মায়ের ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা

শাকের জামিল

0
151

সবাইকে মহান ভাষা শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের শুভেচ্ছা জানাই। এমন একটা পৃথিবী কি কল্পনা করা যায় যেখানে কোনো শব্দ নেই, কোনো ভাষা নেই? যেখানে শুধু সব দেখবে কিন্তু কিছুই শুনবে না? অথবা এমনকি ভাবতে পারো যে তুমি বধির হয়ে গেছো, কিছুই শুনতে পাচ্ছো না। তোমার চারপাশে যা কিছুই হচ্ছে তুমি দেখছো, বুঝতেও পারছো কিন্তু শুনতে পারছো না। কেউ এসে তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করছে, অথচ তুমি শুনতে পাচ্ছো না, বুঝতে পারছো না। কেমন লাগবে তখন? আসলে ভাষার গুরুত্ব হচ্ছে এখানটাতে। ধ্বনি থেকেই শব্দ, শব্দ থেকে ভাষা। বলা হয় সভ্য যুগের আগে মানুষ চিৎকার করে, বিভিনড়ব অঙ্গভঙ্গি করে কথা বলতো। যখন তাদের সুনির্দিষ্ট বলার ভাষাও ছিল না, তখন তারা লেখ্য ভাষা হিসেবে হায়ারোগ্লিফিক বর্ণমালায় লিখতো। তারও আগে হয়তো তারা অগোছালোভাবে বিভিনড়ব ছবি এঁকে অনুভূতি প্রকাশ করতো। আজকের পৃথিবীতে দুই হাজার ভাষা আছে। এসব ভাষায় মানুষ মনের ভাব প্রকাশ করে।
ভাষার সূচনা হয় মায়ের গর্ভে থাকতেই। গর্ভস্থ শিশু তখন কিছুই দেখেনা, অন্যান্য অনুভূতি তার কাজ করে না। কিন্তু শ্রবণ অনুভূতি সবার আগেই জন্মায়। জন্মের পর শিশু তার মাকে চিনতে পারে তার শব্দ শুনেই। কারণ গর্ভকালীন এই শব্দ তার মস্তিষ্কে অতি পরিচিত হিসেবে জায়গা করে নেয়। জন্মের পরবর্তীতে শিশু যে ধরনের পরিবেশে বড় হবে, যে ভাষা বেশি শুনবে, সেটিই আয়ত্ব করবে। সেজন্য শিশুদের আশেপাশে ভালো ভাষায় কথা বলতে হয়।
ভাষার গুরুত্ব অন্য যে কোনো জাতির চাইতে আমাদের বেশি বোঝা উচিত। কেননা আমরা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছি। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বুকের রক্ত দিয়ে মাতৃভাষার দাবি আদায় করেছে এ দেশের তরুণরা। প্রাণ দিয়েছে রফিক, সালাম, শফিউর, বরকত, জব্বার সহ অনেকে। ভাষা আন্দোলনের প্রায় সত্তর বছর হতে চলেছে।
কিন্তু ভাষা সম্পর্কে আমাদের অনুভূতি কী? মাতৃভাষার প্রতি আমাদের দায়িত্ব কী? ২১ ফেব্রুয়ারি সকালে খালি পায়ে হেঁটে গিয়ে শহীদ মিনারে ফুল দিলেই কি ভাষার প্রতি সম্মান জানানো শেষ হয়? আমাদের কি নিজেদের আর কোনো দায়িত্ব নেই? ভাষার মর্যাদা বাড়ে কিসে? ভাষার সংরক্ষণ হয় কিভাবে? ভাষার সাথে আমাদের সম্পর্ক কী? এ বিষয়গুলো বুঝতে হবে। মাতৃভাষার প্রতি সম্মান দেখাতে হলে প্রমত নিজের মাতৃভাষা ভালোভাবে জানতে হবে। সেটা কী রকম? প্রমিত ভাষা জানতে হবে। প্রত্যেকের আঞ্চলিক ভাষা তার গৌরবের। কিন্তু ভাষার নিজস্ব প্রমিত রূপ না জানলে, তার সুনির্দিষ্টতা থাকে না। সবাই মিলে যেটিকে আদর্শ ধরা হয়েছে সেটিই প্রমিত রূপ। আনুষ্ঠানিক জায়গায় প্রমিত বাংলায় কথা বলার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে। এটিকে
