গুপ্তধন

নাঈম আল ইসলাম মাহিন

0
87

(গত সংখ্যার পর)

গত দশটা দিন ভীষণ রকম পরিশ্রম গিয়েছে ইফতুর। ছোটমামী কেবল ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাটটি μয় এবং লেনদেন সম্পনড়ব করে গেছেন। টাইলস ফিটিং, বাথরুম ফিটিং থেকে শুরু করে ইন্টেরিয়র ডিজাইনের পুরোটা কাজ ইফতুকেই তদারকি করে শেষ করতে হয়েছে। আরও তো কত রকমের কাজ। প্রত্যেকটা রুমের জন্য পর্দা কেনা, ফার্নিচার কেনা, বিছানা-বালিশ চেয়ার টেবিল সবই নতুন করে করতে হয়েছে। রুমের কালার এবং পর্দার কালারের সাথে ম্যাচিং করে জিনিসপত্র কেনা আসলেই টাফ। এ কয়দিন এষাকেও বঞ্চিত করেছে ও। কেনাকাটার সময় মাঝে মাঝে সাথে থেকেছে এষা। কিন্তু ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেলে বাবার বকা খেতে হয়েছে দু-একদিন। সবশেষে ইলেকট্রনিক্স পণ্যগুলোর কেনাকাটা শেষ করে কিছুটা হাঁফ ছেড়েছে ইফতু। কম কিছু তো নয়। এসি ফ্রিজ টিভি ওভেন…।

ড্রয়িংরুমটা বেশ বড়। দুই সেট সোফা কেনা হয়েছে পর্দার সাথে ম্যাচ করে। অসাধারণ একটা ঝাড়বাতি আর একটা শোকেসও রাখা হয়েছে ড্রইংরুমে। বেশ কিছু বই সাজানো আছে সে শোকেসে। ইতিহাস সাহিত্য রাজনীতি আর ধর্মবিষয়ক বই।

কুসুম আপুর পরীক্ষা শেষ হয়েছে পরশু। গতকালই চলে এসেছেন তিনি। ফিনিশিং টাচে তাকে সাথে পাওয়ায় বেশ আস্থা পেয়েছে ইফতু। অবশ্য ওর প্রত্যেকটা কাজই নাকি ইউনিক হয়েছে, বলেছেন কুসুম আপু।

আজ সকাল থেকে সবাই আসা শুরু করেছে এ বাসায় । খুব ভোরে গাবতলী এসে নেমেছেন নানা ভাইয়া, ইফতুর আম্মু, সাজিদ, শিমু আর কুসুমের আম্মা। তিন মামা আর ছোট খালা একটা বড় মাইμো নিয়ে রওনা হয়েছেন সপরিবারে। আসতে আসতে বিকেল। ঢাকায় জেলা প্রশাসক সম্মেলন চলছে। ডিসি আঙ্কেলকে দাওয়াত দেয়া হয়েছে। তিনি আসবেন বলেছেন।

জাফর আঙ্কেলের সাথে সারাক্ষণই যোগাযোগ হচ্ছে। দুপুর বারোটার দিকে বেনাপোল μস করে বাসে উঠেছেন তিনি। আসতে আসতে সন্ধ্যা। ইফতু বলেছে গাবতলী নেমে যেন ফোন দেয় তাকে। জরুরি কথা আছে। বাসায় যাবার আগেই যেন দেখা করে ইফতুর সাথে। সন্ধ্যা নামতে নামতে রীতিমতো আনন্দের হাট বসে গেল আসাদ গেটের কাছাকাছি মিরপুর রোডের ওপর অবস্থিত তিন হাজার স্কয়ার ফিটের ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাটটায়। কেউ গল্প করছে, কেউ টিভি দেখছে। সেজো মামী যথারীতি কিচেনের দখল বুঝে নিয়েছেন। ছোটমামা দোতালায় একটা বেডরুমে শুয়ে আয়েশ করে ‘হিস্টরি অফ ইকনোমিক ডেভেলপমেন্ট অফ জাপান’ পড়ছেন আর বাচ্চারা নীল কার্পেটে মোড়ানো সিঁড়ি বেয়ে একবার ওপরে উঠছে তো একবার নিচে নামছে। সবার জন্য নতুন পোশাক কেনা হয়েছে। আজ খাবার আসবে বাইরে থেকে। সুতরাং বাসায় আয়োজন শুধু চা আর কফির। ফ্রিজে আইসμিম চকলেট আর ড্রিংকস রাখা আছে। অফুরন্ত। যে যার মতো খাচ্ছে।

