রোজা : বিরত থাকার শিক্ষা

শাকের জামিল

0
194

রমজান মাস হলো রোজা রাখা বা সিয়াম পালন করার মাস। চাঁদ দেখার ওপর ভিত্তি করে ২৯ দিন বা ৩০ দিন মুসলমানরা রোজা রেখে থাকেন। রোজার মূল পালনীয় বিষয় হলোÑ বিরত থাকা। দিনের নির্দিষ্ট সময়ে অর্থাৎ সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আল্লাহর নির্ধারণ করে দেয়া কতগুলো কাজ থেকে বিরত থাকার নামই রোজা। কী কী বিষয় থেকে বিরত থাকতে হয়? পানাহার এবং অন্যায়-অশ্লীল কাজ ও পাপাচার থেকে। অন্যায় কাজ তো সারা বছরই নিষিদ্ধ, কিন্তু রমজানের রোজার সময় কিছু ন্যায় অর্থাৎ স্বাভাবিক হালাল কাজও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যেমন: পানাহারÑ এটা সারা বছর এমনকি রমজানে দিনের বেলা ছাড়া সবসময়ই করা যায়। তবু এই হালাল কাজ থেকেও কেন বিরত থাকতে হলো? এখানেই হলো বিরত
থাকতে পারার শিক্ষা। আল্লাহ আমাকে দেখছেন এই চিন্তা মাথায় রেখে রোজা রাখা অবস্থায় মুসলমানরা খাবার/পানি গ্রহণ করেন না।
বিরত থাকার শিক্ষা জীবনের সফলতার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নীতি। শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্যই মুসলমানরা এই বিরত থাকার ইবাদত করেন। অর্থাৎ নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে সাময়িকভাবে বৈধ কাজকে না বলতে পারার যোগ্যতা অর্জন করেন তারা। সহজভাবে বলতে গেলে সাফল্য অর্জনের পথে যেকোনো লোভনীয় বিষয়কে প্রত্যাখ্যান করতে পারলেই সাফল্য একসময় হাতে ধরা দেবে।
এবার ‘বিরত থাকার শিক্ষা’ কিভাবে তোমার প্রতিদিনের কাজে লাগবে সে আলোচনা করা যাক। ধরো, তোমার আগামী সপ্তাহে পরীক্ষা আছে। পরীক্ষায় ভালো ফলাফল অর্জন করতে হলে ভালোভাবে লেখাপড়া করতে হবে। কিন্তু এর মধ্যেই তোমার বন্ধু এসে তোমাকে নতুন একটা গেমসের সন্ধান দিলো। এই গেমসের আকর্ষণীয় ফিচার দেখালো। অন্য আর কে কে এই গেমস খেলছে সেটাও বলল। শুনে তোমার মনে হলো এখুনি গেমস ইন্সটল করে খেলা শুরু করে দিই। না! এই মুহূর্তে না বলতে হবে নিজের মনকে। এক্ষুণি ‘বিরত থাকার শিক্ষা’ কাজে লাগাতে হবে। বন্ধুকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় দিয়ে দিতে হবে।
অথবা গ্রাম থেকে আত্মীয় এলো এই সময়েই। গ্রামের আমগাছে নতুন আম ধরেছে, ডাবগাছে ডাব ধরেছে, পুকুরের মাছ বড় হয়েছে ইত্যাদি গল্প শোনালো তোমাকে। আর প্রস্তাব দিলোÑ চলো দু’দিনের জন্য গ্রামের বাড়ি বেড়াতে যাই। অনেক দিন গ্রামের বাড়িতে যাওয়া হয় না, গাছের ফল খাওয়া হয় না, সুতরাং যাওয়াই দরকার। আত্মীয় চলে গেলে আবার সাথে যাওয়ার লোক পাওয়া যাবে না। সুতরাং এখনই চলে যাই। না! এই মুহূর্তে ‘বিরত থাকার শিক্ষা’ কাজে লাগাতে হবে। গ্রামে বেড়াতে যাওয়া অবশ্যই অবৈধ কিছু নয়। কিন্তু এক সপ্তাহ পরেই পরীক্ষা, এখন যাওয়া যাবে না।
এর পরে ধরো, পরীক্ষার আগের রাত। শেষ প্রস্তুতির সময়। কিন্তু টিভিতে নতুন ড্রামা সিরিজ বা কার্টুন দেখার সময় হয়েছে। ওটা এক ঘণ্টা চলবে। না দেখলেই যে মিস। কী করা! পড়া বাদ দিয়ে দেখে আসি, পরে পড়বো। এই সময়ে ‘না’ বলতে হবে। বিরত থাকতে হবে। এভাবে বিরত থাকার শিক্ষা কাজে লাগাতে হবে।
পরীক্ষা সামনে এলে বেশি ঘুম পায়? মনে হয় আরেকটু ঘুমিয়ে নিই, তারপর পড়বো? ঘুম তো অন্যায় কিছু না, পাপ না তাহলে সমস্যা কী? হ্যাঁ, তখনই বিরত থাকার শিক্ষা দরকার। সাফল্য অর্জনের জন্য বৈধ সুখ থেকে বিরত থাকতে হবে।
