তোমার দেশকে তুমিই চেনাও

শাকের জামিল

0
24
হাবিব নুরমোহামেদভ

আব্দুল মানাপ নুরমোহামেদভ। সোভিয়েত রাশিয়ার দাগেস্তানের সিলদি গ্রামে ১৯৬২ সালে তার জন্ম। সিলদি ছিল অত্যন্ত প্রত্যন্ত এবং পাহাড়ি গ্রাম। পাহাড়ের বুকে বেড়ে ওঠার কারণে সেখানের বাচ্চারা অল্প বয়সেই কুস্তি শিখতো। আব্দুল মানাপও রেসলিং শিখে কোচ হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেন। এরপর যোগ দেন রাশিয়ান আর্মিতে। সেখানে জুডো, মার্শাল আর্ট, সাম্বো ইত্যাদিতে প্রশিক্ষণ নিয়ে দক্ষ হয়ে ওঠেন। সেনাবাহিনীর চাকরি থেকে অবসরের পর চলে যান দাগেস্তানের কিরোভলে। পরিবার নিয়ে দোতলা বাড়িতে ওঠেন। নিচতলায় খুলে বসেন জিমনেশিয়াম।
জিমে ভর্তি করেন এলাকার ছেলেদের। পুরোদমে মার্শাল আর্টের প্রশিক্ষণ দিতে থাকেন আব্দুল মানাপ। তিনি স্বপ্ন দেখতে থাকেন তার জিম থেকে একদিন বিশ্বমানের খেলোয়াড় বের হবে। কোচ হিসেবে তার প্রথম সফলতা আসে ১৯৯২ সালে। তার ভাই নুর মোহামেদ ইউক্রেনের হয়ে ওয়ার্ল্ড সাম্বো চ্যাম্পিয়নশিপ জেতে। কোচ হিসেবে তিনি অনুপ্রাণিত হন, এগিয়ে যেতে থাকেন। আব্দুল মানাপের তিন সন্তান। বড় ছেলে মোহামেদ, ছোট ছেলে হাবিব, মেয়ের নাম আমিনা। বাবার মার্শাল আর্টের প্রতি ছোট ছেলে হাবিবের আকর্ষণ জন্মায়। সে বাবার কাছ থেকে হাতে কলমে শিখতে থাকে মার্শাল আর্টের যত কলাকৌশল।
শিশু হাবিবের উৎসাহ দেখে বাবা আব্দুল মানাপ তাকে সকল প্রকার কঠিন প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে বড় করতে থাকেন। হাবিবকে কুস্তি শেখান প্রশিক্ষিত ভালুককে দিয়ে। বিশালাকার ভালুকের সাথে কুস্তি লড়তো হাবিব। বরফ পানিতে সাঁতার কাটতো, এমনকি স্রোতের বিপরীত দিকে সাঁতার কাটতো সে। ১২ বছর বয়সে হাবিব প্রফেশনাল রেসলিং শেখে, ১৫ বছর বয়সে জুডো প্রশিক্ষণ নেয়। ব্রাজিলিয়ান জিজিৎসু শেখে। এরপর অংশ নেয় রাশিয়ার জনপ্রিয় সাম্বো মার্শাল আর্টে। সাম্বো হলো জুডো এবং কুস্তির সমন্বয়ে এক ধরনের মার্শাল আর্ট। হাবিব দুইবার ‘কমব্যাট সাম্বো’তে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হন।
হাবিবের সম্ভাবনা দেখে ‘মিক্সড মার্শাল আর্ট’ বা MMA প্রতিযোগিতায় যাওয়ার সুযোগ করে দেন বাবা। ২০০৮ সালে MMA তে যোগ দিয়ে সে বছরই রাশিয়ার রাজধানী মস্কোতে আয়োজিত Atrium Cup Tournament এ চ্যাম্পিয়ন হন হাবিব। তিন বছরে টানা ১৬টি ফাইটে অপরাজিত থেকে হাবিব মিক্সড মার্শাল আর্টের সবচেয়ে বড় প্রতিযোগিতা- আমেরিকার Ultimate Fighting Championship বা UFC তে যোগ দেন। ২০১২ সালে প্রথম UFC ম্যাচে ইরানের ফাইটার কামাল সালোরাসের মুখোমুখি হন হাবিব। প্রথম ম্যাচেই সাবমিশন করান প্রতিদ্বন্দ্বীকে। সাবমিশন হলো যখন কুস্তিতে আর টিকতে না পেরে কোনো প্রতিযোগী হাল ছেড়ে দেয় এবং প্রতিপক্ষের গায়ে ট্যাপ করে আত্মসমর্পণের ঘোষণা দেয়। প্রথম ম্যাচে সাবমিশন করিয়ে হাবিব জানান দেয় যে, সে UFC তে বড় অর্জন ছিনিয়ে নিতে এসেছে।