দিলরুবাদেরকেও নিয়ে আসা হয়েছে শেষ বিকেলে। তবে বাসায় উঠানো হয়নি। কাছাকাছি একটা চাইনিজ রেস্টুরেন্টে অপেক্ষা করছে। সাজিদ সঙ্গ দিচ্ছে ওদের।

সন্ধ্যার পরপরই ফোন এলো জাফর আঙ্কেলের। একটা সিএনজি নিয়ে আগেই রওনা হয়েছিল ইফতু। সোজা নিয়ে আসা হলো তাকে নতুন ফ্ল্যাটে। সারাদিনের জার্নিতে ধূলিমলিন চেহারা, পুরাতন জামাকাপড় আর কিম্ভূতকিমাকার ব্যাগ হাতে এমন একটা ভবনে উঠতে বেশ সংকোচ বোধ করছিলেন তিনি। কিন্তু লিফট থেকে বের হয়ে বিস্মিত হয়ে গেলেন জাফর সাহেব। চোখের সামনে একি দেখছেন!

আলো ঝলমলে এক ড্রইংরুম। দরজায় ফিতা আর কাঁচি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ফুটফুটে কিছু শিশুকিশোর আর তাদের সম্ভ্রান্ত অভিভাবকেরা। দিলরুবা আর ওর মাকে নিয়ে চুপি চুপি পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে সাজিদ। যতই অবাক করা ঘটনা ঘটুক না কেন, কোনো শব্দ করা যাবে না, এমনটাই বলা আছে ওদের। কুসুম আর এষা এগিয়ে এলো।

– মুঘল সা¤্রাজ্যের শেষ সম্রাট এর পঞ্চম পুরুষ জনাব জাফর বাহাদুর! আপনাকে আপনার নতুন প্রাসাদে সুস্বাগতম! এই নিন, ফিতা কাটুন। আজ থেকে এই প্রাসাদ এবং এর ভেতরকার যাবতীয় সম্পদ আপনার।

কম্পিত হস্তে ফিতা কাটলেন জাফর বাহাদুর। চারদিকে বিপুল করতালি। মুহুর্মুহু ফ্লাশ দিচ্ছে সাজিদের নতুন ডিএসএলআর।

– এইবার রাজকুমারীকে মুকুট পরানোর পালা। সম্রাট নিজের হাতেই তার কন্যাকে মুকুট পরিয়ে দেবেন, বলে একটা কাঁচের পাত্রে রাখা স্বর্ণ আর মূল্যবান পাথরে নির্মিত একটা মুকুট দেয়া হলো জাফর বাহাদুরের হাতে। ততক্ষণে ভিড় ঠেলে সামনে চলে এসেছে দিলরুবা। এতদিন পর মেয়েকে দেখে আগে জড়িয়ে ধরবে না মুকুট পরাবে তা নিয়ে দ্বিধায় পড়ে গেলেন জাফর সাহেব। প্রমে মুকুটই পরানো হলো। পরীর মতো লাগছে দিলরুবাকে। তারপর জড়িয়ে ধরলেন। দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর বাবা মেয়ের মিলন সবার চোখে পানি এনে দিলো। দিলরুবার মা-ও কাঁদলেন অনেকক্ষণ, ইফতুর মাকে কাছে টেনে।

ডিসি সাহেব এলে ড্রয়িংরুমে বসল মূল আয়োজন। গুরুগম্ভীর কণ্ঠে শুরু করলেন তিনি।

– উদ্ধারকৃত সম্পদের পরিমাণ অনেক। প্রায় পঞ্চাশ হাজার স্বর্ণমুদ্রা। উদ্ধারকারী এবং জমির মালিক হিসেবে এই সম্পদের অর্ধেক পাবে চৌধুরী সাহেব আর তার চার নাতি। এ ব্যাপারে আপনার কোনো আপত্তি আছে?