রোজার দিনে যখন তোমার বন্ধুবান্ধব যারা ভিন্ন ধর্মাবলম্বী, তারা তোমার সামনে খাওয়াদাওয়া করে। কিন্তু তুমি বিরত থাকো, কারণ তোমার লক্ষ্য আল্লাহকে সন্তুষ্ট করা। তুমি এ কারণেই বিরত থাকতে পারো। একইভাবে যখন তোমার বন্ধুবান্ধবদের কেউ তোমার সামনে ধুমপান করবে, সেটা থেকেও তোমাকে ‘বিরত’ থাকতে হবে।
ইফতারের সময় না হওয়া পর্যন্ত সামনে অনেক আকর্ষণীয় হালাল খাবার থাকলেও ‘বিরত’ থাকতে হয়। এই শিক্ষা যদি হৃদয়ে ধারণ করা যায়, তাহলে সৎ জীবন যাপন করা সহজ হয়। যেমন ধরো, বন্ধু অনেক মজার মজার খাবার এনেছে। ওর টিফিন বক্স রেখে বাইরে কোথাও গেছে। তুমি জানো বক্সেই খাবার আছে। কিন্তু সেই যে তুমি বিরত থাকার শিক্ষা পেয়েছ। তাই তোমার সেই টিফিন বক্সের প্রতি কোনো অবৈধ আকর্ষণ কাজ করছে না।
একই রকমভাবে বাজারে গেলে হরেক রকম আকর্ষণীয় জিনিস দেখেও তোমার সেগুলোর জন্য খারাপ লাগবে না। তোমার মনে হবে নাÑ যে ওখান থেকে লুকিয়ে কিছু নিয়ে নিই, অথবা ছিনিয়ে নিই। রাস্তায় যারা ছিনতাইকারী বা ডাকাত তারা কী করে? দামি বা মূল্যবান কিছু দেখলেই হামলা করে। কারণ তাদের মধ্যে ‘বিরত’ থাকার শিক্ষা নেই। সে মনে করে যা দেখলাম, সবই আমার অধিকার। ওগুলো ছিনিয়ে নিতেই হবে। তাই সে ছিনিয়ে নেয়। কিন্তু কোনো মুসলিম এ কাজ করতে পারে না, কারণ তার রোজার শিক্ষা আছে।
রোজা নষ্ট হবার অন্যতম কারণ হলোÑ গিবত করা। অর্থাৎ কারো অনুপস্থিতিতে তাকে হেয় করে কথা বলা। বন্ধুবান্ধব বা আত্মীয়দের আড্ডায় যখন গিবত শুরু হবে সেখান থেকে নিজেকে ‘বিরত’ না রাখলে রোজা নষ্ট হয়ে যাবে। সুতরাং একইভাবে বছরের অন্যান্য সময়েও মানুষের নিন্দা করা, গিবত করা, অপবাদ দেয়া থেকে নিজেকে বিরত রাখতে হবে। বিরত থাকার শিক্ষা তাহলেই ফলপ্রসূ হবে।
কাউকে গালি দেয়া রোজার শিক্ষার পরিপন্থী। এমনকি রোজা রাখা অবস্থায় কেউ গালি দিলেও তাকে পাল্টা গালি দেয় না রোজাদার মুসলিম। কারণ তার লক্ষ্য সুদূরপ্রসারী। পুরোটা দিন তাকে ধৈর্য ধরতে হবে। এসব অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকতে পারলেই রোজা কবুল হবে। যদি গালির বিপরীতে গালি, ঝগড়ার মোকাবেলায় ঝগড়াই হয় তাহলে আর রোজা কবুল হবে না। এগুলো এড়িয়ে যাওয়া বা বিরত থাকতে পারাটাই সাফল্য।
একটি কথা আছে যে কুকুরের দিল্লি দেখা হয় না। কারণ হলো কুকুর যখন দিল্লি দেখার লক্ষ নিয়ে ভোর সকালে যাত্রা করে, কিছু দূর যাবার পর দেখে আরেক কুকুর। সেই কুকুর আজেবাজে কথাবার্তা বলে। কুকুর প্রথমটাকে হয়তো কোনো উত্তর দেয় না। কিন্তু দ্বিতীয়, তৃতীয়টার বেলায় ক্ষেপে যায়। উল্টো ঝগড়া করতে শুরু করে। তার মাথায় আর দিল্লি যাওয়ার সঙ্কল্প থাকে না। ঝগড়াতে চিৎকার করে জেতাটাই জরুরি মনে করে তখন। কিন্তু সে যদি ঝগড়া থেকে বিরত থেকে অন্য কুকুরগুলোকে একের পর এক এড়িয়ে যেতে পারত, তাহলেই সে সফল হতো। যত দিনই লাগুক দীর্ঘপথ অতিক্রম করে সে দিল্লি পৌঁছে যেত।
আমাদের জীবনেও সফলতার পথে লোভনীয় অফার আসবে, ঝগড়া-ফাসাদ, কটুবাক্য, অপমান-অবহেলা আসবে। এগুলো সাফল্যের পথে বাধা। এসব মোকাবেলা করার জন্য রোজা তথা ‘বিরত’ থাকার শিক্ষা কাজে লাগাতে হবে। মনে রাখতে হবে, সফলতা হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য। সেই পথে অবিচল থাকতে হবে।