আবদুল মানাপ নুরমোহামেদভ

বাবা আব্দুল মানাপ, হাবিবের রেসলিং ক্যারিয়ারকে আরো সমৃদ্ধ করার জন্য বিখ্যাত মেক্সিকান কোচ হেভিয়ার মেন্ডেজের কাছে প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য পাঠান। হেভিয়ার মেন্ডেজ ছিলেন কিকবক্সিং এ দুইবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। তিনি ডেনিয়েল কোরমিয়র সহ বিখ্যাত অনেক MMA খেলোয়াড়কে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। হেভিয়ার জানান, হাবিবের সাফল্যের পেছনে ছিল তার অসাধারণ শৃঙ্খলাবোধ। হাবিব একজন মুসলিম। শুধু নামে মুসলিম না, পুরোদস্তুর ‘প্র্যাকটিসিং মুসলিম’। শুধু হাবিব না, আব্দুল মানাপের যারাই ছাত্র, সবাই পুরোপুরি ইসলামী অনুশাসনে চলে। তারা নিয়মিত ভোরে ঘুম থেকে ওঠে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে। রমজানে রোজা রাখে। মদ খায় না, ধুমপান করে না। নাচ-গানের পার্টিতে যায় না। হারাম খাবার খায় না। তাদের কাজ হলো সারাদিন ট্রেনিং করা আর ইবাদাত করা। সুতরাং সাফল্যের ফোকাস থেকে তারা বিন্দুমাত্র নড়ে না। তারা খুবই বিনয়ী, ভদ্র এবং পরস্পরের প্রতি সহানুভ‚তিশীল, পরোপকারী। হেভিয়ার বলেন, হাবিবকে তিনি প্রায় ১০ বছর ধরে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন কিন্তু একবারের জন্যেও হাবিব তার সাথে বেয়াদবি করেনি।
হাবিবের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে জনপ্রিয় ফাইটটি হয় আইরিশ ফাইটার কনর ম্যাকগ্রেগরের সাথে। কনর ছিলেন তখন লাইটওয়েট ডিভিশনে UFC’র বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। অর্থাৎ তাকে হারাতে পারলে হাবিব বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হবে। যুক্তরাষ্ট্রের লাস ভেগাসে ২০১৮ সালের ৬ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হয় UFC’র অন্যতম সেরা এই ম্যাচ। ম্যাচের আগের রাতে সংবাদ সম্মেলনে কনর হাবিবকে নানান রকম উগ্র কথাবার্তা বলেন। হাবিবকে বলেন- ‘আমি তোমাকে মৃত দেখতে পাচ্ছি, তোমার ঠোঁট নীল হয়ে যাচ্ছে’। কিন্তু হাবিব শান্ত থেকে তার উগ্রতাকে উপেক্ষা করেন। বরং যখন উপস্থাপক তাকে জিজ্ঞেস করেন পরের দিন খেলায় হাবিব কী করবেন? উত্তরে তিনি সেখানে উপস্থিত কনর ম্যাকগ্রেগরের হাজার হাজার আইরিশ সমর্থককে বলেন- Alhamdulillah, God gave me everything, Alhamdulillah. Tomorrow night, I am gonna smash your boy, guys. (আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ আমাকে সব দিয়েছেন। আলহামদুলিল্লাহ। শোনো, আগামীকাল রাতে আমি তোমাদের এই ছেলেকে চুরমার করে দেবো)।
