনও ডাক্তার শিশুর বিকাশের সূচনায় সাহায্য করতে স্বল্প-মেয়াদী হরমোন থেরাপির ব্যবস্থাপত্র দেবেন। মেয়েরা এস্ট্রোজেন পিল সেবন করবে এবং ছেলেরা টেসটেসটেরন ইঞ্জেকশন নেবে। কিছু কিশোর-কিশোরী স্বাভাবিক পরিমাণ এস্ট্রোজেন ও টেসটেসটেরন নিতে সক্ষম না হলে তাদের দীর্ঘমেয়াদী হরমোন থেরাপির প্রয়োজন হতে পারে।

শিশুর বিলম্বিত বয়ঃসন্ধি সমস্যা কাটিয়ে উঠতে একজন অভিভাবক কী করতে পারেন? প্রম পদক্ষেপ হচ্ছে, শিশুটির যে কোনো সমস্যা হয় নাই সেটা নিশ্চিত করতে তাকে শিশুরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যেতে হবে। শিশুটি উদ্বিগড়ব ও বিষনড়ব হলে তাকে কাউন্সিলিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া. কিছু কিশোর-কিশোরীর বিপনড়ব মানসিক অবস্থা কাটিয়ে উঠতে অতিরিক্ত সাহায্যের প্রয়োজন হতে পারে।