– একদমই নেই। দিলরুবা আর তার বাবা একসাথে বলে উঠল। একটু কানাঘুষা, মুহূর্তেই আবার পিনপতন নিস্তব্ধতা।

– বরং বাকি অর্ধেক এত সহজে দেয়া হবে না আপনাকে। এজন্য আপনাকে প্রমাণ করতে হবে, মুঘল সম্রাটের একমাত্র বৈধ উত্তরাধিকারী আপনি।

জাফর বাহাদুর কিছু সময় চুপ করে থাকলেন, তারপর শুরু করলেন

– ১৮৫৭ সালের ২২ সেপ্টেম্বর আমার পিতামহের পিতামহ সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর পরাজয় নিশ্চিত জেনে দূর্গ ছেড়ে চলে যান। ইংরেজরা দিল্লীর মুঘল প্রাসাদে প্রবেশ করে একে একে ২৯ জন শাহজাদাকে হত্যা করে। হত্যা করে বহু রাজেন্যবর্গ এবং সেনা কর্মকর্তাকে। বিপ্লব ব্যর্থ হবার পর বাংলা মুল্লুকেও রক্তের বন্যা বইয়ে দেয় ইংরেজরা। দেশপ্রেমিক শত শত সৈনিককে ফাঁসি দিয়ে ঝুলিয়ে রাখে গাছে। দিনের পর দিন সেই লাশ ঝুলতে দেখেছে অনেকে বাহাদুর শাহ পার্কের গাছগুলোতে। শকুনে খেয়েছে, শেয়ালে খেয়েছে, কিন্তু কেউ সাহস করেনি সেই লাশগুলো নামিয়ে দাফন করার। প্রহসনের বিচার শেষে সম্রাটকে নির্বাসন দেয়া হয় মিয়ানমারে। সেখানেই তার মৃত্যু হয়।

সম্রাটের মৃত্যুর পর তার পুত্র জওয়ান বখত এবং জওয়ান বখতের পুত্র জামশেদ বখতকেও ইংরেজরা অন্তরীণ করে রাখে। ১৯০২ সালে জামশেদ বখতকে মুক্তি দেয়া হয়। জামশেদ বখতের পুত্র বেদার বখতই আমার বাবা। সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের একমাত্র পুরুষ উত্তরাধিকারী আমি ছাড়া আর কেউ নেই। অবশ্যই আপনাদের জায়গা থেকে আপনারা খোঁজখবর নিয়েই সিদ্ধান্ত নেবেন।

– হঠাৎ এতগুলো সম্পদের মালিক হয়ে গেলে আপনি কী করবেন? কেউ একজন প্রশড়ব করল। কেঁদে ফেললেন জাফর বাহাদুর। ইফতুকে কাছে টেনে বললেন

– আমার এই আব্বাজান যদি এরকম একটা ফ্ল্যাট আমার জন্য না করতো তাহলে হয়তোবা এরকম কিছু আমি তৈরি করতাম না। আমার পিতামহের পিতামহ সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর বাংলার মানুষের মুক্তির জন্য যে অর্থ বরাদ্দ করেছিলেন, সে অর্থ সে খাতেই ব্যয় হবে ইনশাআল্লাহ! জাফর বাহাদুরের কথা শুনে সবার চোখে পানি এসে গেল।

– মানুষটা এরকমই, বললেন দিলরুবার আম্মা।

খাওয়ার পর্ব যখন শুরু হলো তখন এলেন সর্বশেষ অতিথি। তিনি ইফতুর বাবা। গতকালই তার নতুন শো-রুম উদ্বোধন হয়েছে। কর্তব্যনিষ্ঠ মানুষটার দোকানে নাকি আজ প্রচুর ভিড় ছিল। সবাইকে সেবা না দিয়ে তিনি কিছুতেই বের হতে পারছিলেন না।

সমাপ্ত