ম্যাচের রাতে হলোও তাই। প্রতাপশালী কনরকে শুরু থেকেই নাজেহাল করতে থাকে হাবিব। ম্যাচের চতুর্থ রাউন্ডে কনরের গলা চেপে ধরেন তিনি। অসহায় হয়ে কনর, হাবিবের হাতে ট্যাপ করে আত্মসমর্পণ করেন। প্রথম মুসলিম হিসেবে এবং দাগেস্তানের প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে UFC’র বিশ্বমঞ্চে চ্যাম্পিয়নশিপ লাভ করেন হাবিব নুরমোহামেদভ। অবশ্য তার নাম তোমরা গুগলে খুঁজতে গেলে পাবে Khabib Nurmagomedov। এই নামের ব্যাখ্যা হাবিব পরে দিয়েছেন যে, আরবিতে ‘হাবিব’ উচ্চারণ করতে বড় ‘হা’ এর উচ্চারণে করতে হয়। কিন্তু ইংরেজিতে তো বড় ‘হা’ উচ্চারণের কোনো বর্ণ নেই। তাই তার বাবা Habib এর বদলে Khabib করে দিয়েছেন, যাতে উচ্চারণ কাছাকাছি হয়। একইরকম নুরমোহামেদভ এর বদলে রাশিয়ান উচ্চারণে নুরমাগোমেদভ হয়ে গেছে।
ফিরে আসি হাবিবের পারদর্শিতার কথায়। হাবিবের মাধ্যমেই লোকে জানলো যে দাগেস্তান নামে একটি দেশ আছে। রাশিয়ার অধীনে একটি স্বায়ত্ত¡শাসিত দেশ হলো দাগেস্তান প্রজাতন্ত্র। কনরকে পরাজিত করার পর হাবিবকে ফোন করে অভিনন্দন জানান রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। পরে মস্কোতে পুতিনের সাথে সাক্ষাৎ করেন হাবিব এবং তার বাবা। পুতিন তাদেরকে দুই কোটি ডলারের জায়গাসম্পত্তি উপহার দেন। UFCতে হাবিব ২৯টি ম্যাচ খেলেছিলেন। একটি ম্যাচেও তাকে হারাতে পারেনি কেউ। হাবিবের বাবা আব্দুল মানাপ ২০২০ সালে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। বাবার মৃত্যুর পর হাবিব খেলা থেকে অবসর নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ২০২০ সালে জাস্টিন গেইজেকে হারিয়ে অবসরের ঘোষণা দেন UFC’র ‘ঈগল’ নামে খ্যাত অপরাজিত হাবিব।
হাবিবের মাধমে দাগেস্তানের খেলোয়াড়দের সম্মানের দরোজা খুলে যায়। UFC’র লাইটওয়েট ডিভিশনে বর্তমানে চ্যাম্পিয়ন হচ্ছে ইসলাম মাকাচেভ। ইসলাম, আব্দুল মানাপের আরেকজন ছাত্র। এপর্যন্ত ২৮টি ম্যাচে ইসলাম মাত্র একটিতে পরাজিত হয়েছেন। এরপর ধারাবাহিকতায় আছেন মোহামেদ আনকালায়েভ, উসমান নুরমোহামেদভ, উমর নুরমোহামেদভ। তারা সবাই আব্দুল মানাপের জিমনেশিয়াম থেকে উঠে আসা খেলোয়াড়। এছাড়া কমব্যাট সাম্বোতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন তার ছাত্র সুলতান আলিয়েভ, রুস্তম হাবিলভ। এরা দাগেস্তানের দুর্দান্ত বীর খেলোয়াড়। আব্দুল মানাপের ছাত্রদের মধ্যে ১৮ জন ইউএফসি সহ বিভিন্ন মার্শাল আর্ট প্রতিযোগিতায় বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছেন।
আব্দুল মানাপের উদ্যোগের মাধ্যমে একটি অপরিচিত দেশ বিশ্বে পরিচিতি পেয়েছে। UFC তে এখন দাগেস্তানি খেলোয়াড়দের সমীহ করা হয়। মার্শাল আর্টের মাধ্যমে দাগেস্তানের আর্থসামাজিক অবস্থাও পরিবর্তিত হয়েছে অনেকখানি।
সুতরাং তুমিও পারো তোমার যে কোনো সাহসী উদ্যোগের মাধ্যমে তোমার দেশকে কিংবা তোমার জেলাকে বিশ্বে পরিচিত করতে। সেটা হতে পারে খেলাধূলা, শিক্ষা, সংস্কৃতি, আর্থ-সামাজিক উদ্যোগ কিংবা পরিবেশগত পরিবর্তনের পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে। মনে রেখো- একটি বিশাল পরিবর্তন শুরু হয় ছোট্ট একটি পদক্ষেপের মধ্য দিয়েই। ০