অনেকে কৃত্রিমতা মনে করে। কারো কাছে এটি লোক দেখানো, ফুটানি বা তামাশা মনে হতে পারে। কিন্তু এটি মাতৃভাষাকে সম্মান দেখানোর একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। বাড়িতে অথবা নিজস্ব বন্ধুবান্ধবের আড্ডায় আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার না করলে চলে না। কিন্তু আনুষ্ঠানিক জায়গায় অবশ্যই প্রমিত বাংলায় কথা বলার চেষ্টা করতে হবে।
নিজস্ব পরিবেশে কথা বলার ক্ষেত্রেও খেয়াল রাখতে হবে যেসব ইংরেজি শব্দ ব্যবহার না করলেই নয়, সেগুলো ছাড়া অহেতুক ইংরেজি শব্দের মিশেল ঘটানো থেকে বিরত থাকতে হবে। অপ্রয়োজনীয় ইংরেজি ব্যাবহার কোনো স্মার্টনেস বা আধুনিকতা নয়। দ্বিতীয়ত, বাংলা সাহিত্য পড়তে হবে। ভাষা এবং এর ভিত্তিতে গড়ে ওঠা সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে হলে পড়ার কোনো বিকল্প নেই। হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা বাংলা সাহিত্যের রস আস্বাদন করতে হবে পড়ার মাধ্যমে। পড়তে হবে উপন্যাস, গল্প ও কাব্য। পড়তে হবে ইতিহাস। আবহমান বাংলাকে জানতে হবে। তাহলে ভাষাজ্ঞান সমৃদ্ধ হবে।
তৃতীয়ত, বাংলা লেখার ক্ষেত্রে শুদ্ধ বাংলা লেখার চেষ্টা করতে হবে। কারণ ভাষার কাঠামো টিকে থাকে লেখার মধ্যে। ভুল লেখা বা ভুল বানানে লেখা হলে পরবর্তীতে সেটাকে কেউ সঠিক মনে করে নিয়ে ভুল চালিয়ে যেতে পারে। লেখার ক্ষেত্রে বলা দরকার বর্তমানে অনলাইনসহ অন্যান্য ডিভাইসে যেখানে বাংলায় লেখার সুযোগ আছে সেখানে বাংলা বর্ণে লেখাই হলো ভাষার প্রতি ভালোবাসা। আর লেখার মধ্যেও যতটা সম্ভব বাংলিশ ভাষা বর্জন করতে হবে। চর্তুত, লেখালিখি করতে হবে। লেখালিখি বলতে গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, অভিজ্ঞতা এমনকি ডায়েরি লেখাও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ভাষা সমৃদ্ধ হয় লেখালিখিতে। যে ভাষায় যত বেশি বই, গবেষণা, ইতিহাস
লেখা হয়েছে সেই ভাষা অন্য ভাষার ওপর বিজয়ী হয়েছে। আরবরা যখন প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের বিপুল অংশ বিজয় করে নেয়, তখন তারা ইউরোপীয় এবং ভারতীয় অনেক বই আরবিতে অনুবাদ করে সংরক্ষণ করেছিল। পরবর্তীতে ইংরেজরা যখন বিশ্ব শাসন করে তখন তারাও সব ধরনের সাহিত্য ইংরেজিতে অনুবাদ করেছে। আজকে অনলাইন নেটওয়ার্কে ইংরেজি ভাষায় কনটেন্ট বেশি হওয়ার কারণে আমাদের বাধ্য হয়ে ইংরেজি বুঝতে হচ্ছে, শিখতে হচ্ছে। তাই প্রত্যেককে মাতৃভাষায় লেখালিখি করতে হবে। কারণ যে কারো যেকোনো বিষয়ে লেখা এক সময় ইতিহাসের অংশ হয়ে যেতে পারে। যেমন আনা ফ্রাঙ্ক নামে এক কিশোরীর লেখা ডায়েরি বিখ্যাত হয়েছে। অনলাইনে তোমার যেকোনো একটি বিষয়ে লেখা একটি প্রামাণ্য লেখা হয়ে যেতে পারে। তাই যাদের লেখার মত যোগ্যতা আছে, লিখতে থাকো।
পঞ্চমত, মাতৃভাষার সংস্কৃতি চর্চা করতে হবে। বাংলা ভাষা ভিত্তিক যে সংস্কৃতি তা চর্চা করতে হবে আবশ্যকভাবে। এই সংস্কৃতি আমাদের মূল্যবোধের ওপর গড়ে ওঠা। ভিনদেশী সংস্কৃতি নিয়ে মেতে থেকে শুধুমাত্র শহীদ মিনারে ফুল দিলে বাংলা ভাষার প্রতি, ভাষা শহীদদের প্রতি নিছক উপহাস করা হয়। সংস্কৃতিচর্চা বলতে বোঝায় নিজে উপভোগ করা এবং অনুশীলন করা। সংস্কৃতির মধ্যে অনেক কিছু আছে। উৎসব আনন্দে কনসার্ট করে হিন্দি ইংলিশ গান বাজানো যাবে না। বাংলায় অনেক উৎসবের আমেজের গান আছে, সেগুলো শুনতে হবে এবং গাইতে হবে। অনেকে নিয়মিত হিন্দি গান শোনো। তার পরিবর্তে বাংলা ভালো গান খুঁজে বের করতে হবে। নিজস্ব পছন্দ তৈরি করতে হবে। এটি ভাষার প্রতি সম্মানের তাগিদে। অন্য ভাষার গান শোনা যাবে না, তা নয়। তবে নিজের ভাষার গানকে সমৃদ্ধ করার জন্য চেষ্টা চালাতে হবে। যাদের যোগ্যতা আছে তারা বাংলা গানের কথা, সুর নিয়ে গবেষণা করতে পারো। কিভাবে আরো ভালো গান লেখা যায়, সুর করা যায়, সুরে বৈচিত্র্য
আনা যায়, সেগুলো নিয়ে কাজ করতে পারো। বাংলায় ভালো নাটক, সিনেমা তৈরি করা খুব জরুরী। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বাংলাকে পরিচিত করানোর মাধ্যম হলো গান, নাটক এবং সিনেমা। বর্তমানে এই
পরিমন্ডলে কাজ করা খুব দরকারী। ভালো টিভি অনুষ্ঠান, কার্টুন ইত্যাদিও তৈরি করা দরকার। বাংলায় ভালো কার্টুন না থাকায় শিশুরা হিন্দি, জাপানী বা ইংরেজি কার্টুন দেখছে। এর ফলে হিন্দি ভাষা তাদের মনে গেঁথে যাচ্ছে। তাই এসব নির্মাণ করতে হবে শুধুমাত্র ভাষাকে টিকিয়ে রাখতে। সংস্কৃতির মধ্যে আছে কী কী উৎসব পালন করবে, কিভাবে পালন করবে সেটিও। বাইরের দেশের যেসব উৎসব অশ্লীলতা ছড়ায়, নোংরামি ছড়ায় সেগুলোকে আত্মীকরণ করার মধ্যে গৌরবের কিছু নেই। উৎসব অনুষ্ঠানের নামে মাতলামি, পাগলানৃত্য বর্জন করতে হবে। আনন্দ উল্লাস করার মধ্যে দোষের কিছু নেই। কিন্তু যা সমাজের জন্য ক্ষতি বয়ে আনে এমন কাজ ত্যাগ করতে হবে।
লেখালিখি ছাড়াও বর্তমানে অনলাইনে অডিও, ভিডিও কনটেন্ট এবং ওয়েব কনটেন্ট তৈরির মাধ্যমে ভাষার প্রতি দায়িত্ব পালন করা যায়। বাংলায় ভিডিও কনটেন্ট তৈরি করা, সফটওয়্যার তৈরি করা, ওয়েবসাইট তৈরি করা খুবই জরুরী। একটি মোবাইল অ্যাপ তৈরি করেও ভাষার অনেক উপকার করা যায়। এখনো আমাদের অনেক কিছু করা বাকি। বাংলা পৃথিবীর অন্যতম মধুর ভাষা। এই ভাষা আমাদের প্রাণের ভাষা। এই ভাষা নিয়েই গড়ে উঠেছে আমাদের স্বকীয় পরিচয়, আমাদের জাতিসত্ত্বা। তাই শুধুমাত্র দিবসভিত্তিক মাতৃভাষাকে সীমাবদ্ধ না রেখে এসো মায়ের ভাষার প্রতি সম্মান দেখাই। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে মাতৃভাষাকে ওপরে তুলে ধরি।